somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরা আসে চুপিচুপি। ২৯,৩০,৩১ আগস্ট! সাতজন বাংলার দামাল সন্তানের আত্মত্যাগ।

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :








ঢাকার বুকে সেক্টর টু এর গেরিলা পাকিস্থানী জান্তাদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে ফেললো পুরো আগস্ট মাস জুড়ে । পাকিস্থানী চিফ অফ কমান্ডরা কোন সূত্রই খুঁজে পাচ্ছে না, কিন্তু ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এক একটা ভয়ংকর প্রতিরোধের খবর আসছে নিয়মিত বিরতি দিয়ে, যেন মাথার চুল টেনে ছেড়ার অবস্থা ।
শ্রাবণের ঝির ঝির বৃষ্টির এক সন্ধ্যা, পথে গুটি কয়েক সাধারণ লোকের বিচরণ । হঠাৎ হঠাৎ ছুটে যাচ্ছে কয়েকটি প্রাইভেট কার, টাউন সার্ভিস বাস আর খানসেনাদের জীব ও লরী । একটি টয়োটা করোনায় স্টিয়ারিং এ সামাদ, সাথে আরো তিন সঙ্গী -উলফত, বাকি ও হাফিজ । নর্থসাউথ রোডের শিয়া সম্প্রদায়ের জামায়াতখানার পাশে পার্ক করা একটি মাজদার অদূরে এসে টয়োটা করোনাটি দাড় করালো ওঁরা । গাড়ী থেকে নেমে গেল একজন, মাজদার পাশ ঘেষে বসে পড়লো -যেন প্রস্রাব করতে বসেছে । কয়েক সেকেন্ড মাত্র, কাজ সেরে গাড়িতে উঠে উলফত । উঠামাত্রই টয়োটা করোনাটা সাই করে বের হয়ে গেল ।
হাফিজ বললো- উলফত ফাটবে তো !

: “চাকা ঘুরলে একবোরে নির্ঘাত” -হাসির সাথে জবাব এলো । এখনো মনে হয় ঘুরেনি, ঘুরলে ঠিকই শব্দ ভেসে আসতো ।
আবার প্রশ্ন করা হলো- এম কে – 14 এর শব্দ কতদূর পর্যন্ত আসে ।
: শুধু কি এমকে -14 এর শব্দ, টায়ার ফাটার শব্দটাও যোগ করে নাও । ব্যাস, দমাদম, মসত কলন্দর – জবাব দিলো আরেক জন ।
: সামাদকে জিজ্ঞেস করলো উলফত- আর কটা আছে সামাদ ভাই ।
: চালিয়ে যাও, আরো গোটা পাচেক রয়েছে ।, তবে এমকে 16 কিন্তু বেশ কড়া জায়গা বেছে লাগতে হবে- জবাব দিলো সামাদ । (এমকে-14 তুলনায় এমকে-16 একটু বড় আকৃতির মাইন)
নর্থসাউথ রোড থেকে একেবারে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত যেখানে সুযোগ মিলবে সেখাই মাইন পুতে রাখার প্ল্যান নিয়ে ওঁরা অপারেশনে বেরিয়েছিলো । ওঁরা যখন হাইকোর্ট-ময়মনসিংহ রোড এর ট্রাফিক রাউন্ড এবাউটের কাছে এলো, লক্ষ্য করলো হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে একটি দোতলা বাস আসছে, তাৎক্ষনিক পরিকল্পনা সেট করা হলো । বাসটি স্ট্যান্ডে দাড়াতেই করোনাটা অদূরে গিয়ে দাড়ালো; বাকী আর উলফত আস্তে করে নেমে গেলো । সেই সময় দিনের আলোতেও বাঙালীরা বের হতো খুব কম, আর সন্ধ্যার পর তো প্রশ্নই আসে না ।

দোতলা বাসের যাত্রীরা সব অবাঙ্গালী । বাস থেকে কিছু যাত্রী নামছিলো, দোতলা থেকে কিছু নামাতে একটু বেশি সময় পাওয়া গেল । যাত্রীদের মাঝে মিশে গিয়ে কৌশলে বাসের চাকার নিচে বসানো হলো মাইন । উলফত ও বাকী গাড়ীতে গিয়ে উঠার সাথে সাথে বাসটিও সচল হলো আর বিকট শব্দে ফাটলো মাইন । মাইন আর বাসের টায়ার ফাঁটার শব্দে মনে হলো নিঃশব্দ সড়কে যেন বজ্রপাত হলো । দোতলা বাসটি ছিটকে পড়লো কাত হয়ে ।
টয়োটা করোনা বিলম্ব না করে তখন নিউমার্কেটের অভিমুখে দ্রুত গতিতে চলছে । ওঁরা গ্রীণ রোডের মোড়ে অবস্থিত পেট্রোল পাম্পে এসে দেখলো কয়েকটি মিলিটারি জীপ পেট্রোল নিচ্ছে । থেমে গেল করোনা, একটি এম.কে.-16 হাতে নেমে গেলো হাফিজ, সায়েন্স ল্যাবরেটরীর রাস্তায় বসানো হলো মাইনটি । মাইন প্রতিস্থাপন করে মোহাম্মদপুর অভিমুখে ঢকুতেই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলো । পরবর্তীতে জানা যায় যে, একটি মিলিটারী জিপ শূন্যে হেচকি খেয়ে চিৎপটাং হয়, জীপে থাকা তিনজন খানসেনাই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ।
মোহাম্মদপুর ঢুকে যুৎসই কোন শিকার মিলছিলো না, একটা ভাল স্পট পেলে দেখা যায়, গাড়ীতে আরোহী রয়েছে । করোনাটি রেসিডেন্সসিয়াল মডেল স্কুলের পাশ দিয়ে চলে এলো আইয়ুব গেটের (বর্তমান- আসাদ গেট) কাছে । এই সেই ভেবে তখন স্থির হয় যে – উলফত দুটি মাইন নিয়ে করোনা থেকে নেমে যাবে, সুযোগ বুঝে মিরপুর গামী কোন বাস আসতে দেখলে মাইন বিছিয়ে সটকে পড়বে । কাজ শেষ হলে উলফত কে তুলে নেবে ওঁরা । এই সময়টুক পেট্রোল নেবার ভান করে পূর্বপাশের পাম্পটির কাছে নিয়ে রাখবে করোনাটিকে । পাম্পের কাছে দাড়াতেই ওঁরা তিন জন দেখতে পেলো সার বেঁধে একটি মিলিটারি কনভয় আসছে । দুটো বড় লরীতে খানসেনা আর মালসামানায় ভর্তি ।

পেছনে দুটো জীপ- তাতে আবার মর্টার বসানো । আর একটি গাড়ী তার পেছনে- দেখতে অনেকটা টেলিভিশনের ভিটিআর ভ্যানের মতো । কোন অপারেশনের পর কিংবা ছাউনি স্থানান্তরে জন্য হয়তো কনভয়টি যাচ্ছে । করোনার ঠিক নাক গেসে এক এক করে কনভয়টি যাচ্ছে, ভেতরের তিনজনকে দেখে ফেললে সর্বনাশ কতটা হতে পারে- সেই ভাবনায় ওঁরা বিচলিত আর এর মাঝে যদি মাইন ফাটে, তাহলে নিশ্চিত উলফত ধরা পড়ে যাবে । উলফত কি মাইন বসানোর আগে ধরা পড়ে যেতে পারে- এমন শংকাও ওঁদের মনে জাগলো । যা হয়- হবে, তাই ভেবে এস্কেলেটর চেপে ওরা আইয়ুব গেটে পাশ থেকে উলফতকে তুলে নেবে ভেবে কনভয় অতিক্রম করে এগিয়ে গেল । আইয়ুব গেটে এসে নতুন বিপত্তির সন্মুখিন হলো । কনভয়টিও পেট্রোল নেবার জন্য পাম্পে থেমেছে । এসময় মিরপুর গামী একটি দোতলা বাস স্ট্যান্ডে এসে দাড়াতেই দেখা গেল উলফত নির্বিকার আর শান্ত ভঙ্গিতে সেটির চাকার নিচে মাইন রেখে এলো । তখনি এপাশের স্ট্যান্ডেও একটি নিউমার্কেটগামী টাউন সার্ভিস এসে দাড়াতেই উলফত করোনা পাশ দিয়ে হেঁটে সেদিকে এগিয়ে গেল ।

করোনায় সতীর্থদের ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো । যেকোন সময় দোতলা বাসটি সচল হলে মাইন ফাটবে, ওপাশে মেলিটারি কনভয় দাড়িয়ে, উলফত টাউন সার্ভিসের প্রায় কাছাকাছি পৌছে গেলে, এমন সময়ই দোতলা বাসটি সচল হতে মাইন বিস্ফোরিত হলো, আর কাত হয়ে ছিটকে পড়লো । হঠাৎ শব্দে ভীত হয়ে টাউন সার্ভিসের ড্রাইভারও বাস নিয়ে অগ্রসর হবার ঠিক আগমূহুর্তেই মাইন রেখে উলফত সটকে পড়লো । চাকা ঘুরতেই আবারও বিস্ফোরন । কিছু বুঝে উঠার আগেই তড়িঘরি করে উলফতকে তুলে নিয়ে হেডলাইট অফ করে টয়োটা করোনা শেরে বাংলা নগরের রাস্তা ধরে পগাড় পাড় । একটি জীপ ওঁদের পিছু নিলেও, শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে পড়ে, আর ওঁরা ছয়-ছয়টি মাইনের সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপদেই সেই রাতের অপারেশন সফল করলো ।

আগস্টের প্রথম সপ্তাহ অ গাড়ী থেকে নেকড়ের মতো নিঃশব্দে অথচ ক্ষীপ্রগতিতে নামলো পাঁচজন গেরিলা । এক মিনিটের মধ্যে তারা পজিশন নিল । চারজনের হাতে ষ্টেনগান । একজনের হাতে চাইনীচ এস.এম.জি । অর্ডার হল –ফায়ার । ঘড়ির কাটায় কাটায় চললো পুরো এক মিনিট ব্রাশ ফায়ার । কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়তে লাগলো ঢাকা নগরীর ফার্মগেট চেকপোস্টের রাজাকার ও মিলিটারি পুলিশগুলো । তার ঠিক একমিনিট পর কমান্ড দেয়া হলো- রিট্রিট । বিশ থেকে পয়ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ীতে উঠে পড়লো গেরিলারা । তারপর সাঁ করে বেরিয়ে গেল সবুচ রঙের টয়োটা করোনা গাড়িটা । পৌনে তিন মিনিটের কম সময়ে মধ্যে শেষ হলো রোমঞ্চকর ও সফল একটি অপারেশন । মারা পড়লো হানাদার বাহিনীর ৫ জন এমপি আর তাদের ছয় সহযোগী রাজাকার ।
ধানমন্ডী ২৮ –এর হাইড আউটে মিটিং’এ এই অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো । সামাদ ছিলো চালকের আসনে, আর পাঁচ জন গেরিলা – জুয়েল, বদি, আলম, পুলু আর স্বপন এর উপর দায়িত্ব ফায়ারিং এর, এবং তাঁরা তা বেশ ভালভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছিলো । এই অপারেশনের পর বন্ধুকের নল পাহারায়া রেখে হানাদার’রা রাতের অন্ধকারে লাশগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায়, প্রত্যক্ষদর্শীর মতে – হানাদারা বন্দুক উচিয়ে রেখেও যখন রাস্তার রক্তের দাগ পানি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছিলো, ঠ্যাঙ্গে ঠ্যাঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছিলো, পরদিন সকালেও ঐএলাকার দোকানপাট – ব্যাংকের শাটার খোলার সাহস করেনি ।


হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন ২:


গেরিলাদের তান্ডবের আর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ ১১ই আগস্টের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দ্বিতীয় দফার । সেই অপারেশনের মূল নায়ক ছিলো – সেক্টর টু এর সর্বকনিষ্ট ক্র্যাক গেরিলা আবু বকর । সহযোগী হিসেবে ছিলেন নীয়ন সাইনের সামাদ । থাই ইয়ারওজের অফিসের সাথে কাজের চুক্তির সুবাদেই বকর আর সামাদ ইন্টারকনের ভেতর যাতায়াত করছে কয়েক দিন ধরে । এই যাতায়াতের মধ্যে ওরা বিস্ফোরণের স্থান নির্ধারণ করেছে, একটি ব্রীফকেসের মধ্যে ২৪পাউন্ড পিকে ভরে ওটাকে বিস্ফোরকে রূপ দিয়েছেন । ১১ তারিখ বিকেলে সামাদকে সাথে নিয়ে বকর হোটেলে ভেতর প্রবেশ করলো ।

টয়লেটের মূল দরজায় সামাদকে পাহারায় রেখে ব্রীফকেস কোনার ল্যাট্টিনে ঢুকে পড়লো বকর, ল্যাট্রিনের দরজা ভেতর থেকে লক করে কাজে লেগে যায় বকর । ব্রীফকেসটি রাখা হলো কমোডের পেছনে, তারপর টাইম পেন্সিল প্রেস করে ল্যাট্ট্রিনের দরজা বন্ধ অবস্থাতেই রেখে উপর দিককার দেয়াল টপকে বেড়িয়ে আসে বকর । সামাদকে প্রথমে বের করে সবশেষে দ্রুততার সাথে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে বকর । ৫টা ৫৬ মিনিটে ঘটলো প্রচন্ড বিস্ফোরণ । হোটেল লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড এবং আশ পাশের কক্ষের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়লো, ছিটকে গেল কক্ষের দরজা, ভেঙ্গে পড়লো কক্ষের ভেতরকার এবং লাউজ্ঞের লাগোয়া দেয়াল । আহত হলো বেশ কয়েজন । বিশ্ব সংবাদপত্রসমূহ বাংলাদেশে মুক্তি-বানিরীর তৎপরতায় আরেকটি রোমাঞ্চকর সচিত্র সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত করলো । বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি নয়, এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো ঢাকার সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটিতেও যে গেরিলা আক্রমণ করতে সক্ষম- তা পাকিস্তানী জান্তা আর বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া, বকররা সেই মেসেজটি ভালভাবেই জানিয়ে দিতে পেরেছিলো
সেক্টর টু কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কামালের নেতৃত্বে জনা দশেক গেরিলার সমন্বয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকায় প্রেরণ করেছে । অপারেশনের জন্যে আট’টা শেল সহ একটা সাড়ে তিন ইঞ্চি রকেট লাঞ্চারও দিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং তা চালানোর দায়িত্ব দিয়ে সাথে দেয়া হয়েছে আর্টিলারির গানার ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলামকে । অস্ত্রের মধ্যে আরো আছে দুটো এসএলআর, সঙ্গে আন্যার্গী লাঞ্চার । প্রত্যেকের জন্যে একটা করে স্টেনগান, চারটা ম্যাগাজিন, দুটো গ্রেনেড আর অসংখ্য বুলেট ।
১৯ আগস্ট, বাংলা ভাদ্র মাসের প্রথম দিনটা একটা গুমোট ভাব নিয়ে আছে, আকাশে মেঘ । সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে কাজী কামালের নেতৃত্বে অপারেশন স্পট রেকি করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে । গেরিলারা সন্ধ্যার পর বাড্ডার ওপারে পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউট থেকে দুটো নৌকা যোগে রওনা হলো । প্রথম নৌকায় কাজী, বদি, জুয়েল আর আরো দুজন, অন্য নৌকায় রুমি, ইব্রাহিম, জিয়া, আর আজাদ । আজাদ সেদিন বেশ উত্তেজিত তার প্রথম অপারেশনে আসা নিয়ে, কিছুটা নার্ভাসও । কাজীদের নৌকা কিছু একটা চেক করতে রুমীদের নৌকা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে যায় – অন্ধকার রাত, রুমীরা দূর থেকে কাজীদের নৌকা দেখতে পাচ্ছে না । হঠাৎ রুমিরা ভয়ানক গুলির আওয়াজ শুনতে পেলো । ওরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না । ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় পড়ে যায় প্রথম অপারেশন আসা আজাদও । গুলির শব্দ থামতেই কিছুক্ষণ পর কাজীদের ফিরে আসতে দেখে রুমীরা আর জানতে পারে বৃত্তান্ত ।

জুয়েল আর কাজীর স্টেনগান নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু কাজীর নিষেধ সত্ত্বের ওর কোলের উপরেই রেখেছিল, টিগারের উপর আঙুল জড়িয়ে বসে ছিলো ও । কাজীরা একটা মিলিটারি ভর্তি নৌকার সামনে পড়েছিলো, মাঝিটা ছিলো রাজাকার – সে বাংলা জানতে চায় – “কে যায়”, অন্ধকারে মিলিটারিগুলো একদম চুপ মেরে ছিলো । প্রশ্নের উত্তরে কাজী ঘুরিয়ে জবাব দেয় – “সামনে” । নৌকাটা একেবারে কাছে আসতেই ওদের চোখে পড়ে নৌকাভর্তি মিলিটারি । ভাগ্যিস বদি ওর স্টেনগান হাতেই রেখেছিলো – মিলিটারি দেখা মাত্রই কেউ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই বদি তড়িৎ রিয়াক্ট করে, পাকিদের নৌকা বরাবর ব্রাশফায়ার চালিয়ে যায় । বদির ব্রাশের মুখে টিকতে পারেনি পাকিরা, যদিও ওরা গুলি চালিয়েছিলো – সেই গুলিই এসে লাগে জুয়েলে অঙুলে, তিনটি আঙুল ভয়ংকর রকম জখম হয় জুয়েলের । মিলিটারিদের বেশ কয়েকটা মরে, বাকিগুলো পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে সাতরে প্রাণ নিয়ে পালায় । জুয়েল মারাত্মক জখম হওয়ায় ওরা সেখান থেকেই পিরুলিয়ার হাইডহাউসে ফিরে আসে আর ওখানেই রাত কাটায় । জুয়েলকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন থাকলেও এই রাতে তা আর সম্ভব ছিলো না । কাজী ডেটল আল ব্যান্ডেজ এনে ফাস্ট এ্ইড ট্রিটমেন্ট করলো । আজাদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো জুয়েলের জন্যে, কিন্তু ভীষণ যন্ত্রনায় কাতর জুয়েলের তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, বরং উল্টো ঠাট্টা মশকরা করে বলে উঠলো –“হেভি আরাম লাগতেছে । দেশের জন্যে রক্ত দেওয়াও হইল, আবার জানটাও রাখা হইলো । কইয়া বেড়াইতে পারুম দেশের জন্যে যুদ্ধ কইরা আঙুল শহীদ হইছিলো । হা হা হা ।“

পরদিন কাজী আর বদি মিলে জুয়েলকে নিয়ে যায় ডাঃ রশিদ উদ্দিনের চেম্বারে । ডা. রশিদ তাঁর রেডক্রস চিহৃ আঁকা গাড়িতে করে জুয়েলকে নিয়ে যান রাজারবাহে যা. মতিনের ক্লিনিকে । ওখানে অপারেশন থিয়েটারে জুয়েলকে হাতে ব্যান্ডেজ করে দেন । সেখান থেকে দিলু রোডের হাবিবুল আলমের বাসায়, জুয়েলকে সেবার দায়িত্ব খুশি মনে নেয় আলমের তিন বোন ।
25শে আগস্ট সন্ধ্যায় সাংঘাতিক দুটো ঘটনা ঘটে গেছে, এর ওর মুখে মুখে চড়ে খবরটা ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো, ছোট ছোট জটলায় ফিসফিস করে বিস্ময় নিয়ে সেই আলাপই চলছে ঘরে বাইরে । উত্তেজনায় ভরপুর কেউ একজন ঘটনার বর্ননা করছে তো অন্যরা চোখ বড় বড় তা গিলছে । জটলার কেউ হয়তো বলে উঠছে – কি সাংঘাতিক ! কেউ হয়তো বলছে – কি বেপরোয়া কান্ড রে বাবা ! কেউ হয়তো বলছে – তারপর কি হলো ? … সাংঘাতিক সেই ঘটনা জনে জনে ফেরী হচ্ছে আর আনন্দে ভরে উঠছে ঢাকাবাসীর হৃদয়কোণ । শহর জুড়ে হুলস্থুল ফেলে দেয়া সেই ঘটনাটা ঘটে ২৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭ টার কিছু পরে, কয়েকজন বিচ্ছুর দল ধানমন্ডী 18 নম্বর রোডে এক ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির সামনে এ্যাকশন করেছে, সেখানে পাহাড়ারত জনা দশেক এম.পি (মিলিটারি পুলিশ)-কে খতম করে দিয়েছে চোখের নিমিষেই; ১৪ নম্বরে এ্যাকশন শেষ করে ৫ নম্বর রোডের মাথায় চেকপোস্টে বাঁধার মুখে আবারো গুলিবর্ষণ- এইবার দুজন আর্মি খতম; চেকপোস্ট পেরিয়ে যেতেই আবার নতুন বিপত্তি, পেছনে ফেউ হয়ে তেড়ে আসছে আর্মির জীপ – চলন্ত গাড়ী থেকে বিচ্ছুগুলো নস্যাৎ করলো সেই তেড়ে আসা, গাড়ীর পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে তিনটি স্টেনগান থেকে ছুটে যাওয়া গুলির ঝড়ে উল্টে গেলো তেড়ে আসা আর্মি জীপটি, সব কয়টা খতম …

এই কান্ড কারা ঘটিয়েছে শহরবাসী ঘুনাক্ষরেও কিছু আন্দাজ করতে পারছিলো না, শহরবাসীর সামনে আলম, সেলিম, কাজী, স্বপন, বদি, রুমীদের দাড় করিয়ে দিয়েও যদি বলা হতো ধানমন্ডীর তান্ডব পেছেনে অভিজাত ঘরের এই ছেলেগুলোই জড়িত ছিলো, হয়তো সবার জন্যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, কেননা বয়সের সাথে এত বড় বড় অর্জন যে অনেকটাই অবিশ্বাস্য । রুমী-আলমরা সেই অবিশ্বাস্য কান্ডই যে ঘটিয়ে এসেছিলো ।

৩১ আগস্ট উদ্ভান্তের মতো গিয়ে মেলাঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো ফতেহ আলী চৌধুরী, তার কাছ থেকে ২৯০-৩০ তারিখের অত বড় বিষাদের খবরটি জানতে পারলেন মেজর হায়দার আর সেক্টর কমান্ডার খালেদ । খবর শুনে খালেদ মোশাররফ ভীষণ আপসেড হয়ে পড়লেন, কমান্ডারের তাবু থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলেন, মেজর হায়দার, কিছুক্ষণ পর কে যেন এসে বললো – মেজর হায়দার তাঁর তাবুতে অঝোড় ধারায় কাঁদছে আর “মাই বয়েজ, মাই বয়েজ” বলে চিৎকার করে কাঁদছেন । ক্র্যাক-প্লাটুনের সব গেরিলাদের ঢাকা মেলাঘরে ফিরে আসার নির্দেশ পাঠিয়ে দিতে বলে দিলেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ।

২৯ তারিখ সকাল এগার টার দিকে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালাল স্যারের ছেলে ফরিদের সাথে তার বাসাতেই ছিলো বদি, পাকিস্তানি আর্মিরা বদিকে সেখান থেকেই প্রথমে গ্রেফতার করে, বিকালে গ্রেফতার হয় সামাদ । দুজনের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন, সহ্য না করতে সামাদ মুখ খুলে এক এক করে দিয়ে সকল সহযোদ্ধার ঠিকানা, অপারেশনে বৃত্তান্ত । তারপর ২৯ তারিখ দিবাগত রাত থেকে ৩০ তারিখ ভোর পর্যন্ত পাকিস্থানী আর্মিরা রাতের অন্ধকারে ঢাকার বিভিন্ন বাসায় চালায় গ্রেফতার অভিজান । এলিফেন্ড রোড ৩৫৫ নং কনিকা থেকে রুমীকে, ২০ নিউ ইস্কাটন থেকে হাফিজ, ২৪ মগবাজারের বাসা থেকে আজাদ ও জুয়েল, গুলশান-২ এর ৯৬ নম্বর সড়কের ৩ নং বাড়ি থেকে বকর এবং ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার হয় আলতাফ মাহমুদ । সবার ঠাই হয় নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরীর পাকিস্থান আর্মির টর্চার সেলে, পাকি হায়নারা দিন রাত ওঁদের উপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন, সেই নির্যাতনে সাক্ষী হয়ে ছিলো কেউ কেউ, ওঁদেরই সাথে গ্রেফতার হওয়া পরিবারের অন্যান্যরা, যাদের পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়, বিভৎস অভিজ্ঞতার এক ভয়ংকর স্মৃতি যাদের তাড়িয়ে বেড়াবে জীবনভর ।
সেদিনের পর আর ফিরে আসেনি ওঁরা …।।




শহীদ শাফী ইমাম রুমি
শহীদ বদিউল আলম বদি তপন
শহীদ মাগফার চৌধুরী আজাদ
শহীদ আলতাফ মাহমুদ
শহীদ মোহাম্মদ আবু বকর
শহীদ হাফিজুর রহমান হাফিজ
শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল





শহীদদের পরিচয় নিচে দেয়া হলো।



(---আলতাফ মাহমুদ ---)

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।"
মহান একুশের গান। একটি জাতিসত্তার সঞ্জীবনী শক্তি।
আর এই শক্তির ভিত্তি গড়বেন বলে একজন জন্ম নিয়েছিলেন এই বাংলায়। তিনি আলতাফ মাহমুদ।
একজন ক্ষনজন্মা-প্রবাদ পুরুষ,মহান সুর সৈনিক।
কী আশ্চর্য অমোঘতায়-সঙ্গীতের প্রতি আজন্ম ভালোবাসা,দেশের প্রতি,মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মাত্র বিশ বছর বয়সেই সৃষ্টি করলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট শ্রদ্ধাঞ্জলীর গান-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।।
যে গানের সুর বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তির সংগ্রামে,আন্দোলিত করে,অনাদি ভবিষ্যৎতেও বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করবে।

শিশুকন্যা শাওন মাহমুদ ও স্ত্রী সারা আরা মাহমুদকে নিয়ে আলতাফ মাহমুদের সংসার তখন ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোডে।
ছোট্ট সংসার হলেও পরিবারটি বৃহৎ, সারা মাহমুদের ভাইবোন ও মা আলতাফ মাহমুদের আপন ভাইবোন ও মায়ের মতো মিশে ছিলেন সেই জীবনে। সবাই মিলে প্রত্যক্ষ করলেন ২৫ মার্চের কালরাত্রির ভয়াবহতা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অসামান্য প্রতিরোধ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপরিমেয় নিষ্ঠুরতা।
এই পটভূমিতে এটা অনিবার্য ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদ সম্পৃক্ত হয়ে যাবেন।
এবার শুধু সঙ্গীত নয়, সক্রিয় যুদ্ধে তিনি হাজির হলেন। আত্মবিলাপী বিনম্রতায় ভিতরে ভিতরে তিনি কাজ করতে শুরু করেন একটি স্বাধীন স্বদেশ, স্বাধীনতার জন্য। সাম্যবাদী ধ্যানধারনা যা আলতাফ মাহমুদের রক্তের মধ্যে মিশে ছিলো তাই তিনি সমাজ বিপ্লব ও স্বাধীনতার ডাকে জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হননি।
কেউ জানতো না-পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে মানুষটি ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
ক্রমে আলতাফ মাহমুদের বাড়িটা একাত্তরের দূর্গ বাড়ি হয়ে ওঠে। সেখানে ঢাকা শহরের একাধিক ছোট ছোট গেরিলা গ্রুপের যোদ্ধারা কেউ কেউ এসে জড়ো হতেন। তাঁরা ঐখানে বসে এ্যাকশনের জন্য আগে-পরে অনেককিছুই আলাপ করে নিতেন। ধীর স্থির আলতাফ মাহমুদ ছিলেন ঐ কেন্দ্রের প্রাণ। সমুদ্রের মৌন নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন।
যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেই যে মুক্তিযুদ্ধের গান লেখা হচ্ছে গাওয়া হচ্ছে-এটা সকলকে জানানো প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি প্রকান্ড বধ্যভূমিতে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন-গলায় গান, হাতে অস্ত্র।
তখন স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র ভালোভাবে চলছিল। রোজ প্রায় একই গান বাজাত। আলতাফ মাহমুদ এ কারণেও নতুন গানের প্রয়োজন অনুভব করতেন।
দূর্গ বাড়িটার জানালা দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যই গান লিখতেন আবদুল লতিফ, সুর দিতেন আলতাফ মাহমুদ। রেকর্ড শেষে গানের পাতা ছিঁড়ে ফেলা হতো। মাঝে মাঝে গানও লিখতেন তিনি কিন্তু গলা খুলে গাইতে পারতেন না।
এভাবেই চলছিল সব।
কিছু কিছু গান তিনি দুবার রেকর্ড করান। প্রথমদিকে আলতাফ মাহমুদের ১২ খানা গানের একটি স্পুল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় একজন ধরা পড়লে তাঁর মৃত্যু হয়। সেই স্পুলটি আর পাওয়া যায় নি। জুলাইয়ের শেষের দিকে তিনি আবার অনেকগুলো গান রেকর্ড করে দুটো বড় স্পুল তিনি স্বাধীন বাঙলা বেতারকেন্দ্রের জন্য পাঠান।
আগস্টের প্রথম থেকে তিনি ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুন-এর সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হোন।
তারপর..
৩০ আগস্ট, ভোর ৫ টায় ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি সৈন্যদল এসে ঘেরাও করে আলতাফ মাহমুদের বাসা।
ধরে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদকে।
এরপর..
আর খুঁজে পাওয়া যায়নি স্বাধীন বাংলাদেশের এক অকুতোভয় বীর সন্তানকে।





(----শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল----)


জুয়েল ক্রিকেটার হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি কেমিক্যাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর পাশাপাশি চলতো ক্রিকেট খেলা। তিনি ছিলেন তখনকার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার। মোহামেডান স্পোর্টিং ও আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। উইকেটকিপার এবং মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমুল খ্যাতিমান। প্রায়ই পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরসহ বিভিন্ন স্থানে খেলতে যেতেন তিনি। সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তার মনে দাগ কাটে। এরপর পাকিস্তান জাতীয় দলে ডাক পেলেও তিনি পাকিস্তানের হয়ে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। মার্চের আগুন জুয়েলকেও দ্রোহী করেছিলো। ঘর ছাড়তে পারছিলেন না মায়ের তীব্র স্নেহের নিগড়ে। সেটা ছিড়লেন ৩১ মে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার ক’দিন আগে মাকে নিজের বাধাই করা একটা ছবি দিয়ে বলেছিলেন. ‘আমি যখন থাকবো না, এই ছবিতেই আমাকে পাবে’।
খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন জুয়েল। ট্রেনিং শেষে ঢাকা কাঁপিয়ে ফেলা গেরিলা দল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর একজন হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন শহীদ জুয়েল । সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের স্মৃতিচারণে জুয়েল চিত্রিত হয়েছেন প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী এবং ঠান্ডা মাথার একজন যোদ্ধা হিসেবে যিনি ক্রিকেট ব্যাটের মতোই সাবলীলভাবেই অস্ত্র চালাতে পারতেন। ঢাকায় বেশ ক’টি অপারেশনে অংশ নিয়েছেন জুয়েল।
জুয়েল ছিলেন বেশ হাস্যরসিক এবং প্রাণবন্ত, তিনি সবসময় তার বন্ধুদের মাতিয়ে রাখতেন। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের সময় বোমা ফেটে ডান হাতের আঙ্গুলগুলোতে মারাত্মক আঘাত পান তিনি, এতে তার মনে হতাশা জাগে, আর হয়ত তিনি ক্রিকেট খেলতে পারবেন না!
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার বড় মগবাজার এলাকায় একটি বাড়িতে হানা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাকে আটক করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হানা দিয়ে জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল ও আজাদের দুই ছোটভাইকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলে যায় এরপর তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ৩১ আগস্টের পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেরাতে পাকিস্তানীদের হাতে আরও ধরা পড়েছিলেন রুমি, বদি, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকে। ধারণা করা হয়, ঐদিনই পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে।



(---আজাদ আলিয়াস মাগফার---)

আজাদের বাবা ইউনুস চৌধুরীর উপর প্রচণ্ড রেগে আছেন সাফিয়া বেগম। টাটা কোম্পানির সাবেক ইঞ্জিনিয়ার ইউনুস চৌধুরী পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী বিজনেস ম্যাগনেট, ফলাফলে অবাধ নারীসঙ্গের চিরাচরিত স্খলনে সংসারে আগুন। শেষমেশ মাথার দিব্যি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেন ইউনুস সাহেব। রাগ পড়ে যেতেই সাফিয়া বেগমের হঠাৎ খেয়াল হল, আজাদকে কি কাজের মেয়েগুলো মনে করে রাতে খাইয়েছে? নাহ, কাউকে দিয়ে আজকাল আর ভরসা নেই। মাছটা ছেলে খুব পছন্দ করে, কিন্তু মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারে না। কি অদ্ভুত কথা দেখো তো…

ভাবতে ভাবতেই আজাদের ঘরে উঁকি দেন তিনি, দেখেন হোম টাস্কের খাতার উপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে ছেলেটা। “আজাদ, খেয়েছিস? ওঠ তো বাবা, একটু খাইয়ে দেই। “ ঘুমের দেশ থেকে উত্তর এল,আরে খেয়েছি তো, এখন ঘুমাতে দাও…

নিশ্চিত হতে পারেন না মা। আজাদের ফুলতোলা প্লেটে ভাত বেড়ে রুই মাছের দুটো টুকরো বাছতে বসেন। মাছ-ভাত সাজিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকে দেয়ালে দুটো বালিশ ঠেস দিয়ে ছেলেকে তুলে বসান,”দেখি বাবা, হাঁ করো তো” । আধো ঘুমের ঘোরে কোনোক্রমে ছেলের হাঁ করা মুখে ভাতের নলা পুরে দেন মা। ভাত গালে ছেলে আবার অতল ঘুমে তলিয়ে যায়। এইভাবে কয়েক গাল ভাত আর এক গেলাস পানি খাইয়ে তৃপ্ত হন মা, প্রশান্তি নেমে আসে তার হৃদয়ে…

মা, আমি এখানে ভালোই আছি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে একা থাকি বলেই কিনা মাঝে মাঝে প্রাণটা কেঁদে ওঠে। ঢাকায় থাকতে তোমার হাতে যে রোজই ভাত খেতাম, তা তো না। কিন্তু এই করাচিতে এসে ভাত জিনিসটা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে না পেয়ে হঠাৎ করেই হাহাকার বোধ হয়। ভাত খেতে অনেক দূরের এক হোটেলে যেতে হয় মা। মন মানে না। এখন মনে হয় তুমি যে ভাত রাঁধতে, তাতে টগবগ টগরবগর বলক ফুটতো, মাড়ের সুন্দর গন্ধ বেরোত, সেই গন্ধটাও কি অসাধারন ছিল। শুধু একটু ভাতের গন্ধ পাবার জন্যও মনটা ব্যাকুল হয় মা। এইখানে যাদের দেখি, কাউকেই আপন মনে হয় না। শুধু মনে হয় আমরা বাঙ্গালীরা এক জাতি, আর ওরা পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুঅলারা আরেক জাতি। মুসলমান হলেই জাতি এক হয় না।

নির্ঘুম রাতজুড়ে মনে মনে কত কথা সাজায় আজাদ। মাকে লিখবে বলে। সকালে তার কিছুই লেখা হয় না। মা যেন কোনভাবেই তার কষ্ট টের না পান,সেজন্য খুব সাবধানে ছোট্ট করে সে চিঠি লেখে। করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে আরও অনেকদিন থাকতে হবে, বিএ –এমএ করতে হবে, এখনই মাকে টেনশনে ফেলা যাবে না।

“চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদরে ছাইড়া দেওয়ার একটা সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন।“

সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পড়া আর্মি ছাটের কাটা চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততধিক ঠাণ্ডা শোনায়,

–আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
–জি।
–ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
–জি!
–আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
–জি।
–তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
–জি?
–সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।

আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি…
গরাদের ওপারে দাড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।

–“মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।“
–“বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…
–বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
–আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।

সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে… এভাবে…

মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না।

ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত আজাদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর একটাবারের জন্যও ভাত মুখে তোলেননি। বেঁচে থাকার জন্য রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও, কিন্তু ভাত না। তার আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি…





(----শহীদ বদিউল আলম বদি ----)


৭১ সালে অবরুদ্ধ ঢাকার নগরবাসীর কাছে আরেক আতঙ্ক ছিল অবাঙালি বিহারিরা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভাষায়, ‘প্রায় প্রায়ই গুজবের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে- মোহাম্মদপুর-মিরপুর থেকে বিহারিরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে এদিকপানে আসবে। একটা তাৎক্ষণিক হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে।’ পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী, বিহারি আর স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের হাতে পুরোপুরি নজরবন্দি অবস্থায় ছিল ঢাকায় থেকে যাওয়া বাঙালিরা। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ- রাত নামলেই ব্ল্যাকআউট, কারফিউ আর বাড়ির দরজায় আতঙ্কজনক কড়ানাড়া, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। এমন এক অবরুদ্ধ, অন্ধকার, আতঙ্কের নগরীতে একরাশ আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একদল মুক্তিপাগল মেধাবী তরুণ বাঙালি। তাঁদের দলের নাম ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। বদি, রুমী, জুয়েল, স্বপন, কামাল, আজাদ, আলম, আলতাফ মাহমুদ সহ … একঝাঁক আলকোজ্জল মানুষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুন। তাঁদের কেউ নামকরা ছাত্র, কেউ সুরকার, কেউ খেলোয়াড়।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের (ক্যাডেট নম্বর ১৬৪) ছাত্র ছিলেন বদিউল আলম। ঢাকার ৫৭, মনিপুরি পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল বারী ও রওশন আরা বেগম এর বড় ছেলে ছিলেন তিনি। গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা ছিলো তার। এই নেশা অবশ্য পরীক্ষায় তার ভাল ফল অর্জনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগের মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পান, কিন্তু যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মনস্থির করেন। শুরুতে মা রওশন আরা খানম কিছুটা আপত্তি করেছিলেন। তখন বাবা আবদুল বারী সাহেব তাঁকে বলেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।’ বদির মা আর আপত্তি করেননি। মেধাবী ছাত্র বদি অল্পদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্ক। পাকি’দের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম ওঠে বদির। তাঁদের ঢাকার বাসাটি গোলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বদিউল আলম ‘বদি’ নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য এ পরিচিতি পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের অনুসারী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর সাথে তাঁর জড়িয়ে পড়ার কারণে। মুক্তিসংগ্রাম শুরুর সাথে সাথেই দেশমায়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলে তিনি ২৮ মার্চ তার নিজ এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিলো- সেখানকার ডাকাতদের সংগঠিত করে তাদের অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। ওই সময়ে গফরগাঁও থানা (যা শহীদ বদিউল আলমের নিজের বাড়ির এলাকা) ‘ডাকাতদের এলাকা’ বলে সাধারণ মানুষের মুখে কুখ্যাত ছিলো।
গফরগাঁওয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্র মাসুদ ওমর, শহীদুল্লাহ খান বাদল ও আসফাকুস সামাদ (১ম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেছিলেন এবং রংপুর জেলার জয়মনিরহাট স্থানে সম্মূখ সমরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি শাহাদাত বরণ করেন)। শহীদ বদিউল আলম ছাড়া বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন।
মধ্য এপ্রিলে বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে দু’তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সময়েও অদম্য বদিউল ও বন্ধু হেলাল থেমে থাকেননি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে তারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা অপারেশন ও অস্ত্র লুট করা। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র শক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন।
এর পরে তারা দুজনে ঢাকার উদ্দেশ্যে বদিউলের নানার বাড়ি পাকুন্দিয়ায় গেলে হেলালকে বদিউলের মা বলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করবো।’




( ----শহীদ শাফী ইমাম রুমী----)

১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ এক চিকিৎসক তাঁর তত্ত্বাবধানে সদ্য ভূমিষ্ঠ এক শিশু সম্পর্কে তার মাকে বলেছিলেন, ‘এটা ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পরে ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।’ সেদিনের সেই শিশু ১৯৭১ সালে তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী ও প্রাণবন্ত তরুণটির জীবনে ডাক্তারের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের পথেই ছিল। স্টার মার্কস নিয়ে ১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে ভর্তি হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তার ভর্তি সম্পন্ন হয়। সেপ্টেম্বর ’৭১ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিশ্চিত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে সে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় স্বাধীনতার বেদিমূলে।

শরিফুল আলম ইমাম আহমেদ এবং জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমী বাবা-মায়ের সুযোগ্য পরিচালনায় হয়ে ওঠে স্পষ্টভাষী, সাহসী এবং দৃঢ়চিত্তের অধিকারী— এককথায় তারুণ্যের প্রতীকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রস্ফুটিত হতে থাকে। রুমীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা, অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পরিপক্বতা ও নির্ভীক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার, মেজর, ক্যাপ্টেনসহ সবার প্রশংসনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের অসংখ্য দেশপ্রেমী তরুণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তরুণ গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাত। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিকামী তরুণ গেরিলা দলের হাতে বহুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। সা ক্র্যাক প্লাটুনের একজন দৃঢ়চেতা যোদ্ধা ছিলেন শহীদ শাফী ইমাম রুমি ।
১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রুমি। আদমজী স্কুল এ- কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি। তারপর ১৯৭১‌ সালের মার্চ মাসে রুমী ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। তিনি ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর আদর্শগত কারণে দেশকে যুদ্ধের মধ্যে রেখে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য পড়তে যাননি।
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মা(জাহানারা ইমাম) কে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয় এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য।


১৯৭১ সালের ২৯ অগাস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, রুমি সহ বাসায় উপস্থিত সকল পুরুষদের সেই রাতে কনিকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। পরে আটক অবস্থায় নির্মম নির্যাতন করা হয় রুমিসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য গেরিলাদের উপর। আটকের একদিন পরেই রুমি নিখোঁজ হন। ধারণা করা হয় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে।



(---- শহীদ আবু বকর ----)

মেধাবী ছাত্র হিসেবে বকরের বেশ সুনাম ছিলো । শহীদ বকর সৈয়দপুর হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন । একাত্তরে তৎকালীন কায়েদ-ই-আযম (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ) কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করে বিএসসিতে ভর্তি হয় । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে যোগদানের অপেক্ষাতেও ছিলেন । ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্থানী মিলিটারি কর্তৃক নিরীহ বাঙালীর উপর সংগঠিত ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার ঘটনার সাক্ষী হবার পর সবকিছু পাল্টে যায় । ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর বকর তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে দেখে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের নির্মম নির্দশণ । সেই থেকে ১৮ বছরের বয়সী বকর ভেতরে ভেতরে পুড়ছিলো এবং একটি কথাই তাঁর মন থেকে উঠে আসছিলো – এভাবে বেঁচে থাকা যায় না ।



১৯৭১ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানী আর্মীরা ঢাকার বিভিন্ন বাড়ীতে হানা দেয়, ঢাকার অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্যদের জন্য ত্রাস হয়ে আবির্ভূত হওয়া ক্র্যাক-প্লাটুনের গেরিলা সদস্যদের পাকড়াও করাই ছিলো সেই অভিযানের মূল লক্ষ্য । ২৯ তারিখ বেলা এগারটা থেকে শুরু হয়ে পরের দিন ৩০ আগস্ট ভোর পর্যন্ত চলে সেই অভিযান, ধরা পড়ে অনেকেই, অনেক’কেই আবার পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়




( ----শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান----)

খুব অপরিচিত একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম । তাঁকে জানে - সেই সংখ্যাটা খুব সীমিত । সেদিনের ত্রিশোর্ধ্ব এ্রই সূর্য সন্তান ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট দেশমাতৃকার ঋণ শুধতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে- একদিন একটি লাল-সবুজের পতাকা বাংলার আকাশে স্বগৌরবে উড়বে। যন্ত্রবাদক পরিচয়টি তখন খ্যাতি হয়ে তাঁর দুয়ারে এসে ঠাই করে নেবার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করছে, রেডিও-টেলিভিশনে যাঁর নামটি তখন অনেক বেশি অর্থবহ- সেই তিনি যখন দেখলেন পাকিস্থানী হায়নাদের বর্বরতায় রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে, যে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বাদ্যযন্ত্র, হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র ।
আজ ২৮ শে নভেম্বর, তাঁর ৭৭ তম জন্মবার্ষিকী, ১৯৩৮ সালে আজকের এই দিনে খুলনার মুন্সীপাড়া সেকেন্ড লেনে অবস্থিত নানাবাড়িতে শহীদ হাফিজ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা- সৈয়দ আবদুর রহমান ও মা- মোস্তারিয়া খাতুন এর আট ছেলে ও তিন মেয়ের মাঝে শহীদ হাফিজ ছিলেন তৃতীয় সন্তান। শহীদ হাফিজের পৈত্রিক নিবাস যশোরে, পোস্ট অফিস পাড়ায় ছিলো তাঁদের বাসা এবং তাঁর বেড়ে ওঠাও সেখানেই।
ছোট বেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল আর্কষণ, যে বাদ্যযন্ত্রই তিনি হাতে নিতেন তাই যেন তাঁর পোষ মেনে নিতো, বাঁজাতে পারতেন না এমন কোন বাদ্যযন্ত্রের নাম বলাটা বেশ কঠিন, সেতার, তবলা, হারমনিয়াম, বেহালা, গিটার, বাঁশি - সব কিছুর উপরই যেন তাঁর দখল ছিলো ঈর্ষণীয় । কলেজের গন্ডি পাড়ি দেবার পর গান-বাঁজনার প্রতি প্রবল ঝোঁক তাঁকে পড়াশোনার থেকে বিমুখ করে তুলে, প্রথমে যশোরে নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, তারপর যশোরের পাঠ চুকিয়ে খুলনায় ললিতকলা নামে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা, সেখান থেকে ষাটের দশকের শুরুতে করাচি গমন । তিনি বিখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাহচর্য পেয়েছিলেন করাচিতে, হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় পাত্র । বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের সাথে হাফিজের প্রথম দেখা হয় করাচীতেই, সেই পরিচয়ের সুত্র ধরে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন আলতাফ মাহমুদের অনুরোধে । উর্মী প্রডাকশন - তাঁদেরই যৌথ প্রচেষ্টার ফসল, দুজনের যুগলবন্দী এতটাই ঘনিষ্ট ছিলো যে - লোকে হাফিজকে বলতো আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী ।
২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর ভয়াবহতা হাফিজকে ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিলো, আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যশোরে পাকিস্থানী মিলিটারি কর্তৃক বাবাকে হত্যার খবর হাফিজের মনোজগতকে উলটপালট করে দিয়েছিলো, দেশকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে করেছিলো সংকল্পবদ্ধ ।


তাঁরা আসে চুপিচুপি। প্রাণের স্বাধীন বাংলায়। কাঁদতে চায় হয়তো, ফিরতে চায় । আসে তাঁরা গভীর রাতে হয়তো জোনাকির বেশে, শঙ্খ চিলের দেশে, মুগ্ধতায় হেসে।
বাংলার কোল জুড়ে এসেছিলো তাঁরা ধ্রুব তারার মতো। তাঁরা হারায় না। বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান গুলো থাকে মনের চিলেকোঠায়।
শেষ রাতের স্বপ্নে ধরা দেয় তার ছেঁড়া ক্র্যাকের দলের।

বাংলার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, ঘ্রাণে, স্পন্দনে থাকবেন চিরদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো তাঁদের প্রতি।


তথ্য এবং ছবি কৃতজ্ঞতা - রাশেদ রনি, রাহমান রাআদ, শাওন মাহমুদ, ক্লাব অবসকিওর, গেরিলা ১৯৭১।



সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৫১
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×