লংকান এয়ার হোস্টেস এর আগে কখনো দেখিনি, যেহেতু এটাই আমার প্রথম কোন শ্রীলংকান প্লেনে ভ্রমণ, তাই তাহাদের সাথে এটাই আমার প্রথম সাক্ষাত। বেশ মায়াময় চেহারা এদের। নমস্কার করে স্বাগত জানাল, নীল শাড়ি পরিহিতা সবাই, উপরের দিকে চিকন করে কুচি দেয়া শাড়ি, মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই এমন নিচু করে শাড়ি পরা যাতে পেট দেখা যায়, তবে তা মেদ বহুল হোক বা স্লিম তাতে তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের। শ্যাম বর্ণের মেয়েগুলো অনেকটা আমাদের দেশের মতই গড়ন। তবে এরা ভালই লম্বা চওড়া, এদের নিয়ে আপাতত আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। আগামী তিন ঘণ্টা আকাশে কেমনে উড়ে যাব সেটাই আমার ভাবনার একান্ত বিষয়।
বিমান যাত্রা কখনোই খুব একটা ভাল লাগার অনুভূতি দেয় না। তারপরেও কেমন জানি একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করে। এয়ারপোর্ট যাবার চার পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকেই আমার গলা শুকিয়ে যায়, একটু পর পর পানি খাই। পায়চারি করি। তারপরও আমার ইতস্তত ভাব কমে না। অকারনেই ঘামতে থাকি। অযথাই এক হাহাকারের কাঁথা বালিশে জড়িয়ে যাই।
টিকেট করার সময় আমার বেশ ভাল লাগে, এই ভাল লাগা অন্যরকম। তখন কেবল এইটাই ভাবি মাত্রতো কয়েক ঘণ্টা পট করে চলে যাব কিছু বোঝার আগেই। কিন্তু আমার এই পট করে চলে যাবার ব্যাপারটা যাত্রার দিন বেশ ঝট করেই আতঙ্কে বদলে যায়। আমার কেবল মনে হতে থাকে ইশ না গেলে কি হত, প্লেনের টিকেট টা না কাটলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত।
অগত্যা আমাকে যেতেই হবে। প্লেন সম্পর্কে আমার বিরাট গবেষণা করা আছে আগে থেকেই। কোন প্লেন কেমন, ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসে সিট কেমন। কি সুবিধা ইত্যকার যাবতীয় বিষয় আমি সুযোগ পেলেই অনলাইনে বসে বসে দেখি। অনেকটা নেশার মত। যে এয়ারপোর্টে যাব সেটাও দেখি ইউটিউবে। কোন ধরনের এয়ারক্রাফট সেটা না জেনে আমি কখনোই টিকেট করিনা।
এবারের যাত্রা কলকাতা থেকে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বো, মিহিন লংকা’র একটি ফ্লাইট এয়ারক্রাফট এয়ারবাস এ ৩১৯, স্বল্প যাত্রার ছোট প্লেন। এসব প্লেনে সুযোগ সুবিধা একটু কম থাকে, যেমন সিটের সামনে কোন মনিটর থাকেনা, সিট গুলো একটু সরু হয়, খাবার ও অনেকটা না দিলেই নয় এমন। ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচ কামড় দিলে মুখ হিম হয়ে যায়, তবে নেহাত মন্দ না। খাবারের স্বাদ বুঝতে হলে এক কামড় পেটের মধ্যে চলে যাবার পর ধীরে ধীরে স্বাদের উদয় হয়। তখন বোঝা যায় কেমন টেস্ট।
মিহিন লংকায় এটাই আমার প্রথম যাত্রা, এর আগে এই প্লেনের অভিজ্ঞতা বলতে আমার বন্ধু লিমানের কাছ থেকে শোনা। ও গিয়েছিল কলম্বো, তার অনুভূতি বেশ ভীতিকর যা আগে থেকেই আমাকে মোটামুটি কাহিল করে রেখেছে। গেট থেকে কল আসল বোর্ডিং এর জন্য, এয়ারপোর্টের এসির মধ্যে বসে থেকেও আমি কেমন যেন ঘামছি। অগত্যা এখন তো বিমানে উঠাই লাগবে।
ফ্লাইট ১০ টা ৫৫ তে, টারমাক থেকে প্লেনটা রানওয়েতে নিয়ে আসা হল, উইংস্প্যান গুলো হালকা দুলছে, এ দৃশ্য দেখতে ভালই লাগে, তিন ঘণ্টার ফ্লাইট। প্লেন যাবে ইন্ডিয়ার বঙ্গোপসাগর উপকুল ঘেসে, রুট ম্যাপ তাই বলছে। আমার সিট জানালার পাশে। এক সময় জানালার পাশে বসা নিয়ে অনেক উৎসাহ কাজ করত এখন পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। ধীরে ধীরে প্লেন টা এগোতে শুরু করল। টেকঅফ রানওয়ের দিকে।
আমার ঠিক পাশের যাত্রী অনেকটা দেখতে কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের মত, উনাকে মোটামুটি তার আপন ভাই বলে চালিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসে। ভদ্রলোক বেশ পরিপাটি সাফারি পরে এসেছেন। উনি অনবরত তার ফোন ব্যবহার করে যাচ্ছেন বিপত্তি টা বাধল যখন এয়ার হোস্টেস তাকে এসে বলল এটা অফ করার জন্য। কেন তাকে অনেক নরম ভাবে প্লিজ বলে রিকুয়েস্ট করা হলনা এইটাই তার ইগোতে বেশ জোরেসোরে আঘাত করল, আঘাত এমনই জ্বালাময়ী যে উনাকে ঠাণ্ডা করা যাচ্ছেনা, যাই হোক বেশ কিছু সময় পরে উনি ঠাণ্ডা হলেন। কিছু মানুষ থাকে যারা হঠাত করে জাতে উঠে যায়, কিন্তু স্বভাব তো বদলায় না। এরা সব জায়গায় আগাছার মতই ব্যবহার করে। উনাকেও আমার তাই মনে হল। প্রথমে যতটা ভদ্র মনে হচ্ছিল এখন ঠিক ততটাই ক্ষ্যাত মনে হচ্ছে।
পাইলট উইংস্প্যান এর ইনবোর্ড আউট বোর্ড ফ্ল্যাপ আপ ডাউন চেক করে আস্তে আস্তে স্পিড বাড়াতে লাগলেন। এখনতো আমার হৃৎপিণ্ড উপর থেকে তলপেটে আসা যাওয়া শুরু করে দিচ্ছে। স্পিড এখন সর্বোচ্চ যাস্ট টেক অফ, আমার নিঃশ্বাস চেপে গিয়েছে সিট শক্ত করে ধরে বসে আছি, অনেকের কাছে এটা বেশ রোমাঞ্চকর, আর আমার কাছে উফ কেমন যে নিজেও জানিনা। কান যথারীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে প্লেন উপরে উঠছে। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে সমান্তরাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এখন কিছুটা স্বস্থি। তারপরও ভেতরে ভেতরে দোয়া কালাম পরছি। মুখে স্বাভাবিক ভাব ভঙ্গি থাকলেও ভেতর তা মোটেও স্বাভাবিক না। প্লেন মসৃণ ভাবেই উড়ে যাচ্ছে। মাঝখানে কেবল নামার আধাঘণ্টা আগে কিছুটা এয়ার বাম্পিং হল, কিছুটা স্লো ড্রপ, এইটাই আমার হার্ট এট্যাক করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা, কোন রকমে হার্ট রক্ষা পেল। আমার মনে হয় ত্রিরিশ সেকেন্ডের বেশি এমন হলে আমি নাই। প্লেন ধীরে ধীরে নিচে নামছে, এই সময়টা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর সময়, আহা মাটি, এই মাটি যে আমার কত প্রিয় তা আমি প্রতিটা ল্যান্ডিং এর আগে টের পাই।
প্লেন তিন হাজার ফিট- নিচে সাগর দেখা যাচ্ছে আর হাজার হাজার গাছ, এত সুন্দর দৃশ্য আমি এর আগে কোন ল্যান্ডিং এর সময় দেখিনি। শ্রীলংকার এয়ারপোর্ট সাগরের কোল ঘেষেই। অবাক করা ছবির মত সুন্দর। প্লেনটাকে এখন সী-প্লেন বলে মনে হচ্ছে। এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে রানওয়ে স্পর্শ করল প্লেনের চাকা।
যাইহোক শ্রীলংকার বাকি গল্পটা আগামী পর্বে।
১ম ছবিঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৮ রাত ১১:৪০