somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুঘল সালতানাতের রঙের হেঁশেলঃ মিনিয়েচার ও অন্যান্য

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবুরের দিনলিপি পাতা উল্টালে দৃশ্যটা যেন স্পষ্টতই চোখের সামনে ভাসে। মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তিমান বয়োবৃদ্ধ এ প্রতিষ্ঠাতা - ক্লান্ত , ঈষৎ বিরক্ত মুখাবয়বে দাঁড়িয়ে আছেন সদ্য বিজিত ভারতীয় উপমহাদেশের উপকণ্ঠে স্থাপিত তার রাজকীয় তাঁবুর দরোজায়। যতদূর দু' চোখ যায় তিনি তাকিয়ে খুঁজছেন এমন কিছু , যা তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে দিগ্বিজয়ের উন্মত্ত তাড়নায় পেছনে ফেলে আসা জন্মভূমি আফগান ভূখণ্ডকে। কিন্তু, ভারতে এসে তার রাজ্যপাট চালানো অথবা মানুষের সাথে মেলামেশায় সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, অথবা এ অঞ্চলের ভূ প্রাকৃতিক বৈচিত্র - কোনকিছুতেই তিনি সাযুজ্য খুঁজে পান না তার অতীতের সাথে। বিক্ষুব্ধ বাবুর রাজকীয় টেবিলে বসে তার দিনলিপির পাতা খুলে বসেন। একের পর এক ছত্র লিপিবদ্ধ করতে থাকেন চুঘতাই ভাষায় লেখা তার বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ তুজুক ই বাবুরী বা বাবরনামায়। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এখানকার মানুষদের নিয়ে তার চিন্তার সারসংক্ষেপ আমরা খুঁজে পাই এভাবে -
'Hindustan is country that has few pleasures to recommend it. The people are not handsome. They have no idea of the charms of friendly society... or friendly intercourse. They have no genius, no comprehension of mind, no politeness of manner, no kindness or fellow feeling, no ingenuity, no mechanical invention in planning, or executing its handicraft works, no skill or knowledge in design or architecture...'
'ভারতীয়রা দেখতে শুনতে আকর্ষণীয় নয়, বন্ধুত্বের মুল্য দিতে জানে না, বুদ্ধিবৃত্তিতে খাটো, ভদ্রতাজ্ঞান নেই, আচরণে চণ্ডাল, নেই তাদের কোন বৈজ্ঞানিক কিংবা শৈল্পিক উপলব্ধি বা তার প্রয়োগ' - এই হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং উপমহাদেশের মানুষদের নিয়ে সম্রাট বাবুরের মূল্যায়ন। অথচ সে সম্রাটের প্রতিষ্ঠিত সম্রাজ্যের তত্ত্বাবধানেই ভারতীয় শিল্পকলা পৌঁছায় এক নতুন উচ্চতায়। ভারতীয় উপমহাদেশের মিশ্র জনবসতির জাতিসত্তার ইতিহাসের মতই মিশ্র এ অঞ্চলের চিত্রকলার ইতিহাস। গুহাচিত্রের আঁচড়-রেখা থেকে শুরু করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর পাল - জৈন পুথিচিত্রকলা, কৃষ্ণপ্রেমরসস্নাত বৈষ্ণব চিত্রকলা ও ধর্মভাব, মালোয়া এবং দাক্ষিণাত্যের রাজপুত তথা হিন্দু চিত্রকলা এবং ছোটবড় আরও নানা জাতপাতের চিত্রাঙ্কন প্রবণতা মিলেমিশেই তো ভারতীয় উপমহাদেশের ছবি আঁকার ইতিহাস। এর মধ্যে সবচে বেশী বৈচিত্র্যের রঙ ছড়িয়েছে যে সময়কাল এবং যে সময়ের শিল্পীরা - তারা হলেন মুঘল চিত্রকর। তাই আজও একাডেমিক ভাবে বা নেহায়েত শখের বসেও আমাদের এ অঞ্চলের শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে মুঘল যুগকে বিবেচনা করতে হয় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে। আর মুঘল যুগের শ্রেষ্ঠ সব কাজগুলি হয়েছে ক্ষুদ্রাকায় সূক্ষ্মাল্লেখ্য বা মিনিয়েচার আর্ট ফর্মে।

মুঘল চিত্রকলার ব্যাপারে বহুল প্রচলিত ঐতিহাসিক উক্তিটি হচ্ছে - সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় যার জন্ম, আকবর পুত্র জাহাঙ্গীরের পৃষ্ঠপোষকতায় যার ব্যাপ্তি, জাহাঙ্গীরপুত্র শাজাহানের আমলে যার পরিণতি এবং শাজাহান পুত্র আওরাঙ্গজেবের অবহেলায় যার সমাপ্তি তার নাম মুঘল চিত্রকলা। কিন্তু আকবরেরও আগে, বাদশাহ হুমায়ুন, এমনকি হুমায়ুনের পিতা বাবুরের ধমনীতেও প্রবাহিত ছিল শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা ও গুণী শিল্পীর কদর করার স্বভাবসিদ্ধ আগ্রহ। বাবুর, যুদ্ধ বিগ্রহ এবং রাজ্যজয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে ফেলার ফলে ঠিক সেভাবে চারু -কারুশিল্পের সাথে ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা রেখে কাজ করতে পারেন নি। কিন্তু কোথায় কোন মহান শিল্পী বেড়ে উঠছেন মহীরুহের মত - সে খোঁজখবর তিনি রাখতেন ঠিকমতই। তার দিনলিপি বাবুরনামায় তাই দেখা যায় জগৎবিখ্যাত সাফাবি শৈলীকে উন্নতির চরম পরাকাষ্ঠায় নিয়ে যাওয়া মহান পারসিক চিত্রকর বিহজাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা। পারস্য চিত্রকলার এ সাফাবি চিত্রশৈলীই ভারতে এসে পৌঁছায় সম্রাট হুমায়ূনের আমলে।

সাফাবি সুলতান শাহ ইসমাইল (১৫০১-১৫২৪) পশ্চিম পারস্যের তাব্রিজ শহরে রাজত্ব শুরু করবার পর অধিকৃত করে নেন পূর্ব পারস্যে অবস্থিত তৎকালীন পারস্যের শিল্প- সংস্কৃতির কেন্দ্র হিরাট নগরটিকেও। তিনি তার পুত্র শাহ তাহমাস্পকে পড়াশোনার জন্যে প্রেরণ করেন ঐ নগরে। শুধু তাই নয়, নিজের দরবারের অধিভুক্ত করে নেন মহান শিল্পী বিহজাদকে, যিনি পরবর্তীতে শাহ ইসমাইল পুত্র শাহ তাহমাস্প যখন সিংহাসনে বসেন তখনও সম্রাটের বিশেষ আনুকূল্য লাভ করেন। তারা পিতাপুত্র মিলে চিত্রকর, কবি- শিল্পী ও দার্শনিকদের বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সাফাবি চিত্রশৈলীকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই মহান শিল্পী বিহজাদের প্রথম দিককার ধারাই এসে পৌঁছেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘল সালতানাতে, এমনকি আমাদের বাংলায়ও। উদাহরণস্বরূপ, উল্লেখ করা যেতে পারে সুলতানি শাসনামলে বাংলার সুলতান নসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ে - নিজামি কর্তৃক রচিত ইস্কান্দরনামা বা 'আলেকজান্ডারের কাহিনী' নামের ৭২ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কিত ৯টি ছবির কথা। ছবিগুলি পারস্য চিত্রশৈলীর প্রমাণ জাজ্বল্যমান। ছবিগুলোতে কোন চিত্রকরের নাম দস্তখত না থাকায় এদের এঁকেছে কে বা কারা, তা জানা যায় না। ছবিগুলি পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধের পারসিক চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করলেও বিহজাদের নিজস্ব কিছু শৈলীর ছাপও বহন করছে বলে মনে হয়। বিশেষত রুপবিন্যাসের শৃঙ্খলায় এবং মানুষের আকৃতিতে সে ছাপ স্পষ্ট। আকাশের যে চিত্ররুপ ইস্কান্দরনামায় পাওয়া যায় - মেঘ, মেঘের আড়াল হতে বিচ্ছুরিত সূর্যালোক, তাতেও বিহজাদের অঙ্কনশৈলী প্রকাশমান।

সুলতান শাহ তাহমাস্প চিত্রকলার প্রতি তার এই অতি দুর্বলতাকে ইন্দ্রিয়-পরায়ণতাজনিত মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ মনে করে সম্পূর্ণভাবে চিত্রকলার পৃষ্ঠ পোষকতা ত্যাগ করেন ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে। ফলে সাফাবি দরবারের অধিকাংশ শিল্পীকেই বাধ্য হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে হয় যার মধ্যে অটোমান, উজবেগ এবং ভারতীয় বিবিধ প্রাদেশিক সুলতানদের রাজ দরবার। আর ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার নসরত শাহ ছিলেন সেই পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। সাফাবি শৈলীর অন্ততপক্ষে চারজন যশস্বী শিল্পী - মির মুসাব্বির, মির সৈয়দ আলী, দোস্ত মোহম্মদ এবং আবদুল সামাদ ১৫৫০ সালে সম্রাট হুমায়ূনের দরবারে চলে আসেন। পারসিক / সাফাবিদ চিত্রশৈলীর সাথে এই প্রথম মুঘল তথা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মিলন - মিশ্রণ।

সম্রাট বাবুরের যদি চিত্রকলার প্রতি অনুরাগ থেকে থাকে, তবে তার ছেলে বাদশাহ হুমায়ূনের ছিল চিত্রকলার প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা। ১৫৫০ সালে তিনি ভারতের ভূখণ্ড থেকে নির্বাসনে। অবস্থান করছেন কাবুলে। রাজভাণ্ডারে ধনসম্পদ অবশিষ্ট নেই বলতে গেলে কিছুই। তবুও সেই অবস্থায়ই তিনি মীর সৈয়দ আলীকে ফরমায়েস দিলেন 'দাঁস্তা ই আমির হামজা' কাব্যের ছবি আঁকার। উদ্দেশ্য, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে উপহার দেয়া। হুকুম দিলেন, এ সিরিজ ছবি শেষ হবে বারো খণ্ড বইয়ে, প্রতি খণ্ডে থাকবে একশোটি করে ছবি। মীর সৈয়দ আলী ছিলেন বিহজাদের সমসাময়িক পারস্যের বাদাকশানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মীর মনসুরের ছেলে। বিখ্যাত শিল্পীর ছেলে , এবং স্বনামেও খ্যাত সৈয়দ আলীর জন্যে এ কাজ ছিল এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আদেশ। উমরকোটে এক অনাড়ম্বর তাঁবুর মধ্যে জন্ম নেন ভারতের সবচে প্রতাপশালী রাজা সম্রাট জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়া স্বর্গতা স্ত্রীকে বাদশাহ হুমায়ুন উপহার হিসেবে উৎসর্গ করেন হামজা নামার প্রথম খণ্ডটি। অতি যত্নের সাথে তৈরি করা তুলার কাপড়ের ওপর টেম্পেরায় আঁকা এসব ছবির মধ্যে ষাটটি ছবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ভিয়েনায় ছিল। আর পঁচিশটা এখন সংরক্ষিত আছে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে। ধারনা করা যায়, হয়ত এর সবগুলো ছবি মীর সৈয়দ আলীর স্বহস্তে আঁকা নয়, তার তত্ত্বাবধানে অন্য শিল্পীদের তৈরি, পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পী রাফায়েল বা রুবেন্স যেমনটি করতেন। হুমায়ূনের মৃত্যুর পরেও মীর সৈয়দ আলী বাদশাহ আকবরের দরবারে থেকে যান, সম্রাট হুমায়ূনের আমলে স্থাপিত মুঘল চিত্রকলার প্রোথিত ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণের উদ্দেশ্যে।

পিতার মসনদে বসে বাদশাহ আকবর পিতার আদেশ ভুলে যান নি মোটেই। বাদশাহ হুমায়ূনের আদিষ্ট কাজ দাস্তা ই আমির হামজার নতুন নাম হল হামজানামা। কাজ দ্রুতগতিতে এগুতে থাকলো মীর সৈয়দ আলীর তত্ত্বাবধানেই। আকবরের শাসনামলে ১৫৬২ সালে শুরু হওয়া এই মহাকাব্যিক পরিধিরি কাজ শেষ হয় ১৫৭৭ সালে। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার বিখ্যাত গ্রন্থ আইন ই আকবরি লেখা যখন লেখেন ততদিনে একাজ শেষ হয়ে গেছে। মুঘল শাসকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট এই প্রথম বিশালাঙ্গিকের যে ধারাবাহিক চিত্রকলা, তা পারসিক এবং ভারতীয় চিত্ররীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। দেখা যায়, ছবিগুলিতে শরীরের গড়ন কিছু কিছু পারসিক, কিন্তু তার বর্ণবিন্যাসের রীতিতে যে ঐক্য এবং ঐশ্বর্য, ছবির জমিন পূর্ণ করার কৌশল, ছবির পশ্চাৎপটকে প্রায় অনুপস্থিত করে দিয়ে মুখ্য ছবির আশেপাশে অনেক গৌণ ছবির উপস্থিতি এবং স্তর থেকে স্তরে ছবির বিস্তার - এ সকল রীতিনীতি পুরোটাই ভারতীয়। দাঁস্তার স্থাপত্যশৈলীতে যে সুন্দর মিনে করা টালির কাজ, গাছপালার পত্রপুষ্পে ভাস্বর রঙের ঐশ্বর্য তাতে মনে হয় যে দাক্ষিণাত্যের কিছু শিল্পীও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকভাবেও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। কারন সমসাময়িক সময়ে বিজয়নগর রাজ্য ধ্বংসের পর অনেক হিন্দু ও দক্ষিণী শিল্পী উত্তর ভারতে কাজের সুত্রে চলে আসেন।

সম্রাট আকবরের আমলে দ্রুতগতিতে পারসিক এবং ভারতীয় এই দুই ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটে সবমিলিয়ে নিজস্ব একটা চরিত্র খুঁজে পেল মুঘল চিত্রকলা। ক্রমশ ইরানী প্রভাব এবং তার জড়োয়া চিত্রের প্রাচুর্য ফিকে হয়ে এল, নিছক রঙ্গিন সব নকশা রুপান্তরিত হল ক্রমশ হৃদয়গ্রাহী চিত্রে, যার নাম পণ্ডিতেরা দিয়েছেন মুঘল মিনিয়েচার। মুঘল শাসকদের তত্ত্বাবধানে এই যে এক নতুন ধারার অণুচিত্র বা মিনিয়েচারের অনুশীলন, এর উৎস, সহজভাবে বলা চলে পারসিক বা ইরানীয় পাণ্ডুলিপি চিত্রকলা। মুঘল আমলে আঁকা এই ক্ষুদ্রাকৃতির ছবিগুলি করণকৌশলে বা রঙের ব্যবহারে পুরোপুরি পারসিক, কিন্তু ছবিতে উপস্থিত চরিত্রগুলির চেহারা কাঠামো আবার ভারতীয় রাজপুত গড়নের। এক অর্থে তাই মুঘল মিনিয়েচার আর্ট দেশজ রাজপুত রীতি আর পারসিক রীতির সংমিশ্রণে তৈরি এক নতুন সৃষ্টি। ইরানী রীতি ইতোমধ্যে ভারতের আবহাওয়ায় লালিতপালিত হয়ে, ভারতের শিল্পীদের যত্নে আদরে বহুলাংশেই ভারতীয় হয়ে উঠেছে। যদিও রাজপুত চিত্রের লৌকিকভাব বা চরিত্র মুঘল ছবিতে সেভাবে আসে নি, কিন্তু তবুও তা ভারতীয় হয়েই রইল, ঠিক যেমন আকবর বাদশা এবং তার বংশধরেরা আর সমরকন্দী রইলেন না, ভারতীয় হয়ে গেলেন।

সম্রাট আকবর, এবং তার সূত্রে তার পুত্র জাহাঙ্গীর নিজেদের পূর্বপুরুষের দেশের বিখ্যাত চিত্রকরদের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পীদের। মীর সৈয়দ আলী, মীর আবদুস সামাদের সাথে একই দরবারে বসে কাজ করতে লাগলেন বসাওঅন, দশ্যন্ত, কেশুদাসের মত দেশীয় বিখ্যাত শিল্পীরা। উভয় গোষ্ঠী সমানভাবে লাভ করতে থাকলেন রাজানুগ্রহ। দুটি ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি বহন করে আসা এই শিল্পগোষ্ঠীদ্বয়ের সংমিশ্রণের ফলাফলটা হল অভূতপূর্ব।

সম্রাট আকবর ছিলেন নিরক্ষর একজন মানুষ। এত বড় একটা সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তার আর সময় হয়ে ওঠে নি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, অথবা কোন শিক্ষক রেখে হলেও অক্ষরজ্ঞান লাভ করার। অথচ তাবৎ পৃথিবীর প্রায় সকল বিষয়েই ছিল তার অপরিসীম আগ্রহ। পৃথিবীর ফুলফল, কীটপতঙ্গ, ইতিহাস, দর্শন, সঙ্গীত অথবা কাব্য - এ সমস্ত কিছু নিয়ে মানুষের যত কীর্তি, যত অর্জন তা নিয়ে তার ছিল অসীম উৎসাহ, কৌতূহল, মমতা এবং হৃদয়ঙ্গম করার শ্রদ্ধা, বোধশক্তি এবং মেধা। নানা বিষয়ের দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বদের একত্র করে তিনি গঠন করেছিলেন তার নবরত্ন সভা। পণ্ডিতদের মুখে শোনা ছাড়াও পছন্দের বিষয়বস্তু চিত্রিত এবং অলংকৃত করে রাখা ছিল তার অভ্যেস। তাই তার দরবারের চিত্রকরেরা প্রতিনিয়তই ব্যস্ত থাকতেন পুরাণ, দর্শন ও ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বকে যথাসম্ভব চিত্রমাধ্যমে দৃশ্যরূপে ফুটিয়ে বাদশাহের সম্যকভাবে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্র তৈরি করা। সম্রাট আকবরের তত্ত্বাবধানে আঁকা কিছু বিখ্যাত সিরিজ পেইন্টিং যা অ্যালবাম আকারে সংগৃহীত হয়ে আছে তার একটা তালিকা নিচে দেয়া হল -

১। তুতিনামাঃ ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার লোককাহিনীর ওপর বাদশাহ আকবর আকৃষ্ট হয়ে আদেশ দেন এই সিরিজ পেইন্টিংগুলি নির্মাণের। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম দেন তোতাকাহিনী। তুলার কাপড়ের ওপর আঁকা এই ছবিগুলির নির্মাণকাল ১৫৬০ থেকে ১৫৬৫ খৃষ্টাব্দ।
২। হামজানামাঃ বিষদ বর্ণনা পূর্বেই দেয়া হয়েছে। এই ছবিগুলিও তুলার কাপড়ের ওপর আঁকা। নির্মাণকাল ১৫৬২ থেকে ১৫৭৭।
৩। বাবরনামাঃ বাদশাহ বাবুরের জীবনীর উপর নির্ভর করে নির্মিত ছবিগুলির অঙ্কন সম্পন্ন হয় কাগজের ওপর, আনুমানিক ১৫৮৯ সালে।
৪। আকবরনামাঃ এটা সম্রাট আকবরের নিজের জীবনের ওপর আঁকা ছবির অ্যালবাম। কাগজের ওপর আঁকা ছবিগুলির নির্মাণ শেষ হয় আনুমানিক ১৫৯০ সালে।
৫। রজমনামাঃ মহাভারতের কাহিনী নিয়ে আঁকা সিরিজ ছবিগুলি আঁকা সম্পন্ন হয় আনুমানিক ১৫৯৮ সালে।

১৫৭০ সালের পর খাস আকবরী আমলের চিত্রকলার চর্চা শুরু হলে এত এত জীবনী ও পুরাণ ভিত্তিক চিত্রের অ্যালবাম সৃষ্টি হয় যে কোনকোন শিল্পীর তত্ত্বাবধানে কোন অ্যালবামের কাজ কবে শুরু হয়ে কবে শেষ হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ঠিকুজী কুলুজীর হিসেব রাখা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবে বাদশাহ আকবরের আমলের বিখ্যাত চিরকরদের একটা তালিকা তৈরি করা সম্ভব। তার সময়ের প্রখ্যাততম শিল্পীদের মধ্যে আছেন আবদুস সামাদ, আবুল হাসান, আকা রিজা, বসাওন, কমল কাশ্মীরি, কেশু দাস, মীর সঈদ আলী, দশ্যন্ত, গোবর্ধন, নয়নসুখ, রুকনুদ্দিন ইত্যাদি দেশী বিদেশী শিল্পীরা।

আকবর পুত্র যুবরাজ সেলিম, যিনি পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামধারন করে ভারতের শাসনভার গ্রহন করেন - তার শিল্পকলায় হাতেখড়ি হয় সম্রাট আকবরেরই নির্দেশে, সম্রাটের ঘনিষ্ঠ আমাত্য আবদুর রহিম খানখানানের তত্ত্বাবধানে। আবদুর রহিম খানখানানের নিবেদিত প্রাণ তদারকিতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সর্বোত্তম শিক্ষাগুরুদের হাতে শিল্পকলা শিক্ষার শুরু হয়। জাহাঙ্গীরের পিতা, বাদশাহ আকবরের শিল্প সম্বন্ধে যে জ্ঞান ও উৎসাহ ছিল, তার থেকে বেশী জ্ঞান ও বোধ ছিল চিত্রশিল্পের উপপাদ্য বিষয়ে, তার যথাযথ চিত্রায়নে। তার সাম্রাজ্যের সবকিছু - শাসনভার থেকে নিয়ে ভালো চিত্রকর বাছাই করায়ও তার ছিল সমান উৎসাহ। অপর দিকে পুত্র জাহাঙ্গীর পিতার আনুকূল্যে ভালো গুরুর নিকট দীক্ষা পেয়ে হয়ে উঠলেন প্রকৃত শিল্প ও চিত্ররসিক। জাহাঙ্গীরের শিল্পশিক্ষার তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রহিম খানখানানের তত্ত্বাবধানে চিত্রালঙ্গকৃত রামায়ন নির্মিত হয়। অনেকে ধারনা করেন, মহাভারতের চিত্রালঙ্কৃত সংস্করণ রজমনামাও তার তত্ত্বাবধানেই তৈরি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে খ্যাতিলাভ করা চিত্রকরদের মধ্যে আছেন ওস্তাদ অনন্ত, নাদির - উল - জামান, মনসুর, মহাম্মদ আলী, ওস্তাদ মিসকিন, মাসুদ, হুনহার, ওস্তাদ মোদী, বিচিত্র, গোবর্ধন, হাশিম ইত্যাদি। এদের অনেকেই পরে সম্রাট শাজাহানের দরবারেও কাজ করেন।

সম্রাট শাজাহানের আমলে মুঘল চিত্ররীতির মহিমা সর্বোচ্চ শৃঙ্গারে পৌঁছে। সম্রাট হুমায়ূন, আকবর আর জাহাঙ্গীরের ধারাবাহিকতায় মুঘল চিত্রকর ও চিত্রকলার বেশ পোক্ত ভিত্তিস্তর প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। সম্রাট শাজাহানের কাজ ছিল স্রেফ সে ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখা, যা তিনি করেছিলেন বেশ সফলভাবেই। সম্রাট শাজাহানের আমলে মুঘল শাসক এবং তাদের আমাত্যবর্গের প্রতিকৃতি চিত্র অঙ্কনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। সম্রাট শাজাহানের আমলের বিখ্যাত কীর্তিগুলির একটি হল বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, তথা সম্রাট, তার প্রিয় আমীর আমাত্য ও সে আমলের বিখ্যাত সকল সুন্দরী রমণীদের প্রতিকৃতি সম্বলিত অ্যালবাম যা মুঘল মুরক্কা বলে প্রচলিত ছিল। সম্রাট শাজাহানের আমলের সবচে বিখ্যাত মুরক্কা, যা এখন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির সংগ্রহে আছে, সেটি শাজাহানের বড় ছেলে যুবরাজ দারা শিকোর নামে করা। দারা শিকো ১৬৩০ সালে এই মুরক্কার সমস্ত ছবি একত্রিত করে তার স্ত্রী নাদিরা বানু বেগমকে উপহার দেন। সম্রাট শাজাহানের শিল্পকলায় আগ্রহ ছিল অতি ব্যাপক ও বিস্তৃত। খৃষ্টীয় ধর্ম এবং উক্ত ধর্মের ছবিগুলি নিয়ে তার জানার প্রগাঢ় কৌতূহল ছিল। এছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রচলিত পঁচিশটি রাগসঙ্গীতের সারবস্তু নিজেদের তুলি এবং ক্যানভাসে ধারন করে সম্রাট শাজাহানের তত্ত্বাবধানে দরবারের শিল্পীরা অঙ্কন করেন রাগমালা সিরিজের এক একটি পেইন্টিং। সুরের ও রঙের এ অভূতপূর্ব মেলবন্ধনের একক দাবীদার ঠিক মুঘলেরা নয়। রাজপুত চিত্রজগতেও রাগমালা নামক সিরিজ পেইন্টিং এর প্রচলন ছিল, কিন্তু মুঘলদের মত সম্মান ও স্বীকৃতি এই ধারার চিত্রাবলী রাতপুতদের কাছে পায় নি। যে পঁচিশটি রাগের ওপর ভিত্তি করে রাগমালা সিরিজের ছবিগুলি নির্মিত সে রাগগুলি যথাক্রমে - ভৈরবী, পটমঞ্জরী, ললিত, মালকৌষ, খাম্বাজ, মালশ্রী, রামকেলী, বিলাবল, টোড়ি, দেশ, দেবগান্ধার, মধুমন্তি, দীপক, ধানেশ্রী, বসন্ত, কামোদ, শ্রী, পঞ্চম, আশাবরী, বাঙ্গাল, কেদার, তিলককামোদ, বিভাস ও শ্বেতমল্লার। ছবিগুলি সংগ্রহে ছিল বারাণসীর ইব্রাহীম আলী খাঁর কাছে, যিনি বংশানুক্রমিকভাবে ছবিগুলি সম্রাট শাহাজানের আমলের দিল্লী থেকেই সংগ্রহ করেন। বর্তমানে ছবিগুলি সংগৃহীত আছে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে।

সম্রাট আলমগীর , যিনি বাদশাহ আওরাঙ্গজেব নামেই মূলত প্রচলিত তিনি গোঁড়া সুন্নি ছিলেন, এ কথা ঐতিহাসিক সত্য। ফলে তার আমলে চিত্রকলায়, বা বিশেষ করে প্রতিকৃতি নির্মাণের যে সচল ধারাটি মুঘল শাসনামলে প্রবহমান ছিল তাতে ছেদ পড়ে। যে শিল্প সংস্কৃতি চর্চা মূলত প্রধান এক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতাকেন্দ্রিক, তাতে সেই প্রধান কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে প্রশংসা, অনুদান, উৎসাহ না পেলে যে শিল্পের চর্চা ক্রমশ রহিত হয়ে আসবে এতে সন্দেহ নেই। আদতে হয়েছিলও তাই। সম্রাট আওরাঙ্গজেবের আমলে বহু দরবারী চিত্রকর বাদশাহি পৃষ্ঠপোষকতা ক্ষীণ হয়ে আসায় দরবার ত্যাগ করে প্রাদেশিক রাজা ও জমিদার-আমাত্যের অনুগ্রহের অনুবর্তী হয়েছিলেন।

তবুও , শ' খানেক বছর ধরে চলে আসা ধারা তো একদম হুট করে মারা যেতে পারে না। সম্রাট আওরাঙ্গজেবের আমলেও কিছু অর্জন মুঘল চিত্রকলায় এসে যুক্ত হয়। যেমন, সম্রাট আওরাঙ্গজেবের আমলে মুঘলেরা দাক্ষিণাত্য জয় করে। ফলে দাক্ষিণাত্য পর রীতিমত এক তাৎপর্যপূর্ণ দক্ষিণী বা ডেকান চিত্ররীতি তৈরি হয় যা মুঘলরীতির সার্থক প্রাদেশিক অপভ্রংশের মর্যাদা লাভ করে। এছাড়া, সম্রাট শাজাহানের সময়কালের প্রতিকৃতিচিত্রের কাজের যে সূক্ষ্মতা, কারিগরি বাহাদুরি এবং চরিত্রচিত্রণে অন্তর্দৃষ্টি, সেটা সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে কমলো। এর প্রধান কারণ সম্রাটের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখা ও বোঝার ইচ্ছে বা সময়ের অভাব। সম্রাট আওরাঙ্গজেবের শাসনামলে যে সকল খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের নাম শোনা যায় তাদের মধ্যে আছেণ - আমাল ই ক্ষেমানন্দ, রঘুনন্দন, রায় চিতরমন, ইলিয়াস বাহাদুর, জ্ঞানচাঁদ, অনুপ চত্তর, হুনহার, ছাঁটমল, আফজল আলী খান, লছমন সিং প্রমুখ।

সম্রাটের মুখ্য কাজই হচ্ছে রাজ্যশাসন। তার মধ্যে যদি ভারতবর্ষের মত সুবিশাল একটি দেশ জয় করে তার শাসনকার্য সমাধা করতে হয়, তবে তার জটিলতা সকল সীমা পরিসীমা ছাড়িয়ে যায়। একের পর এক বিরোধী, বিদ্রোহী, বহিঃশত্রুর আক্রমণ - ষড়যন্ত্র ইত্যাদি দমন করেই রাজ্য শাসন করতে হয় হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাজাহান বাদশাহদের। এরমধ্যেও যে শৈল্পিক রুচিবোধের পরিচয় তারা রাখেন, যে পরিমান চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা তারা করেন - এর নজির সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। মুঘল চিত্রকলা, মুঘল মিনিয়েচারের সৃষ্টি - এই মহান মুঘল সম্রাটের অনুপস্থিতিতে হত না বললে অত্যুক্তি করা হয় না।

মুঘল চিত্রকলার ম্যাটেরিয়াল ও করণকৌশল নিয়ে কিছু কথা বলে এ আলোচনা সমাপ্তিতে আনা যাক। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ম্যাটেরিয়াল হচ্ছে ছবির জমিন বা ক্যানভাস। কাগজের ক্যানভাসে যেমন এখনকার শিশুরাও চিত্রাঙ্কনের হাতেখড়ি নেয়, এ সহজ বিষয়টা মুঘল আমলে চিন্তা করাও দুরূহ ছিল। প্রাথমিক মুঘল চিত্রকলার অধিকাংশ ছবিই তুলার কাপড়ে অঙ্কিত হয়েছে। উদাহরনস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তুতিনামা ও হামজানামার কথা। তারপর আস্তে আস্তে কাগজের আগমন ঘটল মুঘল চিত্রকরদের স্টুডিওতে। বর্তমান সময়ে যেমন ভারতীয় কাগজের বেশ সমাদর বিশ্বজুড়ে চিত্রকরদের মধ্যে আছে, আলাদা করে কাশ্মীরের কাগজগুলির কথা উল্লেখ করতেই হয় - ১৬০০ শতকের দৃশ্যপট এরকম ছিল না। ছবি আঁকার কাগজ আমদানি করা হত পারস্য , এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ইউরোপের ইতালি থেকে। সে কাগজ হত দু'ধরনের। একটি ছিল পাতলা, মসৃণ, সাদারঙের কাগজ; অপরটি মহিষচর্ম থেকে তৈরি বাদামি বর্ণের অমসৃণ তন্তুজ কাগজ। ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়া তেলরঙের বড় ক্যানভাসে আঁকা ছবি নষ্ট করার জন্যে এমনিতে বেশ খ্যাত। চিত্রকর বা ক্যালিগ্রাফারের হাতে কাজের উদ্দেশ্যে এসে পৌঁছাবার পূর্বে নানা কায়দাকানুনে তা ঘষেমেজে পলিশ করে নেয়া হত তেলরঙ বা জলরঙে ছবি আঁকার এবং সংরক্ষণের উপযুক্ততা অর্জনের জন্যে। আর খুব বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকার প্রয়োজন হলে কাপড়ই ব্যাবহার করা লাগতো। শিল্পীরা মাটিতে অথবা নিচু টেবিলে বোর্ড - ক্যানভাস বিছিয়ে বসে অঙ্কনের কাজ করতেন।

রঙের ব্যাবহারে মুঘল চিত্রকরেরা তাদের তিমুরিদ, তুর্কমান, সাফাবি এবং অটোম্যান পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করেছেন প্রায় সচেতনভাবেই। তাই প্রাথমিক যে মুঘল ছবিগুলো দেখতে পাওয়া যায়, তাতে রঙের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাবার অবস্থা। মিনিয়েচার ছবিগুলো জুড়ে থাকতো প্রাচীন ওরিয়েন্টাল চিত্রকলায় বহুল ব্যবহৃত তিনটি ঝকমকে রঙ - লাল, নীল আর সোনালির জড়োয়া। ওর মধ্যে আবার রঙের সেরা রঙ হত নীল; বৃষ্টির পর রোদে ঝকমক করা আকাশের নীল বা বৃষ্টিধোয়া দূর পাহাড়ের নীল, যা আসতো ইন্দ্রনীল বা ল্যাপিজ ল্যাজুলাই পাথর থেকে। প্রতিটি ডিটেইলস এত নিখুঁতভাবে আঁকা হত, যার যথাযোগ্য অনুধাবন ও মূল্যায়নের জন্যে আতস কাঁচের সহায়তা না নিয়ে উপায় ছিল না। অলঙ্কারবহুল কম্পোজিশন; অতি সুন্দর, সূক্ষ্ম অথচ হ্রস্ব রেখা; পোষাকে এবং ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে সোনালি রঙের প্রচুর ব্যবহার; বসনে ভূষণে গৃহসজ্জায় আসবাবপত্রে বিশদ জটিল নকশা - এই ছিল ভারতে ইরানী কলমের ছবিসমূহের একটি সাধারন বৈশিষ্ট্য।

সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং শাজাহানের আমলে ছবির মার্জিনে ফ্লোরাল নকশা অথবা ক্যালিগ্রাফি/হস্তলিপির উপস্থিতি ছিল পরিণত মুঘল চিত্রকলার এক সিগনেচার মার্ক। ভারতীয় চিত্রকলার অন্যান্য চিত্ররীতির সাথে মুঘল মিনিয়েচার আর্টের এই একটি বিশেষ পার্থক্য ছিল, যাতে করে মুঘল ছবির জন্ম যে বিদেশে তা বোঝা যেত। এই ক্যালিগ্রাফিক কাজ করার জন্যে প্রয়োজন হত কালি - তুলির। কারণ পারস্যে, এমনকি চীনে একএকটি অক্ষর প্রায় একএকটি ছবির মত। অপর দিকে ভারতে ছবি আঁকা হত সবসময়ই কলম দিয়ে, যার কারনে এই অঞ্চলের ছবিতে রেখার প্রাধান্য ছিল বরাবরই। তাই পারস্যে তুলি দিয়ে অক্ষর আঁকার দরুন চিত্রশিল্পীর আঁকার রীতিনীতি, হাতে তুলি ধরার নিয়মে প্রথম থেকেই ভারতীয় শিল্পীদের সাথে ছিল তফাৎ। এই তফাৎ কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারতীয় বা মুঘল চিত্রকলাকে সমৃদ্ধই করেছে।

শিল্পীরা কাজ করতেন মূলত স্বচ্ছ জলরঙ্গে। শিল্পী প্রথমে চারকোল বা সূক্ষ্ম কালো কালিতে ছবির কাঠামো বা লে আউট তৈরি করে নিতেন। কাগজ আগে থেকেই বার্নিশ করা থাকতো। ছবির জমিনে চিত্রকর আগেই স্বচ্ছ জলরঙের একটা আস্তর তৈরি করে নিতেন। সেই লেয়ার বা আস্তর হত সাদা, আবছা হলুদ বা হালকা নীল রঙের। এই হালকা রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডও কিন্তু ছবিতে যে জমিন হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে তা বোঝা যেত। তার ওপর দাঁড়াতো মূল ছবিটি।

ছবি আঁকা শেষ হলে তাকে একটু শুষ্ক রুমে পাথরের শেলফের ওপর তাক করে সংরক্ষন করা হত। বাহ্যিক আদ্রতা বা পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে তুলোর কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হত একএকটি ছবি। সে সংরক্ষণ যে সফল হয়েছিল তা আজও পৃথিবীর বিখ্যাত সব মিউজিয়ামে তাদের জাজ্বল্যমান উপস্থিতিতে প্রমাণিত হয়। হয়ত টিকে থাকতো তার অধিকাংশই, যদি না যুদ্ধবিগ্রহে এবং বারবার দখলদার, হানাদারের তরবারিতে ক্ষতবিক্ষত না হত ভারতীয় উপমহাদেশের মাটি। যদি না মূল ভূখণ্ড, তথা এসব ছবির জন্মস্থান থেকে যত্নে অযত্নে সমূলে উপড়ে ফেলা না হত অতিযত্নে আঁকা এসকল ছবি।

সাহিত্য হোক, বা সঙ্গীত; চিত্রকলা হোক বা চলচিত্র - যে কোন একটি অঞ্চলের শিল্পের নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি হওয়া তার ভৌগলিক সার্বভৌমত্বের মতই খুব জরুরী একটি বিষয়। নইলে সে জাতির আলাদা করে অহংকার করার মত কিছু আর থাকে না। সংস্কৃতিতে দীনহীন একটি জাতির চে' ভঙ্গুর আর পঙ্গুই বা আর কারা? আলোচনার শেষাংশে এসে এই গুরুগম্ভীর কথাগুলো এই জন্যেই উল্লেখ করা যে ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস যদিও অবিমিশ্র নয় - তবুও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে সংস্কৃতিও শূন্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ায় না। আমরা নিয়েছি অনেকের কাছ থেকেই, নিয়েছি অনেক কিছুই - কিন্তু আমরা দেউলিয়া ছিলাম না কখনো। পারস্পারিক লেন-দেন, সৌহার্দ্যপূর্ণ আদান-প্রদান, মিশ্রণ-সংমিশ্রণে ভর করে দাঁড়িয়ে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের পুরনো এক সংস্কৃতি। গ্রহন করার পাশাপাশি আমাদের দেয়ার খতিয়ানও নেহায়েত সংক্ষিপ্ত না। বহুদিন যাবত এই এক মর্ম পীড়ন থেকে থেকে ভুগিয়েছে যে - কি সাহিত্যে, কি চিত্রকলায়, কি স্থাপত্যে - প্রাচ্যের সাথে আমাদের হয়ত কেবল নেয়ারই সম্পর্ক। যে সম্পর্ক কেবল প্রভু আর ভৃত্যের। কিন্তু একটু গুঢ় ভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় শিল্পসাহিত্যের বিবিধ শাখায় প্রাচ্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল নেয়ার নয়, বরং দেয়ারও। তারা আমাদের ভাষা শিখিয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তারা নিয়েছে ভাব, নিয়েছে আধ্যাত্মবোধ। তারা আমাদের বাহিরটাকে হয়ত সাজিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু নিজেদের ভেতরকে ঋদ্ধ করেছে আমাদের বৈরাগ্যচেতনে, আমাদের বাউলিয়ানায়। মুঘল মিনিয়েচার আর্ট, বা বৃহদার্থে মুঘল চিত্রকলার তুলির আঁচড়, রঙের মিশ্রণ হয়তো পারসিক, অটোমান, তিমুরিদসহ আরও বহু জাতপাতের মিশ্রণে সৃষ্ট; কিন্তু যে ঘটনার ঘনঘটাগুলো আমরা ও ছবিগুলোতে দেখি, দেখি যে কুশীলবসমূহের উপস্থিতি, যে ভাব বা বোধের অনুভব হয় হৃদয়ের গহীনে - তা আমাদের অতি আপন, তা আমাদের অনেক দিনের চেনা। মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের আমলেই মুঘল শিল্পীরা আলীবর্দি খাঁ'র আমলে তৎকালীন বাংলার মুর্শিদাবাদে আসেন। পরে সিরাজোদ্দউলা, মীরজাফর, মীরকাসিম হয়ে কোম্পানির শাসনামল, কোম্পানি চিত্রকলা, ইংরেজদের হাতে বাংলায় প্রথম আর্ট ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠা, কলকাতা আর্ট কলেজ হয়ে আমাদের জয়নুল - কামরুল, আমাদের চারুকলা, বাংলাদেশের চিত্রকলার জন্ম, উত্থান। বিচ্ছিন্ন নই আমরা কেউই। আঙ্গিকে বা ভাবে, তাই এখন মুঘল চিত্রকলা আমাদের ভেতর দিয়েই বয়ে চলছে। ২০১৮ সালের প্রেক্ষিতে বসে মুঘল চিত্রকলার ইতিহাস পঠনের গুরুত্ব, হয়তো এ জায়গায়ই।

(লেখাটি ইত্তেফাক পত্রিকার ঈদ সংখ্যা ২০১৮ তে প্রকাশিত)

ঋণস্বীকারঃ
লেখাটি প্রস্তুত করতে ঐতিহাসিক বিবিধ তথ্যাবলির জন্যে আমার নির্ভর করতে হয়েছে J. M. Rogers Mughal Miniatures নামক প্রামাণ্য বইটি, দুই খণ্ডে সমাপ্ত অশোক মিত্রের ভারতের চিত্রকলা - এবং অশোক ভট্টাচার্যের লেখা বাংলার চিত্রকলা ইত্যাদি গ্রন্থের ওপর।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৩৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×