জাহানারা ইমামের একাত্তেরর দিনগুলি বইটি পড়েন নি এরকম মানুষ বোধহয় খুব কমই আছেন। আমি বইটা প্রথম দেখি ক্লাস ফোর বা ফাইভে , বইটা পড়ি যখন ক্লাস সেভেনে। বইটা প্রথম থেকেই অত্যন্ত উপভোগ করতে থাকি, কিন্তু আনন্দ একসময় রুপ নেয় বেদনায়, রুমী একসময় নিখোঁজ হয়ে যায়, রুমি প্রিয় রুমী, যে কিনা বলতো একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, ওমা পড়বো ফাঁসি! মা ওমা পড়বো ফাঁসি কথাটা বলতে মানা করতেন। রুমীকে একসময় কাদের যেন নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, রুমী আর ফেরেনি, মা দিন গুনতেন কবে ফিরবে রুমী? ৩০ দিন, ৬০ দিন এভাবে অনেকদিন চলে যায় কিন্তু রুমী আর ফেরেনি। আমি অনুভব করি ২০ বছরের তরুন রুমীর জন্য আমি কাঁদছি, আমার চোখ মন হৃদয় সব কাঁদছে, আমি অনুভব করি আমার নিজের কোন ভাই নেই, সুতরাং ভাই কি জিনিস সে অনুভূতিও আমার নেই কিন্তু রুমী কি করে যেন আমার ভাই হয়ে গেছে, রুমী হয়ে গেছে আমার আদরের সন্তান, একজন মা তার সন্তান হারিয়ে যেরুপ ব্যথাতুর হয়ে পড়েন আমিও হয়ে পড়ি সেরকম ব্যাথাতুর, মনে হলো আহারে এই ছেলে এই ছেলে! এত মেধাবী এই ছেলে যে কিনা কিছুদিন পর যেত আমেরিকায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে, সেই ছেলে আজ কোথায় গেলো?
আমার বাচ্চামন বাচ্চা রইলো না, আমি বুঝলাম প্রত্যেকটা মেয়ের মাঝেই একজন মায়ের বাস, সেই মা কে জেগে উঠতে ফিজিক্যালি মা হতে হবে এমন নয়, একটা মেয়ের মাঝে এই যে এত মায়া এত দয়া কাজ করে সেটা যেন একটা মা স্বত্তা কাজ করে আসলে।
একই রকম অনুভূতি আনিসুল হক এর মা পড়ে। আজাদ আর ফিরে আসেনি, আজাদ শহীদ হবার আগ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছে মাটিতে শুয়ে, বসে। ' মা ' মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটিয়েছেন মাটিতে শুয়ে, মা পারেননি তার নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাত খেতে, কারন আজাদ ভাত খেতে চেয়েছিলো, কিন্তু মা তাকে ভাত খাওয়াতে পারেননি, মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু পারেনি আজাদের মুখে ভাত তুলে দিতে। আজাদ পাবদা মাছ খেতে ভালোবাসতো, মা তার জন্য পাবদা মাছ রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন, ছিল গরম ভাত, সেই ভাত মাছ পচে যায় টিফিন ক্যারিয়ারেই, মা পারেননি আজাদকে খাওয়াতে!
আজাদের প্রিয় মাছ ছিলো পাবদা, আমার ও প্রিয় মাছ পাবদা, আমি হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র মাছ খাই। পাবদা তার অন্যতম। আমার মা আমি রাজশাহীতেও থাকতেও ঢাকায় আসার পরেও পাবদা মাছ, বা বিফ বা আমার যেটা পছন্দ রান্না করে পাঠিয়েছেন, আমার মাই একমাত্র ভালো জানেন আমি কি খাই, আর কি ফেলে দেই! সবজির মাঝে চিংড়ি মাছ থাকলে আমি সবজি প্লেটে নেই, সবজি বেছে ফেলে দেই, চিংড়িটা খাই, আমার এই অভ্যাসও আমার মা জানে, আমি যদি বলি হমম আমিতো সবজি খাচ্ছি এটা আর কেউ বিশ্বাস করলেও আমার মা জানে আমি আসলে কি করতে পারি!!
আগামী শুক্রবার আমার বাড়ী থেকে ঢাকায় টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার পাঠানো হবে, ধরুন খাবার ঢাকায় আসলো ঠিকই কিন্তু আমাকে কেউ ঐদিন খুন করলো, কি হবে আমার মায়ের? আমার মা কি কোনদিন আর সুস্হ হতে পারবে?
আজকে আমাকে খুন করা হলে কারনটা হয়ত হবে অজ্ঞাত, কিন্তু ১৯৭১ এ রুমী আজাদরা না ফেরার দেশে চলে ফিয়েছিলো এই দেশের জন্য যুদ্ধ করার কারনে।
আপনার বাচ্চার শরীরে সামান্য একটা টোকা আপনি সহ্য করতে পারেন না, আর রুমী, আজাদরা যেসব রাজাকারের কারসাজিতে ধরে নিয়ে গেলো পাক আর্মি, যাদের লাশটা পর্যন্ত শেষবারের মত ছুঁতে পারলো যেসব মা তারা কেন ভুলে যাবে?
আপনারা যারা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে, যারা নিজের সন্তানের গায়ে একটু ফুলের টোকাও স হ্য করতে পারেন না, তারা জানবেন যে এই মায়েরা এরকম হাজার হাজার অমূল্য রতন কে কুরবানি দিয়েছিলো ৭১ এ, আর কিছু বেঈমান সেই দেশে বসে তাদের অবদান কে অপমান করেন, তাদের ত্যাগ নিয়ে হাসি, তোয়াক্কা করেন!
এখন বলবেন যে এসব তো অনেক পুরনো ঘটনা! কি হবে এসব ঘেটে! কি হবে কারন ঐসব মায়েরাই আজকে বেঁচে নেই?
আমি রুমী , আজাদের মা , আমি রুমীর, আজাদের খুনীদের বিচার চাই, এই বাংলাদেশ রুমী আজাদদের মা, বাংলা মা রুমী আজাদদের খুনীদের তাঁর মাটিতে চায়না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৫৫