গত শনিবারের কালের কন্ঠে একটি খবর বের হয়েছে। মনে হল বিষয়টি শেয়ার করা দরকার তাই এই পোষ্টের অবতারনা।
কম বেশি আমরা সবাই অসুস্থ হই এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বা ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হয়। যদি সাধারণ রোগ হয় তবে রুগিকে হয়তো বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়না কিন্তু যদি অসুখ একটু জটিল হয় তবে তাকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে কি দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা ভুক্তভুগিরা জানেন। এ দুর্ভোগ এর জন্য দায়ী বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থা এবং চিকিৎসকরা।
আমাদের দেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ হলো সময় কম দেয়া, ভুল চিকিৎসা, কমিশন বাণিজ্য, দায়িত্বে অবহেলা, অহেতুক পরিক্ষা নিরীক্ষা বা অদক্ষতা এর বাইরে ফৌজদারী অপরাধের মত অভিযোগ্ও পাওয়া যায়। কিন্তু এতো অভিযোগের পরও হাতে গোনা মনে হয় দু-চারজন ডাক্তার এর সামান্য শাস্তি ছাড়া আর কোন ডাক্তার এর বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থাই নেয়া যায়নি। এ কারণে আমাদের স্বাস্ব্যসেবার মান দিনদিন নিম্নগামী। দেশের বড় একটা অংশ চিকিৎসার জন্য এখন আমাদের পাশ্ববর্তী দেশের উপর নির্ভরশীল।
আমি এবং আমার পরিবারের দু-এক জন এ দেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে যে ধরণের বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়েছি তা বলার বাইরে। সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার তো দুরের কথা রোগ একটু জটিল হলে আমাদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা পর্যন্ত রোগ নির্ণয় করার জন্য যেভাবে হাতড়ে বেড়ান, তা দেখে আমি বিস্মিত।
দীর্ঘদিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দারে দারে ঘুরে আমাদের দেশের চিকিৎসার যে সমস্যাটি আমার কাছে প্রকট মনে হয়েছে তা হলো এ দেশের ডাক্তারদের রুগীর পেছনে সময় কম দেয়া। সরকারী হাসপাতাল তো দুরের কথা প্রাইভেট চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার একটি রুগীকে তিন মিনিটের বেশি সময় দিতে চান না। তারা জানেন শতকরা ৮০ জন রুগীর রোগ কোন কোন ফর্মুলায় পড়ে। তাদের কাছে সে ফর্মুলা গুলো মুখস্থ থাকে, তারপর সংক্ষেপে রুগী দেখে বুঝে নেন রুগীকে কোন ছাঁচে ফেলে তিনি চিকিৎসা করবেন। শতকরা ৮০ জন রুগী ডাক্তারদের সেই কমন ছাঁচের মধ্যে পড়ে যান ফলে তারা ফর্মুলা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেন আর বাকি যে বিশজন রুগী সেই ছাঁচের মধ্যে পড়েন না তারা ভুগতে থাকেন। এ ধরণের রুগীর পেছনে অতিরিক্ত সময় নষ্ট করার মত সময় বা মানসিকতা কোনটাই আমাদের ডাক্তারদের নেই। অনেকে এর জন্য ডাক্তারদের ব্যস্ততাকে দায়ী করেন। বাস্তবিক অর্থে তা নয়, আমি কম ব্যস্ত ডাক্তারের কাছে গিয়েও দেখেছি প্রয়োজন হলে ডাক্তার বসে থাকবেন কিন্তু ৫-৭ মিনিটের বেশি একজন রুগীকে সময় দিবেন না। এটা হচ্ছে আমাদের দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকের কালচার।
একদিন আমি এক হাসপাতালের নেফ্রোলোজির বিভাগীয় প্রধানের প্রাইভেট চেম্বারে দেখাতে গেলাম। আগে থেকে আ্যপয়েন্টমেন্ট করা তারপরও প্রায় ২ ঘন্টা অপেক্ষার পর তার এ্যাসিসটেন্ট বললেন-
”আপনি জুতা খুলে দরজার কাছে দাড়ান । আপনাকে দেখে স্যার নামাজে যাবেন।”
এটাই তার চেম্বারের নিয়ম। আগের রুগী ডাক্তারের রুমে ঢুকলে তার পরের রুগীকে তাঁর দরজার সামনে জুতা খুলে অপেক্ষা করতে হবে। রুগীর জন্য যা রীতিমত অপমানকর। তারপরও জুতা খুলে অপেক্ষায় থাকলাম। ঘড়িতে দেখলাম নামাজের আর ৫ মিনিট সময় আছে। আমি অবাক হলাম এত অল্প সময়ে তিনি কি দেখবেন! আমার সব রিপোর্ট ঠিকমত দেখতেও তো দশ মিনিট লাগার কথা। যাহোক তিনি এই ৫ মিনিটে আমাকে দেখলেন তারপর আ্ররও একজন রুগী দেখে নামাজে গেলেন। ফলাফল হলো তাঁর চিকিৎসায় আমার রোগ ভাল হলোনা। পরে সেই একই হাসপাতালের ইউরোলোজির প্রধানের কাছে গেলাম, তিনি বললেন আগের ডাক্তার আমাকে আন্দাজে চিকিৎসা করেছেন। আমার রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ রকম চিকিৎসার আমার কোন প্রয়োজন নেই।
এবার আসি মূল বিষয় কালের কন্ঠের খবর প্রসঙ্গে। যদিও খবরটি একটি ব্যানার হেড লাইন হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু এটি এসেছে শনিবারের (১১/১১/২০১৭) কালের কন্ঠ পত্রিকার শেষ পাতার ৮ম কলামে। যাহোক বেশি কথা না বলে সেখানে যে ভাবে খবরটি এসেছে তার মূল অংশটি এখানে তুলে ধরছি-
”বিটিশ জার্নালে বাংলাদেশ
রোগীপ্রতি ৪৮ সেকেণ্ড সময় দেন ডাক্তাররা!”
কালের কন্ঠ ডেস্ক
রোগীর পেছনে সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। তাঁরা একজন রোগীর পেছনে গড়ে মাত্র ৪৮ সেকেণ্ড সময় দেন। চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
৬৭ টি দেশের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইডেনের চিকিৎসকরা প্রাথমিক স্বাস্ব্যসেবা নিতে আসা একজন রোগীর পেছনে গড়ে সময় দেন ২২ মিনিটের বেশি। বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের চিকিৎসকরা রোগী্প্রতি গড়ে ২.৩ মিনিট, পকিস্তানের চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি ১.৩ মিনিট এবং চিনের চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি গড়ে ২ মিনিট সময় দেন।……… ………………………………………………………………………………………………………………………………..
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল বলছে – রোগীর পেছনে চিকিৎসকদের কনসালটেশন টাইম বা পরামর্শকালের সময় যত কম হবে, স্বাস্ব্যসেবার মানও তত খারাপ হবে। এতে সাধারণত রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়ে রোগীর অতিমাত্রায় আ্যন্টিবায়োটিক ব্যাবহারের শঙ্কাও। নষ্ট হয় চিকিৎসক-রোগী পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক। অন্যদিকে কনসালটেশন টাইম যত দীর্ঘ হয়, স্বাস্থ্যসেবার মানও তত উন্নত হয়।
একজন রোগীর পেছনে কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট সময় দেয়া উচিত বলে মনে করেন ডাব্লিউএইচওর সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, একজন রোগীর নাম ও বয়স জিজ্ঞাসা করতেই ৪৮ সেকেন্ড সময় চলে যায়। এ ছাড়া রোগীর অতীত ও বর্তমান এবং পারিবারিক ইতহাসও জানতে হয়। এসবসহ ব্যবস্থাপত্র লিখতে ১০-১৫ মিনিট সময় নেয়া উচিত”
তাই বলতে হয় আমাদের দেশের (বেশির ভাগ) ডাক্তারদের কাছে রোগীর জীবনের চেয়ে সময় বা অর্থের মূল্য অনেক বেশি
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত এবং সম্পাদিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:০১