ছবিঃ হেলাইন, আমার হোস্টেলের পাশের নদী।
অক্টোবর ২০০৯ শীতের এক দুপুরে, কাতার এয়ারয়েজের প্লেনটা ধীরে ধীরে ইউরোপের মাটি স্পর্শ করল, আহ স্বপ্নের ইউরোপ। কতকাল এ স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরেছি তার কোন কুল কিনারা ছিলোনা। প্রায় প্রতিদিন যেতে হত বনশ্রী থেকে মতিঝিল দৈনিক বাংলার মোড়ে, হাসান ভাইয়ের অফিসে। শুধু ভাবতাম কবে যে মুক্তি পাব এই যানজটের ঢাকা থেকে। কখনো ভাবিনি সত্যি সত্যি এভাবে চলে আসব ইউরোপে। স্বপ্নই দেখে গিয়েছি আর চেষ্টা বহুবার। যে আমার ঠিকমত খাবার পরার টাকা থাকত না সে আমি আজ ইউরোপের মাটিতে পদার্পণ করছি। আমার অনুভূতি কাজ করছে না, কেমন জানি লাগছে, অবাক করা বিষয় হলেও কেন জানি খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। ভিয়েনা এয়ারপোর্ট। অনেক সুন্দর, অনেক ব্যাস্ত একটা এয়ারপোর্ট, বেশ অনেকক্ষণ লাগল ইমিগ্রেশনে পৌঁছাতে। ইমিগ্রেশনে কোন ঝামেলা হয়নি এক নিমিষেই সব ফরমালিটিস শেষ।
আমাদের এখন যেতে হবে সালজবুরগ (Salzburg) অন্য একটা শহর, ভিয়েনা থেকে আড়াই ঘণ্টার ট্রেন। নতুন দেশ ভাষাও বুঝিনা, এখানে জার্মান ভাষা চলে, ভাগ্যক্রমে রবিনের এক দুলাভাই দূর সম্পর্কের উনি এসেছিলেন আমাদের একটু হেল্প করতে। যাক এ অর্থে আমাদের অনেকটাই যাবার ব্যাপারটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে হয়েছে আরেক ঝামেলা এত ঠাণ্ডা কল্পনাও করিনি, অগত্যা লাগেজ খুলতে হল শীতের কাপড় বের করলাম সবাই।
ছবিঃ হোস্টেলের পেছনের রাস্তা।
এখন যেতে হবে ভিয়েনা ট্রেন ষ্টেশনে, ভিয়েনা অসম্ভব সুন্দর গোছানো একটা শহর, পুরনো ইউরোপিয়ান ধাঁচের বিল্ডিং গুলো অনেক চমৎকার, নানান ব্রান্ডের শপ গুলো কি যে সুন্দর স্ট্রাকচার, আমি অবাক চোখে দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। দেখতে দেখতেই আমাদের যাত্রা শেষ, বাসে খুব বেশি সময় লাগেনি, ছয় ইউরো ভাড়া। অনেক হাইফাই বাস, নির্বিঘ্নে ষ্টেশনে চলে এলাম, রবিন আর লেনিন ভাই গেল টিকেট করতে। ট্রেনের এখনো আধাঘণ্টা বাকি।
বারবার দেশের কথা মনে পড়ছে, সবাই কেমন জানি একটু বিদ্ধস্থ মনে অপেক্ষা করছি, আমাদের ট্রেন চলে এসেছে নাম রেইলজেট, ট্রেন এসেছে বুদাপেস্ট থেকে যাবে একদম সুইজারল্যান্ডের জুরিখ পর্যন্ত, মাঝখানে আমাদের গন্তব্য সালজবুরগ। ট্রেন যাত্রা ইউরোপে অনেক আরামদায়ক, কোন হকারের ঝামেলা নেই, কোথাও এতটুকু অপরিচ্ছন্নতা নেই, নেই কোন শব্দ, মসৃণ গতিতে ট্রেন চলছে, এত স্পীডে কখনো কোন ট্রেনে আগে ভ্রমণ হয়নি। ভেতরে স্ক্রিনে নাম উঠছে কোন ষ্টেশন সিরিয়ালি, স্পীড ও দেখাচ্ছে, আমাদের দেশের ট্রেন যেখানে ৭০/৮০ কিলোমিটার স্পীডে যায় সেখানে এই ট্রেন দেখি চলতে শুরু্র একটু পরেই একশ কিলো স্পীডে শহর ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছে ট্রেন, স্পীড কেবল বাড়ছেই ১২০/১৪০/২০০/২৫০ আমি তো মোটামুটি হা, আড়াইশ কিলোমিটার পার আওয়ার স্পীডে যাচ্ছে ট্রেন, আশপাশে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। ব্যাপক রোমাঞ্চ লাগছে আমার কাছে। পুরোটা রাস্তা এতটা স্পীডে যায়নি অবশ্য, কান্ট্রি সাইড গুলো যে কি সুন্দর ছোট ছোট বাড়ি সব বাড়ির পাশ জুড়ে কি চমৎকার বাগান, নানান রঙের ফুলে ফুলে ভরপুর। শীতের শুরুর সময়, এখনো চারপাশে অনেক সবুজ আর সবুজ ঘাসের কার্পেট এ মোড়া মনে হচ্ছে উচু নিচু পাহাড় গুলো। লাল টালি দিয়ে বাড়ির ছাদগুলো তৈরি। বিস্তৃত আংগুর বাগান, আমি এর আগে কখনো আঙ্গুর বাগান দেখিনি, কি যে ভাল লাগছে, মাইলের পর মাইল এই বাগান।
ছবিঃ আমাদের হোস্টেলে যাবার রাস্তা।
ট্রেন এখন লিনজ ষ্টেশনে, কিছু যাত্রী নেমে গেল, কিছু উঠল, এর ফাকে আমরা হালকা কিছু খেয়ে নিলাম, পেটে ক্ষুদা কিন্তু সবারই খুব একটা খেতে ইচ্ছে করছে না, ক্ষনে ক্ষনে সবারই মন খারাপ হচ্ছে, কেউ তেমন কোন কথা বলছে না। জার্নির একটা ক্লান্ততা তারপর নতুন দেশ সব মিলিয়ে সবাই একটু মনমরা। আর বেশি বাকি নেই ১ ঘণ্টার মত লাগবে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গিয়েছে।
সালজবুরগ পৌঁছে গিয়েছি, সবাই লাগেজ গুলো নিয়ে নামলাম, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে এ যেন মন খারাপের সাথে পাল্লা দিচ্ছে, যাই হোক আমাদের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি, যেতে হবে আরও উনিশ কিলোমিটার দূরে হেলাইন শহরে, ছোট্ট একটা শহর। আবার টিকেট করা লাগল, আধাঘণ্টা লাগবে যেতে, মাঝখানে অনেক ষ্টেশন সব লোকাল। এখান থেকে ছয় সাতটা ষ্টেশন পরেই।
ছবিঃ হেলাইন শহরের আশপাশ।
চার্ট দেখে বোঝা গেল কোন ট্রেন ধরতে হবে। পৌঁছাতে কোন সমস্যা হয়নি। পাথরে বাঁধানো রাস্তা, লাগেজ গুলো টেনে তুলতে মনে হচ্ছিল আর শক্তি নেই, হেলাইন ষ্টেশন থেকে আরও মিনিট পনের হাটার রাস্তা, সোজা হলে তো ভালই ছিল কিন্তু এতো রীতিমত পাহাড় বাওয়া। এর মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তো আছেই। দু একজন কে ঠিকানা দেখালাম তারা কিছুই বোঝেনা ইংলিশ, আমরা মূর্খ না ওরা বুঝলাম না, এটাই হল প্রথম ধাক্কা, আমাদের হোস্টেলের কাছে আগেই বলা ছিল যে আমরা কবে আসব, যদিও অফিস টাইম পার হয়ে গিয়েছে তবে একজন ছিল আমাদের রিসিভ করার জন্য। অবশেষে আমাদের হোস্টেল এর অফিস পেলাম, ভেরি গুড ওয়েলকাম জানাল, ভাল লাগল কিছুটা, তারপর বের হয়ে হোস্টেলে নিয়ে গেল জাস্ট কয়েকটা বাড়ি পরেই, খুবই সুন্দর, ইয়া মোটা দেয়াল, পুরনো দুর্গের মত তিনতলা বাড়ি, তবে দুর্গ হলেও অনেক আধুনিক টাইপ, ঝকঝকে সাদা রং করা দেয়াল, টাইলস গুলো মেরুন কালার, আর সিঁড়ি পুরোটাই পাথরের। আমাদের রুমগুলো দোতলায় দুইটা। রুমের মেঝে ওক কাঠের পালিশ করা। চাবি বুঝিয়ে দিল অফিস অথোরিটি। বলল বাকি কাজ গুলো পেপার ওয়ার্ক কাল করতে হবে।
আহ শেষ পর্যন্ত নিজের রুমে, এখন বেশ শান্তি লাগছে, সবাই কতক্ষন শুয়েবসে বিশ্রাম নিলাম, সবার জন্য সিঙ্গেল বেড, আলমারি আর চেয়ার ও পড়ার টেবিল। লাগেজ খুলে ঘরে পড়ার মত কাপড় গুলো বের করলাম ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হলাম, কারো কাছে তো সিম নেই তাই আপাতত জানানো গেলনা বাসায়, পরের দিন জানাতে হবে, যদিও কাতারে ওয়াই ফাই ছিল তখন বাসায় কথা হয়েছে যে আমরা ঠিক মত আছি, এবং আগেই জানিয়ে রেখেছি যেহেতু জানতাম আমাদের পৌঁছাতে রাত হবে তাই খুব একটা বিচলিত হইনি।
রাতের খাবার বলতে যা কিছু শুকনো খাবার ছিল তাই খেলাম সবাই, পরদিন রান্না বান্নার জিনিস কেনা যাবে। আজ এইদিয়েই সবাই কোন রকম রাত পার করা। এবার ঘুম।
শুরু হল এক নতুন জীবন, জানিনা এরপর কি হবে কি করে আগামী দিন গুলো যাবে, মনের মধ্যে একটাই আশা সবার, যেমনই হোক সব কিছু ভাল হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:২৯