রেলষ্টেশন আসলেই আমার ডিম মামলেট আর পরোটা খেতে ইচ্ছে করে। এটা হোক ঢাকার কমলাপুর বা কলকাতা দিল্লী বা আমাদের শায়েস্তাগঞ্জ এ ইচ্ছা আমার কখনোই দমে না। অদম্য ইচ্ছে ষ্টেশনে এলেই জেগে উঠে, মনে হয় জীবনেও খাইনি এমন একটা ভাব।
মোবাইলে সময় দেখি অযথাই, জানি ট্রেনের অনেক দেরি আছে এখনো, তবুও ঘড়ি দেখতে ভাল লাগে। সহজাত অভ্যাস। এদিকে পেটের ভেতর মোচড় দেয়া শুরু হয়ে গিয়েছে, নাহ আর মনে হয় বসে থেকে সময় পার করা যাবে না।
আজ রেল ষ্টেশন বেশ নিরিবিলি, সচরাচর এমন হয়না, সব সময় সবার মাঝে কেমন জানি একটা অকারণ ব্যাস্ততা থাকে, চানাচুর ওয়ালা ঝুনঝুনি বাজিয়েই যাচ্ছে, আলো আছে তারপরেও একটা কুপি বাতি জ্বলছে। দেখতে ভালই লাগে।
রাতের ট্রেন এখনো অনেক দেরি।
আমার তেমন কোন তাড়াহুড়ো নেই, ব্যাগ টা পাশে রেখে হেলান দিয়ে বসে আছি, আমি বাড়ি যাচ্ছি কোন প্ল্যান ছিল না যাবার। হঠাত মনে হল যাই অমনি রওনা। এখন আশপাশের মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে সময় পার করতে হবে।
গৃহহীন কিছু মানুষের ঘুমের আয়োজন চলছে এদিক সেদিক, আমি অবাক তাকিয়ে দেখি, কতগুলো সারের বস্তা আর চট দিয়ে মুড়িয়ে মোটামুটি একটা বালিশ বানানো হয়েছে। মানুষ দুজন, বয়স আর কত হবে আন্দাজ করলাম খুব বেশি হলে ১২/১৪ বছর হবে। বালিশ তৈরি, বিছানা সেতো ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, কিছু খবরের কাগজ, আমি ভাবছি দুজন কিভাবে একটা বালিশে ঘুমাবে, কিছুটা অবাক হলাম, দেখি দু জন দুদিকে পা দিয়ে শুয়ে পড়ল, কি সরল একটা সমাধান।
একটু পরেই কিঞ্চিৎ নাক ডাকার শব্দ, বোঝাই যাচ্ছে নির্ভাবনার ঘুম। আমার চোখে ঘুম নেই, এ শহরে হাজারো মানুষের চোখে ঘুম নেই, অথচ কত আরামের বিছানা বালিশ আছে।
মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে বসে খেতে মন চায় না, তাই দুটা পরটা আর দুটা ডিম গরম গরম নিয়ে বেশ আয়েশে আগের জায়গায় ফিরে এলাম, ঘ্রাণ টা দারুণ লাগে, এত গরম যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না তবুও একটু একটু ফু দিচ্ছি আমার ডিম পরোটা রোল এ।
বড় কামড় দেয়া যাচ্ছেনা,
তারপর ও হা টা মোটামুটি হাঙ্গর টাইপ হয়ে যাচ্ছে।
পাশের প্ল্যাটফর্মে আবছা আলো, কথা শুনে মনে হল মা আর ছেলে,তাদের কথা কিছুটা শোনা যাচ্ছেঃ
মাগো খাইছো, নারে বাবা দুফুরে রুডি খাইছি ডাইল দিয়া, অহন তো পানি দিয়া খাওন লাগবো।
রুডি ডা শক্ত লাগে।
ছেলেটার মুখে কথা নেই, একটু পরে মাগো আইজকা তো যে টেহা পাইছি হেইডা ধার শোধ দিছি, সহালে ভাত আনুম, চিন্তা কইরো না। মন ভোলানো এ শান্তনায় ছেলেটার মন মানে না সারারাত মা না খেয়ে থাকবে।
আবার উঠে যায়, আশে পাশের খাবারের দোকান গুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে, কিছু চায়ের স্টল খোলা আছে। অসহায় সে মুখের ভাষা অনেক করুণ, আমি চেয়ে থাকি, খালি হাতে ছেলেটা ফিরে আসছে বেশ ধীর পায়ে, মায়ের জন্য ভালবাসা আর নিজের অপারগায় সে অনেক ক্লান্ত।
একটু ভাতের আশা, একটা নরম রুটির আশা, কতটুকু বেশি চাওয়া, আমি অসহায় হয়ে বসে আছি, আমার খাওয়া থেমে গেছে, পাশ দিয়ে যাবার সময় তার বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার শব্দটা আমার নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
ক্ষুধার্ত মা আধো ঘুমে, রাজ্যের হতাশা নিয়ে ছেলেটা বসে থাকে মায়ের পাশে।
কারো মুখে কথা নেই, আমার আর শক্তি নেই এর পর চুপ করে এসব দেখার, উঠে গেলাম রেল লাইনটা পার হয়ে, কোন কথা না বলে ছেলেটার হাতে দুটা পরোটাই ধরিয়ে দিলাম, সে মায়ের ক্ষুধার্ত মুখ দেখার সাহস আমার হয়নি।
অবাক ছেলেটার চেহারা্ পেছনে ফেলে আমি চলে আসি, চুপ করে হেলান দিয়ে বসে থাকি, কোন কিছু ভাবতে চাইনা, আমার চোখের কোণে একটু অশ্রু, চাইনা এ পৃথিবী দেখুক।
কেন জানি আবারো পেছনে তাকাই, আবছা আলোয় দেখা যায় দু হাত তুলে সে মায়ের দোয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:০২