somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে কারনে আমি আত্মহত্যা করছি - ৫ম পর্ব

২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্রাবণ ২৬, ১৪০৮
আগস্ট ১০, ২০০১।

চারদিকে অসন্তোষ, বোমা বারুদ রক্ত। আমরা কি এগিয়ে চলেছি এক অন্ধকার কালে ? গৃহযুদ্ধে কি জড়িয়ে পড়ছে দেশ?

‘কোন মানুষই ভবিষ্যত জানেনা’, এ কথা মিথ্যে। সবাই ভবিষ্যত ভাবে এবং কারও কারও ভাবনা কর্ম হয়ে সফলতা লাভ করে এই নশ্চর জীবনে।

তাহলে আগামীর দিন দেখতে পাচ্ছে কারা?
ভবিষ্যতের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কোন হাতে?

আমার প্রিয়, ‘ডিসকভারি’র দিকে তাকালাম আমি। সেখানে প্রয়াত ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরীর মতো বিশাল বপু নিয়ে কথা বলছেন এক মহিলা। মুখে তার হাসি। চোখে জীবন্ত জীবন। বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসে তাদের পাছা দেখাচ্ছেন তাকে। ‘রিপ্লিজ বিলিভ ইট অর নট’ পরিচালনা করছে অনুষ্ঠানটি।

এই পাছা দেখতে তিনি ৩০/৪০ ডলার নিচ্ছেন। তার এবং অন্য অনেকের ধারনা মানুষের পাছা পড়ে তিনি ভবিষ্যত বলতে পারেন। এতদিন হস্তরেখা পড়ে ভাগ্যগণনার কথা জানতাম, আজ দেখছি পাছা পড়া। মহিলা বললেন যে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কাজটা তিনি করে থাকেন। কোন কোন পাছা পড়া অত্যন্ত সহজ আবার কোন কোন পাছার ভাষা বেশ জটিল, তিনি বললেন।

বই পড়ে টাকা আয় করার চেয়ে পাছা পড়ে টাকা আয় করার মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে। মানুষ অন্যের পাছা পড়ুক আর নিজের পাছা অন্যকে পড়তে দিক। বরং আমার ‘স্বপ্নের খেয়া’ ভালো। কারো কোন গোপন সরোবর দেখবার কায়দা সেখানে নেই।

ভ্রাদ্র ৩১,১৪০৮
সেপ্টম্বর ১৫, ২০০১।

প্রিয় এক লেখকের সাথে দেখা হলো আমার তার বাসায়। কথা হলো, হাসি হলো; ভাবও হলো।

সন্ধ্যার লগ্ন না পেরতে এক ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ককে দেখলাম আমি। তাঁর মায়ের সাথে বৈঠক আমার। নৈশ ভোজে বসলাম আমরা। আমি যে হোটেলটাতে উঠেছি সেটা দরিদ্রতম। স্রেফ ইটের গাঁথুনিতে মোড়া, কোন প্লাস্টার নেই।

আমার জন্যে অনেক আয়োজন করলেন তিনি। আমি দীন দরিদ্র, কি দেব তাকে? হোটেলের ঝাড় লন্ঠনের আলোয় আমি তাকে আমার দেশের দুটো পঞ্চাশ পয়সার মুদ্রা উপহার দিলাম। আমি কপর্দকশূণ্য এবার। আমার কাছে কিছু নেই।
‘আশ্বিন ১০, ১৪০৮
সেপ্টম্বর, ২৫, ২০০১।

আমাদের ছায়াগুলো হারিয়ে যায় তখন। নদীটা তার শীর্ণ শরীর দুঃখে ভরিয়ে এমনি শুয়ে আছে যেন বড় দুঃখ তার! আমি আর সিনথিয়া স্নিগ্ধ বাতাসে বসে থাকি। সমস্ত শহরে নেমেছে জীবনের কোলাহল।

আমি কোলাহল সব দূর থেকে দেখি, ডুবিনা তার অতলে; যেন শুধুই দর্শক, দেখি জীবন। আমরা রেলস্টেশনের দীর্ঘ বাতিটাকে জ্বলতে দেখি। তার আলোয় মানুষের ছায়া কী দীর্ঘ!

আমরা প্লাটফর্মের পথে হাঁটতে দেখি আমাদের ছায়াগুলোকে। ওরা আমদেরকে ছাড়িয়ে দীর্ঘ পথটাকে ছেয়ে থাকে। অবিশ্বাস্য চাঁদের আলোটা তার স্বকীয়তা হারিয়ে বসে আছে। আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে বহুদূর অতিক্রম করুক আমি তা কেমনে চাই!

যখন রেলস্টেশনের আলো অতিক্রম করে নিরবচ্ছিন্ন চাঁদের আলোর গিয়ে পৌঁছায় তখন আমার ছায়াটা আমারই পায়ের তলে এসে আশ্রয় নেয়। এটা ভাল লাগে আমার।

জীবনের দুঃখ আর সুখগুলোকে হাতে হাতে নিয়ে পথের পরে চলি আমরা। চারদিকে বিস্ময়কর আলো, মানুষের আনাগোনা এবং লাল ফুলে ভরে থাকা শিমুলের গাছ। ও জীবন! আমি তোমার একনিষ্ঠ অনুরাগী।

পোড়া গন্ধ পেয়ে রান্না ঘরে ঢুকলাম আমি। নাহ, ভেস্তে গেল। তা যাক। খেয়ে দেয়ে সূর্যোদয় দেখব। আর তারপর মায়ের সাথে ঘুরব আজ দিনভর। সুন্দরী সিনথিয়া যে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আমার জন্য।

আশ্বিন ১৪,১৪০৮
সেপ্টম্বর ২৯, ২০০১।

এক সামরিক সরকারের উথান হলো। ঘটনাগুলো ঘটলো যেমন ঘটে। আমার প্রতিবাদের শক্তি ছিল না। আর প্রতিবাদের আছেই বা কী !

সব পোশাকের একই কাজ, সব শাসকের একই ছদ্মবেশ।
মুক্তি নেই মুক্তি নেই! মুক্তি কোথায় বন্ধু?
না, ‘স্বপ্নের খেয়া’ আর নয়। এরপর সব ভয়াবহ আর বিকৃত স্বপ্ন। কে যেন বলেছিল, স্বপ্নেই যদি খাব তাহলে জিলিপি খাব কেন, খাব রসগোল্লা।

আমি স্বপ্ন বাদ দিয়ে বাস্তবের তৈল চিত্রটা দেখি একবার। ভাত খেতে আয়োজন শুরু করলাম এবার। ‘ডিসকভারি’ একটা সাপের ওপর বক্তৃতা করছে।

খেয়ে দেয়ে ফোন করলাম কিন্তু পেলাম না মা-কে। ঘড়ির কাটা সাড়ে চারটের কথা বলল।

আমি গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ছুটলাম তার ফ্লাটের দিকে। অসম্ভব স্বপ্নে ও কল্পনায় নিজেকে রাঙিয়ে তার ফ্লাটের ঘন্টা বাজালাম আমি। পঞ্চম বার বেল বেজে উঠলে দরজা খোলার শব্দ হলো। তিনি অর্ধনগ্ন। কন্ঠ তার মাদকে আসক্ত। ‘হাই ডালিং’, বললেন তিনি। ভিতরে একজন নগ্ন পুরুষ ছুটে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। রঙমাখা স্বপ্নেরা চুনকালি মেখে গাধার পিঠে চড়ে বসল। আমি দ্রুত পায়ে নিচে নামলাম। গাড়ি নিলাম না, ওটা আর কখনো কাজে আসবে না আমার।

তার কন্ঠ অবিরাম ডাকল আমায়। বোঝাল যে ‘আমি তার হৃদয়ের ধন’। আমি পিছু ফিরলাম না। স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে, কিছুতেই তাকালাম না। ভেঙে পড়া গাছের মতো অবলম্বনহীন আমি পদাঘাত করে এগিয়ে চলেছি জেগে ওঠা শহরের পথে । চলতে চলতে মনে পড়ছে আমার প্রিয় একজন কবির একটা কবিতা -


যখন আমি সবার কাছে
ভ্রান্ত মাথা, হীনতম উপেক্ষিত
ঘৃণিত যেন দুষিত জমি
যে ফলায় শুধু তীব্র বিষ
আফিম পপি!
তখন জীবন
কোথায় সকল স্বপ্নভূমি,
ফলাবে বলে ভেবেছিলে
যেখানে তুমি শস্যভরা পূর্ণ জমি?

সাধারণ অর্থে মানব জীবনের ওপর এবং বিশেষ অর্থে নিজের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এসে ভর করল আবার। হতাশারা বিশাল কোন এনাকোন্ডার মতো পাঁকে পাঁকে পেঁচিয়ে ফেলল আমার সমস্ত চেতনা। কিছুক্ষণ আগে যা কিছু ছিলো বাঁচবার অনুপ্রেরণা এখন তাই হয়ে উঠছে আমার আত্মহত্যার উৎসাহদাতা।

চলতে চলতে থমকে দাড়াই আমি। একেবারে অকস্মাৎ যুক্তির তরী ভিড়ল মনের ঘাটে। নিছক নিজের আবেগের দাস হয়ে মরাটা কোন কাজের কথা নয়। কত কাজ করার আছে এই পৃথিবীতে। এখন তো আমি বয়প্রাপ্ত মানুষ। মা বাবা বা আত্মীয় স্বজন যার যেভাবে ইচ্ছা জীবন যাপন করুক। যার যার জীবন তার তার। আমি তো এমন অনেক কাজ করতে পারি যাতে ভালো হতে পারে অন্য মানুষের। অন্তত আমার টাকা-পয়সা বা ফ্লাটটা কোন ভালো কাজে দিয়েও তো আমি আত্মহত্যা করতে পারি। আত্মহত্যার সুযোগ তো সারা জীবনের, তা তো আর হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে না। আমি আবার আমার মত বদলালাম।

ভোরের আযানের শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে জেগে উঠতে থাকা পৃথিবীর পরে। আমি স্বস্তি পেতে বসে পড়লাম রাস্তার ধারের একটা বেঞ্চে। হঠাৎ আমার বুড়ো নানা কোথা থেকে যেন হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। বসল আমার পাশে। বলল, চলো নানাভাই, নামাজ পড়ে আসি।

এখন মসজিদ খুঁজছি আমি, আমাদের মহল্লা থেকে বেশ দূরে এসে পড়েছি। এখান থেকে কোন মসজিদটা কাছে আমার জানা নেই। নিজের ফ্লাটের দিকে তাই হাটার সিদ্ধান্ত নিলাম। মসজিদও পেয়ে গেলাম দ্রুত। চারদিকের যানবাহন আর মানুষের জেগে ওঠার শব্দে খেয়াল হলো যে নানাভাই আর আমার পাশে নেই। প্রায় বছর দশ আগে তিনি মারা গেছেন। আমার সব কিছু আবার এলোমেলো। নিজের ফ্লাটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটা খালি রিক্সায় উঠে বসলাম আমি।

ঘরে ফিরে আমার অবসাদ যেন বেড়ে গেল। নিজেকে সোজা বিছানায় ছুড়ে দিলাম। কিন্তু না, ঘুমের কোন লক্ষণ নেই। রাত ভর জেগে থাকার পরও ঘুম যেন সোনার হরিণ। মনের মধ্যে ফিরে ফিরে জেগে উঠছে পরকালের কথা। পরকাল নিয়ে ছোট বেলায় ‘বুড়ো বদমাশ’টাকে একবার আমি প্রশ্নের ফাঁদে ফেলেছিলাম। তখন আমি স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ আর ইংরেজি গ্রামার শিখছি। সে আমাকে বলেছিল যে মানুষের জীবনে আছে কেবল দুটো কাল। এর একটা ইহকাল আর অন্যটা পরকাল। ইহকালটা আসলে কিছু না। পরকালই সব। আমি বললাম, নানাভাই! তুমি তো বললে কাল দুই প্রকার কিন্তু স্কুলে পড়াচ্ছে কাল তিন প্রকার। বর্তমান কাল, অতীত কাল ও ভবিষ্যৎ কাল। বুড়োটা তখন কোন উত্তর দিতে পারেনি। এক দিন পর সে তার উত্তর নিয়ে ফিরে এল। বলল, বর্তমান অতীত আর ভবিষ্যৎ ইহকালেরই তিন রূপ। পরকাল এমনই এক কাল যা কোন চোখ দেখেনি কান শোনেনি এবং হৃদয় তা উপলব্ধি করেনি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×