৫ কি ৬ ক্লাশ বয়েসে, পাবলিক লাইব্রেরির সেল্ফে একটা বই আবিস্কার করি। হাসান আজিজুল হক এর লাল ঘোড়া আমি। প্রচ্ছদের তেজী ঘোড়াটা কেশর নাচিয়ে খুব দাপিয়েছিল সেদিন। ঐ বয়সে হাসান আজিজুল হক নামের মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না, তবে হাশেম খাঁনের (আমি ঠিক নিশ্চিৎ নই, প্রচ্ছদ এবং অলংকরন হাঁশেম খানের ছিল কিনা, তবে অমন মনকাড়া আঁকা আর কারই বা হতে পারে?) জাদুকরী হাত ফসকে টগবগে একটা ঘোড়া আমাকে সওয়ারী করে দৌড়ে ছিল অনেক দিন।
গতো বছর একটা বইয়ের দোকানে একোন-সেকোন অলস তাকাচ্ছি; হঠাৎ দেখি কি সেই লাল ঘোড়াটা! দিব্যি মুখ গুঁজে আছে অনেকগুলো বইয়ের মাঝে! আর পাই কে, ৪০ টাকা দিয়ে লাল ঘোড়াটা বগলদাবা করে নিয়ে আসি, ইচ্ছে; আমার ছেলেটা পড়তে শিখলে ওকেও তুলে দেব ঘোড়াটার পিঠে! ৮৪ সালের পর ৯৮ সালে জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন থেকে বের হয়, তবে সেই প্রচ্ছদ আর অলংকরন মিসিং!
শিশু সাহিত্যে আমারা এতো দরিদ্র অথচ হাসান আজিজুল হকের মতো লেখকও আমাদের আছে। ইস, উনি যদি আরো কিছু লিখতেন ছোটদের জন্য! এই আক্ষেপটা আরো বেড়ে গেলো, যখন এতো বছর পরেও ঔ লাল ঘোড়ার সওয়ার হয়ে আমি ঠিক বালকবেলার মতোই রোমাঞ্চিত হলাম।
গল্পটা খুবই সাধারন, একটি মৃতপ্রায় ঘোড়ার চোখে-বয়ানে মানুষের সমাজ। কথক ঘোড়ার স্মৃতিচারন যেন জীবন্ত বাংলাদেশের একটুকরো কোলাজ! মালিক বদলের সাথে সাথে কথক ঘোড়া কতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় আর এর ভেতর দিয়ে ভালোবাসা-ঘৃনা-প্রতিশোধ এরকম নানান মানবিক অনুভুতির বয়ান চলতে থাকে। কথক ঘোড়ার চোখ আয়না হয়ে ওঠে, যে আয়নায় মানুষের প্রতিচ্ছবি অনেক সময় হিংস্র জন্তুর চাইতেও জান্তব মনে হয়! লাল ঘোড়ার শেষ পাতা থেকেঃ
তিন তিনবার দাঁড়াতে গিয়ে যখন পড়ে গেলাম, তখন বুঝতে পারলাম আর চেস্টা করে লাভ নেই। এ জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। জীবন আমার শেষ হয়ে আসছে। মানুষের মতো জীবন নিয়ে আদেখলাপনা দেখাই না আমরা। মৃত্যতেও আমাদের কোন ভয় নেই। মানুষের কাজ করতে গিয়ে, তাদের লড়াইয়ে, তাদের যুদ্ধে হাজার হাজার বছর ধরে আমরা অকাতরে প্রান দিয়ে এসেছি। একটু ভাবলেই তো বোঝা যায়, ওদের ব্যাপারে আমাদের কি? ওদের হিংশায়, ওদের লোভে, ওদের বদমায়েশিতে আমাদের প্রান দেবার কোন মানে নেই। তোমরা যদি একবার মাথা ঠান্ডা করে ভাবো, তাহলেই বুঝতে পারবে, মানুষের থেকে আমরা সবদিক থেকেই শ্রেস্ঠ। শুধু একটা জিনিষের অভাব আমাদের। সে হলো মানুষের বুদ্ধি। এই বুদ্ধির জোরেই দুনিয়াটা লন্ডভন্ড করে বেড়াচ্ছে তারা। আমাদের কেটে টুকরো করে আমাদের মাংশে মানুষেরা তআদের পেট ভরাচ্ছে জেনেও আমরা মানুষদের ছাড়তে পারছি না। উচ্ছন্নে যাক মানুষের বুদ্ধি! মৃত্য ঘনিয়ে আসছে আমার। চোখে আর তেমন দেখতে পাচ্ছি না। আমার অন্ধকার ঘরটা আরো অন্ধকার লাগছে। যে মেঝেতে শুয়ে আছি, সে মেঝে ঠান্ডা। মাটির গোয়ালের ভিতরে আসছে গা-জুড়ানো বাতাস। কানে আসছে পাখির ডাক। একটুও ভয় করছে না আমার। ঘাড়টা লম্বা করে দিয়ে চেয়ে রয়েছি। চোখ বন্ধ করে আমি যেন আমার মাকে দেখতে পাচ্ছি। আহঃ কি শান্তি! আমি এখন মারা যাচ্ছি....