যেই রিভিউ আপনারা এখন পড়তে যাচ্ছেন সেটা আমি আমার ফেসবুকে শেয়ার করার পর যে কমন গালিটা আমার দিকে সাধারণভাবে ধেয়ে আসছে তা হল - "নিজে কোন বা* ছিড়সে যে অন্যের মুভি নিয়া কথা বলে? সে নিজে কি এমন একটা মুভি বানাইতে পারসে?" আমি নিজে তাদের এই সহিংস আচরণের মর্মার্থ উৎঘাটনে সক্ষম হই নাই। আমি টেকআউট বার্গারের ফ্যান। পয়সা দিয়া সে বার্গার কেনার পর যদি দেখি বার্গারের স্বাদ খারাপ হইসে, আমি কি সেটা নিয়ে কোন কথা বলতে পারবো না? সেই জন্যে আমার বার্গার বানাইতে পারা লাগবে? পয়সা দিয়া কিনা জিনিস নিয়া আলোচনা সমালোচনা করার অধিকার সকল ভোক্তারই আছে - যদি এই কথা মানেন , তবে এই পোষ্টের 'বাকি অংশ পড়ুন' লিংকে একটা খোঁচা দিয়ে দেখতে পারেন।
.
যা ভালো লাগে নাইঃ
.
১। হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন খুবই আধাখেঁচড়া ভাবে তুলে আনা হইসে। সাংসারিক জীবনের জটিলতা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, হুমায়ূন আহমেদের মত দেশব্যাপী জনপ্রিয় মানুষের সাংসারিক জীবনের জটিলতা আরও স্পর্শকাতর বিষয়, আর সেইটা পর্দায় তুলে আনতে যেই মুনশিয়ানা দরকার সেটা শতভাগ , ফারুকির ছিল না, বা নাই। তদুপরি হুমায়ূন আহমেদের মত একজন মানুষের সাথে তার প্রাক্তন স্ত্রী - তার পুত্র কন্যা এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের একটা ইকুয়েশন দাঁড় করানোর চেষ্টা ফারুকি করসেন তার মেধার কেপাসিটি অনুযায়ী। আমারে, একজন দর্শক হিসেবে তিনি সন্তুষ্ট করতে পারেন নাই।
.
২। যেই জায়গায় ফারুকি তার সৃজনশীলতা দেখাইতে পারতেন, অর্থাৎ জাবেদ (হুমায়ূন আহমেদ) এর সাথে তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিতু (শাওন) এর সম্পর্কটা ঠিক কিভাবে গড়ে উঠলো - তথা, হুমায়ূন আহমেদের পর্যায়ের সফল একজন মানুষ যার সুখের একটা সংসারও আছে, তিনি কেন তার মেয়ের এক বান্ধবীর প্রেমে পড়লেন, আর, চাইলে বাংলাদেশের অসম্ভব সুন্দরী প্লাস মেধাবী কোন মেয়েকেও তিনি বিয়ে করতে পারতেন - ঠিক শাওন ই কেন তার মনোজগৎ দখল করে নিলো - এই নিয়ে নিজস্ব একটা মতামত ফারুকি দিতে পারতেন। তিনি দেন নাই। নিতু (শাওন) এর সাথে জাবেদ (হুমায়ূন) এর সম্পর্ক ঠিক গড়ে উঠলো কিসের ভিত্তিতে, সেকি স্রেফ রূপ বা যৌনতা বা মেধা না সবকিছুর এক মিশ্রন - কিছুই বোঝা যায় না। একটা সিনও নাই তাদের সম্পর্ক stublish করার জন্যে।
.
৩। নিতু (শাওন) এর চরিত্রটার উপর অবিচার করা হইসে। একে ডেভলাপ করা হয় নাই মোটেও। কোলকাতার অভিনেত্রী পার্ণো মিত্র চরিত্রটাতে অভিনয় করসেন। তার ভালো কিছু কাজ আগেও দেখসি। তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান নাই। পর্দায় তার উপস্থাপন পুরা কুটনি মহিলার মত, যার আগমনই ঘটসে হুমায়ূনের সংসার ভাঙ্গার জন্যে। কিছু বক্তব্য নিশ্চয়ই শাওনের দিক থেকেও আছে। কিন্তু সেই দিকটা নির্মাতা ফারুকি নির্মমভাবে এড়ায়ে গিয়ে পপুলার মতামতের পক্ষেই হেলে রইসেন। মানে - মানুষ যেটা শুনতে চায় - যে হুমায়ূনের আসলে শাওনের সাথে বিয়ে করা ঠিক হয় নাই - শাওনের চরিত্রকে স্পেস না দিয়ে তিনি সেটার পক্ষেই সাফাই গাইসেন।
.
৪। সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে অনেক বড় বড় প্রশংসাসূচক কথাবার্তা অ্যাড করা হইসিল পোস্টারে। আমার অমন আহামরি কিছু লাগে নাই। আয়নাবাজির সিনেমাটোগ্রাফি এর চে ভালো লাগসে আমার।
.
৫। সিনেমার স্টার্ট আর এন্ডিং - দুইটাতেই শাওন আর পার্ণোরে স্কুল রিইউনিয়নে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা গেসে। এই দৃশ্য দিয়ে শুরু কেন, আর শেষই বা কেন, হুমায়ূন কন্যা আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী যারা একসময় বান্ধবী ছিল তাদের মধ্যে কোন মিলমিশ হইসে কিনা কিছুই বোঝা যায় নাই। যে ডায়লগ এই সিনদুটিতে তাদের মধ্যে চালাচালি হয় - তাতেও কিছুই স্পষ্ট হয় না।
.
৬। পরিশেষে - মুভির নাম ডুব কেন, তাও বুঝলাম না। কে ডুবলো, কেন ডুবলো, আদৌ ডুবলো কিনা - কিছুই স্পষ্ট না।
.
৭। ফারুকির ডুব - অডিয়েন্স সিলেকশনে অল ইনক্লুসিভ না। ইরফানের চরিত্রটি র্যানডম ইংরেজিতে কথা বলতে থাকে, আর তার বাংলা কোন সাবটাইটেল স্ক্রিনে আসে না। স্বাভাবিক ভাবেই পড়ালেখা না জানা, বা ইংরেজি ভালো বোঝে না এমন মানুষরা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে এই মুভি দেখতে গিয়ে হতাশ হবে।
.
যা ভালো লাগসেঃ
.
১। ইরফান খানের অভিনয়। একদম নিজের মত করে হুমায়ূনের চরিত্রটি সাজিয়ে নিসেন তিনি।
.
২। দুইটা সিন টাচ করসে মারাত্মকভাবে।
.
এক - ইরফানের সাথে পার্ণোর বা হুমায়ূনের সাথে শাওনের সম্পর্ক নিয়ে জানাজানি হয়ে গেসে। ঘরে ইরফানের সাথে তার প্রথম স্ত্রী রোকেয়া প্রাচীর ঝগড়া হইসে। ইরফান বাসা থেকে বের হয়ে যাবেন। পানি পান করতে গিয়ে দেখেন কোথাও পানি নাই। পানি না খেয়েই বের হয়ে যাচ্ছেন এমন সময় তার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করা নুসরাত ইমরোজ তিশা দৌড়ে গিয়ে পানি হাতে নিয়ে তার বাবার সামনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। পিতা কন্যার মধ্যে মারাত্মক ইমোশনাল এক সিন।
.
দুই - ছাড়াছাড়ি হয়ে গেসে ইরফান আর তার প্রথম স্ত্রীর। আলাদা থাকেন তারা। ইরফান গোপনে তার ছেলের সাথে দেখা করেন। ছেলেরে জিজ্ঞেস করেন - শুনলাম তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের টিজিং এর স্বীকার হয়ে ক্লাসে যাওয়া কমায়ে দিসো। তুমি বোধয় আমারে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করো। করবানা। বলবা যে তোমার বাবা অনেক খারাপ মানুষ - যেটা সবাই শুনতে চায়। সবার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বললে দেখবা ওরা আর তোমাকে টিজ করছে না। তো একজন বাবার নিজের ছেলেকে শিখায়ে দেয়া যে আমারে খারাপ বলবা যাতে তোমার সমস্যায় না পড়তে হয় - এই সিনটাও ফারুকি তুলে আনসেন মুনশিয়ানার সাথে।
.
৩। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ভালো লাগসে, ক্ষেত্র বিশেষে। হুমায়ূন আহমেদ যখন তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি করে নয়নতারা ফিল্মসিটিতে একাকী বসবাস করা শুরু করেন , তখন মৃদু সুরে কিছু গান ভেসে আসে। একবার দেখলাম , মানে শুনলাম - আমার প্রিয় বেগম আখতার সাহেবার গজল 'জোছনা করেছে আড়ি' ও ব্যাবহার করা হইসে। সাথে সাথে এই ফিল্ডে এ পেলাস বরাদ্দ করে দিসি।
..
শেষ কথাঃ
..
১। আমার পুরা রিভিউ ডুব মুভিটা হুমায়ূন আহমেদের স্ক্যাটারড বায়োপিক - এই বিবেচনায় লেখা। আপনি পাঁড় ফারুকি ভক্ত হলে এবং এই বয়ানে বিশ্বাসী হলে যে - সব চরিত্র কাল্পনিক, কারো সাথে মিলে গেলে তা নেহায়েত কাকতাল, তবে এই রিভিউ আপনার জন্যে না। নইলে , আমি ডুব মুভিটাতে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, এমনকি হুমায়ূন কন্যা শিলার বর্তমান হাজবেন্ড আসিফ নজরুল সাহেবকেও খুঁজে পাইসি।
..
২। আমি যেকোনো মুভিকে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কম্পেয়ার করি। এবং, ঠিক টেকনিক্যালটি না - আপনার গল্পটা আমি কতটুকু মুনশিয়ানার সাথে পর্দায় উপস্থাপন করতে পারলেন সেটা আমার একটা মুভি জাজ করার ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি। নোলান - স্করসিস - মায় কোলকাতার সৃজিত এই ঘরানার মুভির ফ্যান আমি। আমার রুচির সাথে আপনার রুচি বা আমার জাজমেন্টের স্কেলের সাথে আপনার জাজমেন্টের স্কেল না মিল্লে এই রিভিউ আপনার জন্যে না।
..
৩। আমি আসলে খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ। সবকিছুর মধ্যে পারফেকশন খুঁজি তাই নেতিবাচক কথা বেশী বলি। আসলে হয়তো মুভিটা ভালোই হইসে। নইলে কি কি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পাইসে বলে যে তারা দাবী করতেসে, ওগুলি তো পাওয়ার কথা না।
.
আমার বয়ান আমি দিলাম, আপনারা হলে গিয়ে মুভিটা দেইখেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৫৭