২০০৩ সালের জানুয়ারী ১৬ তারিখ বৃহ:বার। তীব্র শীতে আমি, রুশো, সাইন্স(বন্ধুর নাম) আর সাইন্সের বাপ ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন যোগে রাজশাহী পৌঁছালাম বেলা দুইটা-আড়াইটা নাগাদ। পরের দিন ছিল মেডিক্যাল ভর্তি পরিক্ষা। সাইন্স(বন্ধুর নাম) আর সাইন্সের বাপ মেট্রোপলিটন হোটেলে উঠল। আমি আর রুশো লক্ষিপুর মোড়ে খুঁজতে থাকলাম সল্প খরচের একটা হোটেল।
লক্ষিপুর মোড়ে হোটেল শাপলাতে উঠলাম। জনতা ব্যাংক আর শাপলা হোটেল একই ফ্লোরে হওয়ায় মনে কোন সন্দেহ হয় নাই। চেক ইন করে নীচে গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে ফিরে দুই বন্ধু যার যার মত প্রস্তুতি ঝালাই করতে থাকলাম।
মিনিট দশেক পর রুম ঝাড়ু দিতে এল ১৮-২২ বছর বয়সী সুন্দরী একটা নারী । এত সুন্দরী একটা মেয়ে কেন হোটেলের ঝাড়ুদার তা বুঝতে পারলাম না পেরে আমরা দু’বন্ধু টাসকিত হয়ে পরস্পর জিঙ্গাসু দৃষ্টি বিনিময় করলাম।
সন্ধ্যার পরপরই হোটেল ম্যানেজার রুমে এল। আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কি না খোঁজ খবর নিল। আরো কিছু লাগবে কি না জিঙ্গাসা করল। অন্য কিছু লাগলে নি:সংকচে জানাতে বলল।
আমাদের দুই বন্ধুর আরো কিছু লাগবে কি না তা বুঝতে পারলাম না। তবে রুমের বাহিরে সতত যাতায়াতের শব্দ, রিনিঝিন চুড়ির শব্দ, সকল্লোল সুললতি নারী কন্ঠের হাঁসি ঠাট্রার শব্দ আমাদের পরিক্ষা প্রস্তুতি ঝালাই কাজের মনোযোগে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটাতে থাকল।
সন্ধ্যার আগে রুশো বাথরুম থেকে ফিরে ফিস ফিস করে বলল ”বন্ধু ভুল করে আমরা সম্ভবত কোন মিনি পতিতালয়ে উঠে পড়েছি”। আমি রোমাঞ্চিত হয়ে বললাম কি তাই নাকি? বাথরুমের পাশের রুমটাতে ১০-১২ জন মেয়ে চেয়ারে বসে আছে আর খদ্দরা সেখান থেকে পছন্দ করে নিয়ে বিভিন্ন রুমে যাচ্ছে। রুশোর ষ্টেটমেন্টার সত্যতা নিরুপনের জন্য আমি বাথরুমে গেলাম। ফেরার পথে পাশের রুমের দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম। একদম ক্লিয়ার হয়ে গেলাম। ঘটনা সত্য আমরা এখন হোটেল নামে একটা মিনি পতিতালয়ে!!!
রাত আটটার দিকে দু’বন্ধু রাতের খাবার খেতে নিচে গেলাম। খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিলাম রুমে ডুকার পর আর দরজা খোলা যাবে না। কোনমতে রাতটা পার করে পরিক্ষা দিয়ে ভালোয় ভালোয় ইজ্জত নিয়ে ভাগতে হবে।
একবারে চেক আউট করে বের হব নাকি পরিক্ষা দিয়ে এসে চেক আউট করব সে বিষয়ে কনিফিউশনে পড়লাম। ব্যাগে বই নোটপত্র আর শীতবস্ত্র , পরিক্ষার প্রবেশপত্র এগুলো আমাদের ঢাল। রাতে পুলিশে রেড দিলে এগুলো আমাদের রক্ষা করবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম পরিক্ষা দিয়ে এসে চেক আউট করব।
সার্বিক পরিস্থিতি মোবাইল টু মোবাইল ৫টাকার দোকান থেকে সাইন্সকে জানানো হল। শুনে সেও খুব বিনোদিতো, পুলকিত ও বিষয়টা পর্যবেক্ষনে আগ্রহী হল।
রুমে ফেরার মিনিট পাঁচেক পর বিছানার চাদর বদলাতে আগের মত আরেকটা মেয়ে এল। বিছানার চাদর বদলিয়ে বালিশের কাভার খুলে নিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর আরেকটা মেয়ে বালিশের কাভার এনে বালিশে পড়িয়ে দিয়ে গেল।
কথাশিল্পী রুশো বলল বন্ধু তুমি কি বুঝতে পারছো যে প্রদশনী চলছে । বললাম একদম ক্লিয়ার।
আমরা দু বন্ধু পড়তে শুরু করলাম। মিনিট পনের পর দায়িত্বশীল ও যত্নশীল ম্যানেজার সাহেব আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা তার খোঁজ খবর নিতে এলেন। ধন্যবাদ দিয়ে রুশো তাকে দরজা থেকে বিদায় করে দিলেন।
কখনও পড়ছিলাম, কখনও আলোচনা করছিলাম, কখনও বা সামনের দিন গুলোতে আমাদের সামনে কি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে মৃদু মন্দ আশংকাপূর্ণ আলোচনা আর এ্যাডমিশন ম্যাটেরিয়ালে চোখ বুলাতে বুলাতে রাত বারটা।
দায়িত্বশীল ম্যানেজার আবারও এসে হাজির। দরজা খুলতে বাধ্য হলাম। তিনি এখন ঘুমাতে যাবেন। যাওয়ার আগে মশার কয়েল আছে কিনা চেক করতে এসেছেন। আমাদের কিছু লাগবে কিনা জিঙ্গাসা করলেন। তাছাড়া অন্য কোন সার্ভিস দরকার হলে তা নিঃসংকোচে প্রকাশে লজ্বা করতে নিষেধ করলেন।
কথাশিল্পী রুশো তাদের অন্যকিছু সার্ভিসের বিষয়ে নানা প্রশ্ন করে নিজে ও আমাকে বিনোদিত করল।
রুশো তাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল আসলে আমরা মাসুম বাচ্চা। আপনাদের হোটেলে এমন সার্ভিস আছে এটা জানলে আমরা এ হোটেলে উঠতাম না। আপনার হোটেলে উঠেছিলাম এ কথা রাজশাহীর বন্ধুদের বললে তারা আমাদের অসত কলংকি(অসতী, কলংকিনী) বলবে।
তিনি অতি উত্তম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেন।
কি পরিক্ষা দিতে এসেছি তা জিঙ্গাসা করাতে বুঝিয়ে দিতে হল এ পরিক্ষায় পাশ করলে আমরা ডাক্তারী পড়তে পারব।
শুনেই উনি বুঝতে পারলেন এটা বিরাট বিশাল গুরত্বপূন এক পরিক্ষা।
আগামীকালকের পরিক্ষার জন্য দোয়াপ্রাথর্না পূবর্ক কিছু লাগলে পরে জানাবো বলে বিদায় হতে তাকে সবিশেষ অনুরোধ করা হল।
আমাদের মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করার ফতোয়া দিয়ে উনি ঘুমাতে গেলেন।
উনি চলে যেতেই রুশোকে বললাম এই লোকটার হাত থেকে আজ রাতে সতিত্ব রক্ষা করা কঠিন হবে মনে হচ্ছে।
রুমের সামনের প্যাসেজে ঘনঘন যাতায়াতকারীদের পায়ের শব্দের সাথে তাদের মুখের কিছু শব্দ রিকনসাইল করে আউটপুট হিসাবে আমরা আমাদের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আবিস্কার করলাম। দু’বন্ধু সামান্য আতংকগ্রস্তও হলাম।
রাত আড়াইটার দিকে আবার দরজায় ঠকঠক শব্দ। খাওয়ার পানি এনেছে এক নারী কন্ঠ ।
রুশো বলল পানি আছে আর লাগবে না।
দরজার ও পাশ থেকে একটা অনুনয় শুনলাম দরজাটাতো একটু খুলুন।
ভেতর থেকে বললাম সকালের আগে দরজা খোলা যাবে না।
আজ এ বাদলার দিনে স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল মনের আয়নায়।
এ আমলে যদি বলতাম “সকালের আগে দরজা খোলা যাবে না” আর মানুষটা সেই সুকন্ঠি নারী না হয়ে যদি লাইসেন্সপ্রাপ্ত খুনী বাহিনী হত তাহলে বাহির থেকে ছিটকানী লাগিয়ে দিত। ছিটকানী দেওয়া দরজার মত জীবনের দরজাটাও বন্ধ হয়ে যেত টাস টাস টাস টুস কয়েকটি শব্দে এক অমিংমাসিত প্রশ্ন নিয়ে!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১০:২৩