নাহ আর কোন সচেতনমূলক পোস্ট নয়। এ পোস্ট আমি গুছিয়েও লিখতে পারবোনা। কয়দিন আগে আমার বাবা কে ঘিরে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, স্টাটাস টা ছিলো এরকম
আমার বাবা আমার বাবা সেই মানুষটা যে কিনা আমার জন্য যা করতে পেরেছে, যা করেছে, তা কোনদিন আমার মা ও করেনি, করতে পারেনি
আমার এই স্ট্যাটাস টা দেয়ার নেপথ্যে ছিল কিছু কারন, কিছু কষ্ট, কিছু আবেগ।
আমি যখন প্রথম ঢাকায় আসি গতবছর, আমার থাকার জায়গা নিয়ে ছিলাম বেশ ঝামেলায়, হোস্টেলের এত নোংরা পরিবেশ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম, মামার বাসায় উঠি, স্কুলে চাকরি করতাম তখন, ছোটবেলা থেকে নিজের একটা স্পেস নিয়ে সবসময় বড় হয়েছি, ভালো লাগতো না নিজের জায়গাটুকু হারিয়ে। রাজশাহীতে মামার বাড়ী ছিলো কিন্তু আমি সবসময়ই আমার হলে আমার স্পেসে কমফরটেবল ফিল করতাম, যখন ছুটিতে বাড়ী যেতাম, রাজশাহীতে আবার আসতাম ছুটি কাটিয়ে অনেক খারাপ লাগতো নিজ বাড়ীতে নিজ রুমের কথা ভেবে, কিন্তু দুই এক দিন পর ঠিক হয়ে যেত, মনে হতো এটাও আমার নিজের বেড, নিজের পড়ার টেবিল, নিজের আলমিরা, চারপাশে নিজের সবকিছু! উপরণ্তু ভার্সিটির মনোরম পরিবেশে অনেক কিছু ভূলে গিয়ে বরং আনন্দেই থাকতাম।
বাধ সাধল ঢাকা, কোথায় পাবো নিজের মত সবকিছু নিজের মত?
ঐসময় আমি কেনো আমার ঢাকায় ফ্ল্যাট নাই এরকম অনেক কথা আমার বাবা কে শুনিয়েছি, আজ সেল, কাল বিডিডিএল, পরশু ডমইনোতে ফোন করে ফ্ল্যাটের দাম জেনেছে, বাবাকে বলেছি এখনই ফ্ল্যাট কিনতে হবে, নাহলে আমি থাকবো কোথায়?
আব্বু বলতো এটা কি ফাজলামি যে কাল সকালে উঠেই ৭০/৮০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে হবে?
এরকম টাকা ব্যাংকে রাখা বরং বেশী লাভ। আমার কাছে এ মূহুর্তে এত টাকা নাই, থাকলেও আমি কাল, পরশু ফ্ল্যাট কিনবোনা।তোমার মত আমি পাগল না!
অবশেষে দেরী হলেও বাসা ভাড়া করা হলো। ধীরে ধীরে প্রয়োজনের জিনিস কেনা হলো....
তারপরও আমি কথাবার্তা বলতাম কোথায় কত স্কয়ার ফিট দাম জানতে চাইতাম...
তবে পরে আর ফ্লাটের দাম দরবার আমি করতে যাইনি।
ঘটনা ১১/১২ মাস আগের।
বিভিন্ন কারনে খুব অল্প সময়ে আমি পাল্টে গেলাম কিভাবে জানিনা, তবে আমি পাল্টে গেলাম। আমি আর কারো কোন কথায় কান দিলাম না। আগে আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হলেই হয়ত বলতো তোমাদের কেনো ফ্ল্যাট কিনলোনা, যার ঢাকায় ফ্ল্যাট নাই তার কোন মান সম্মান নাই... ছি ছি সনি তুমি এখণ ভাড়া থাকছো? এই কি ছিল কপালে এভাবে ভাড়া থাকা?
মূলত এ ধরনের কথাগুলোতেই একসময় আমি অমানুষে পরিনত হয়েছিলাম......
কিন্তু একসময় আমি বুঝেছিলাম আমি অমানুষ হয়ে গেছি!
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতাম..
আমার কি যোগ্যতা আছে?
আমি যে এইরকম বলতাম আমার বাবার কি শুনতে খুব মজা লাগতো?
অবশ্যই সে ভাবতো আমার মেয়ের কষ্ট হচ্ছে আর তার জন্য আমি দায়ী।
আমাকে তো সারাজীবন বাবাই দিয়েছে আমি কোনদিন তা কে কি দিতে পেরেছি?
আমার বাবা তো প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ব্যস্ততার মাঝেও কোনদিন আমার ব্যাংকে টাকা দিতে ভূলে গেলোনা !
আমার বাবাতো উদভ্রান্তের মত প্রতিদিন আমার ব্যাংকে কত টাকা আছে খোঁজ নেয়।
আমার বাবা তো আমার মোবাইলে টাকা দিতে ভোলে না।
আমার বাবাই তো গতকাল রাতে জিপি স্ট্রাইকে যাবে বলে সে পাগলের মত হয়ে গেলো আমার যদি টাকা না থাকে মোবাইলে তাই কথা হবেনা ভেবে!
আমার বাবাইতো, সেতো আর কেও নয়, সে আমার বাবা যে আমার সাথে কথা বলাটা কত জরুরি ভেবে আমাকে টাকা পাঠালো।
এরকম কি কখনও হয় মামা, কাকা, খালু, প্রেমিক বা স্বামী?
না হতে পারেনা...।
এ এক বাবা ছাড়া কেউ নয়।
কখনও কি ভেবে দেখেছি আমার যতটুকু আছে কয়জনের তা আছে?
কখনও কি ভেবেছি?
কখনও নন ব্রান্ড শ্যাম্পু বা সাবান বা কসমেটিকস আমার বাবা আমাকে দিয়েছে?
যখন ছিলাম বেবী, আমার বাবার ছিলনা আজকের মত সামর্থ্য আমার বাবা কি তখন আমাকে খাওয়াননি সবচেয়ে ভালো বেবী ফুড? সবচেয়ে ভালো বেবী মিল্ক?
কোনদিন গুনে দেখেছি আমার জামা কয়টা?
কখনও গুনেছি বছরে কুয়টা স্যান্ডেল কিনি?
কখনও কি ভেবেছি আমাকে যত টাকা মাসে মাসে আমার হাতে বাবা তুলে দেন আমি তার অর্ধেক বেতন পাই?
কয়টা মেয়ে পারে আমার মত একা একটা বাসা ভাড়া করে থাকতে?
বাসে উঠতে মন না চাইলে সিএনজি কিনতে?
আমি পাল্টে গেছি হয়ত ...দুই সপ্তাহ আগে বড়আম্মুর সাথে গেছি পান্হপথে একটা আলমিরা কিনতে, বড়আম্মু তখন বলছিলো তোমার বাপ কে বলবা তোমার বিয়ের পর হাতিল থেকেই সব কিনতে , আর গোটা বাসায় কোথায় থ্রিডি টিভি কোথায় অমুক কোথায় তমুক বলে গেলেন...
আমি তখনই মনে মনে ভাবি , আমি কেনো বলবো সেটা?
আমার বাবা আমার বাসা হাতিলের জিনিস দিয়ে সাজাবে, নাকি ইউরোপ আমেরিকা থেকে ইমপোর্ট করে আনবে নাকি রাস্তার ধারের দোকান থেকে নিয়ে আসবে এটা আমার বাবার ব্যাপার।
পৃথিবীতে কি এমন কেউ আছে যে আমার বাবার চেয়ে বেশী ভালোবাসতে পারবে?
তাহলে কি আমাকে তার যা সামর্থ্য আছে সেটাই কি আমাকে দিবে না?
আমার লেখাপড়ার মূল্য কোথায় যদি আমি লেজকাটা কুকুরের মত বাবাকে বলি বাবা আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ীতে ওমুক তমুক জিনিস দিতে হবে?
আমার এক বান্ধবী বলেছিলো তোর বাবা কে বলিস তোর বিয়ের পর করোলা কার দিতে হবে!
আমি শুনে বলেছিলাম এতকিছু দিতে হলে বিয়ের বাজেট তো দেখি এক কোটি টাকাই হয়ে যাচ্ছে! আব্বু কি এসব চুরি করে আনবে নাকি?
ও বলছিলো কেনো জমি বিক্রি করবে!
আমি শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই!
আমি ওকে জিগ্গেস করি তোর বাবা কি করবে তোকে বিয়ে দিতে জমি বিক্রি?
ও বলে না!
আমি বলি তোর বাবা না করলে আমার বাবা কেনো করবে?
ওর সোজাসাপ্টা জবাব আমার ভাই আছে তোর নাই তোর বাবা জমি কা কে দিবে?
আমি তখন একগাল হেসে নিয়ে বলি সেটাইতো! দেখ তোর বাবা দুই মেয়ে হবার পর ও মনে করেছে আমার পুত্রসন্তান দরকার কিন্তু আমার বাবর কোন পুত্রসন্তান দরকার মনে হয়নি।
তাই করোলা কি ভক্সওয়াগেন দেয়ার সামর্থ্যও থাকতো আমি কোনদিনও নিতাম না। নিবোনা যৌতুক জি যৌতুক হিসেবে!!
তাহলে তো তোর কোনদিনই বিয়ে হবেনা!
কি দরকার নাই।
আমি কোন বাজারের মাল না যাকে কারো ঘাড়ে গছতেই হবে, এবং এভাবে গছতে হবে!!
আমি পাল্টে গেছিরে আমি পাল্টে গেছি!
আমার কি নেই কি নেই আমি হিসাব করিনা আর, বরং আমার কতকিছু আছে, এবং আমি কতকিছু অন্য ৫ জনের চেয়ে ভালো পাই এই হিসেবটাই এখন করি...
এই গরীব দেশে কয়জন ভালো আছে আমার মত আমার ভাবা উচিৎ। এই দেশে কয়টা মেয়ে এত সৌভাগ্যবান যে কোনদিন মেয়ে সন্তান আর ছেলে সন্তানের পার্থক্য নিয়ে ভাবেনা এমন একটা বাবা পেয়েছে?
কয়জন আমার মত এত সৌভাগ্যবান যে শুধু এই মানুষটার কারনে এতটা দূর পথ আমি হেটে এসেছি, হাটছি একজন মেয়ে না মানুষ হিসেবে!
আমার এর আগে একটা পোস্ট ছিলো আমার আব্বু শিরোনামে, সেটা সব বাবাদের উৎসর্গ করে লেখা। কিন্তু আমার এই পোস্ট শুধু আমার আব্বুর জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:০১