somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

Akm Khokon
মাঝে মাঝে দুরন্ত হই!! প্রকৃতির রূপ,রস,গন্ধ খোঁজতে যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই বেরিয়ে পড়ি। খুঁজে ফিরি আপন গন্তব্য!!! তবে,প্রতিটা ক্ষনেই ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয় তথাকথিত কিছু স্বার্থপরদের কাছে!!

প্রেম

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানব সভ্যতা ও বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও ‘প্রেম’ নিয়ে কৌতূহল ও রহস্যময়তার শেষ নেই। ‘প্রেম কী’-এর অনুসন্ধান এখনো চলছে। মধুর স্বাদ যে ব্যক্তি কখনো লাভ করেনি, তাকে যেমন চিনি ও গুড়ের মিশেলে মধুর স্বাদ বোঝানো যাবে না, তেমনিভাবে ‘প্রেম কী’ জানতে হলে খোদ প্রশ্নকর্তাকেই প্রেমে পড়তে হবে। প্রেমের সত্যিকার উপলব্ধি অর্জন করা কেবল তখনই সম্ভব।
তবে প্রেমের কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও প্রেম নিয়ে নানা ধরনের মিথ ও ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। বিপরীত লিঙ্গের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি পূর্ণ আসক্তিকেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালবাসা রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘প্রেম’ বলেছেন। বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ্য অনুভব করে আপন সত্তাকে সমর্পণের আকুতিই মানব-মানবীর প্রেমের প্রথম ও প্রধান নির্দেশক।
কবির ভাষায়— “আমি তোমাকে ভালবাসি অস্থিমজ্জাসহ।” সত্যিকারের প্রেমের প্রকাশ এটাই।
‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’
সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’ —এমন প্রশ্নও উঁকি দেয় অনেকের মনে। একজন নর কিংবা নারী যখন বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’; তখন সেটা আসলে প্রেমেরই নির্দেশক।
তবে ‘ভালবাসা’ শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক। এখানে বহুজনকে জায়গা দেওয়া সম্ভব। ভালবাসা যদি হিমালয়ের পাদদেশ হয়, প্রেম হলো এর চূড়া। যদি আরেকটু সহজ করে বলি— তাহলে বলা যায়, ভালবাসা হচ্ছে, রেলের একটি কম্পার্টমেন্টের মতো, এখানে বহু লোক একসঙ্গে বসতে পারে। আর প্রেম হচ্ছে, রিকশায় চড়ার মতো, এখানে দু’জন নর-নারী স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারে। ভালবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হতে পারে। অন্যদিকে সত্যিকারের প্রেম নিঃস্বার্থ হলেও নিঃশর্ত নয়।
“ভালবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ/সত্যবদ্ধ অভিমান ... ” (সত্যবদ্ধ অভিমান/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
অনেককেই ভালবাসা যায়, কিন্তু সবার সঙ্গে প্রেম হয় না। ভালবাসার সবচেয়ে গভীরতম স্তরটি হচ্ছে প্রেম। প্রেম হয় শুধু একজনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ একাধিক প্রেমের কথা বলেন। কারো জীবনে একাধিকবার প্রেম আসতেই পারে। কিন্তু একই সঙ্গে একাধিক প্রেমে যারা বিশ্বাসী— সেই সম্পর্কগুলো অবশ্যই প্রেম নয়, অন্যকিছু। কারো কারো কাছে এটা নেশা বা খেলার বস্তু।
প্রেমে পড়ার কি কোনো বয়স আছে? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে— ‘না’। একজন মানুষের ভেতর প্রেমের অনুভূতিগুলো যখন প্রথম জাগ্রত হয় কিংবা যখন সে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে; তখন থেকেই সে অবচেতন মনে নিজের প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে বেড়ায়।
লাবণ্য’র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অমিত রায় বলছে, “সেই শৈশব থেকে সমস্ত দিন যেন অবচেতন মনে তোমার পায়ের শব্দ শুনে আসছি। মনে হয়েছে, কত অসম্ভব দূর থেকে যে আসছো —তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছুলে তো আমার জীবনে।” (শেষের কবিতা/রবীন্দ্রনাথ)
অন্যদিকে কবিতায় যদি দেখি, বনলতা সেনের দেখা পাওয়ার জন্য হাজার বছর পথ হেঁটেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি লিখেছেন- “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি … /… দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” (বনলতা সেন)
গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে দেবতা কিউপিড যখন কাউকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়েন বা কাউকে তিরবিদ্ধ করেন তখন ওই মানব কিংবা মানবীর ভেতর প্রেমের ক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘অবসেশন পিরিয়ড’ (ঘোর লাগা সময়)।
যে কোনো প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বা দেখা হওয়াটা একটা পূর্বশর্ত। ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ (ফার্স্ট সাইট লাভ) বলে একটা কথা চালু আছে। তবে এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না; এটা আসলে এক ধরনের মুগ্ধতা। আগেকার দিনে একজন আরেকজনকে না দেখে শুধু চিঠিপত্রের (পত্র-মিতালী) মাধ্যমে বা লেখালেখির সূত্র ধরে প্রেমে পড়েছেন— এমন নজির আছে। তবে এসব প্রেমের স্থায়িত্ব কিংবা পরিণতি বা সফলতার ইতিহাস খুব বেশি নয়।
প্রেমের ক্ষেত্রে দেখা হওয়াটা যেমন পূর্বশর্ত, তেমনি প্রেমের বহিঃপ্রকাশ তথা ভালবাসার মানুষটিকে মনের কথাটা বলতে পারা কিংবা তাকে জানানোটাও খুব জরুরী। শুধু নিজের ভালবাসার কথাটি প্রিয়জনকে বলতে না পারার কারণে অতীতে বহু প্রেমের মৃত্যু ঘটেছে। এমন ঘটনা হয়তোবা এখনও ঘটছে।
প্রেমকে যেমন সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় না, তেমনি বিপরীত লিঙ্গের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি কেন আরেকজনের প্রবল আকর্ষণ— এরও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই।
কবি বলেছেন, “কেন তাকে ভালবাসি/এ প্রশ্নের মিলবে না কোনো সদুত্তর/এমন কোনো জাল নেই —যা দিয়ে আটকে রাখা যায় তাকে ...”
একজন মানুষ কখন, কোথায় ও কীভাবে প্রেমে পড়বে এটা আগে থেকে কেউই বলতে পারে না। কখনো কখনো প্রেম হয়ে ওঠে মানুষের নিয়তি ও পরিণতি।
সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসের নায়ক বেলাল তার প্রেমে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, “প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়িনি আমি। অনেকদিন থেকে চেনা ছিল। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, এই মানুষটির জন্যেই আমার অপেক্ষা, আমার গড়ে ওঠা। একটু একটু করে সে আমার সর্বস্বের সঙ্গে এক হয়ে গেল। স্বার্থ আর বাস্তবতার কথা ভাবলে তাকে পাবার কোনো কথা নয় আমার। তবু তাকেই আমার ভালবাসতে হচ্ছে। এই অনিবার্যতার জন্যেই বুঝেছি, এ আমার নিয়তি, এতেই আমার পরিণতি, এখানেই আমার ভালবাসা।”
প্রেমে পড়ার বিষয়ে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ তার ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ উপন্যাসে লিখেছেন- “ভালবাসা হচ্ছে তীরের মত। তুণ থেকে বেরিয়ে গেলে সে বেরিয়েই যায়। তীর তার লক্ষ্যবস্তকে বিঁধতে পারবে কি পারবে না -সেটা সেই তীরন্দাজের কপাল। কিন্তু ভালবাসা তো আর পোষা কুকুর নয় যে, তু তু করে ডাকলেই আবার ফিরে আসবে।”
পশ্চিম বাংলার আরেকজন লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তার এক উপন্যাসে লিখেছেন- “ভালবাসা মনের যে দরজা দিয়ে ঢোকে, সে দরজা দিয়ে বেরোয় না। এটা এমন একটা ইনভেস্টমেন্ট -যার কোন রিটার্ণ নেই; এমন এক পাখী -যার কোন সঙ্গী নেই।”
একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার চলার ছাঁচ কিংবা জীবনধারা বদলে যায়। প্রেম একক কোনো অনুভূতি নয়, অনেক অনুভূতির সমন্বয়ে প্রেম। প্রেমে যেমন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা থাকে, তেমনি হারানোর ভয় থাকে, থাকে ঈর্ষাও।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দেখি— কবি বলছেন, “সুরঞ্জনা ওই খানে যেয়ো নাকো তুমি/বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে/কী কথা তাহার সাথে/তার সাথে...” (আকাশ লীনা)
কারো কারো মতে, ‘প্রেম মানুষের জীবনে অতি ব্যক্তিগত একটি আশীর্বাদ কিংবা অভিশাপ।’ প্রেমে যদি থাকে অবিশ্বাস, সন্দেহ, ছলনা ও দ্বন্দ্ব তাহলে সে প্রেম জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে।
অনেকে বলেন, একতরফা প্রেম অধিকাংশ মানুষকে হতাশার দিকে ধাবিত করে। এটা কখনো কখনো ঠিক। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন কিংবা নিজের জীবনকে নষ্ট করেছেন এমন উদাহরণ কম নয়। এ ছাড়া ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইলিং ও প্রতিহিংসামূলকভাবে অনেকে অনেক কিছু করেন— যা অনুচিত এবং অনৈতিক।
আবার এমন ঘটনাও আছে, পাবে না কিংবা প্রেমে সফল হতে পারবে না জেনেও কেউ কেউ ভালোবাসে। এসব কারণে ‘একতরফা’ সম্পর্ককে ‘প্রেম’ বলতে অনেকেরই আপত্তি আছে। তাদের মতে, প্রেম কখনো একতরফা হয় না। ওটা আসলে ‘ভালোবাসা’, প্রেম নয়।
প্রেমের পরিণতি
প্রেমের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিরহ ও বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের যাতনা একতরফা ভালোবাসার চেয়েও কঠিন। বিচ্ছেদকাতর প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ তা-ই এখনো অনেক প্রিয়। তবে সাধারণভাবে যেকোনো প্রেমেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে মিলন।
কিন্তু যতটুকু জানা যায়, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের পথটি অতীতেও নিষ্কণ্টক ছিল না। আদিকাল থেকেই প্রেম বা ভালোবাসার পথটি বরাবরই দুর্গম, কঠিন ও পিচ্ছিল। এখানে যেমন পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ইগো বা দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, ঘৃণা, ঈর্ষা ও ছলচাতুরি যেমন আছে, তেমনি মিলনের অন্তরায় হয়ে আছে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, অনুশাসন এবং বৈষয়িক বাধা।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র কথাই ধরা যাক। এ উপন্যাসে অমিত-লাবণ্যের মিলনের অন্তরায় হিসেবে শ্রেণী বৈষম্যকে-ই দায়ী করেছেন কোনো কোনো সমালোচক।
বিপ্লবী লেনিনের মতে, প্রেম, ভালোবাসা শুধু ব্যক্তিগত মানবিক সম্পর্কই নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন।
বৈষয়িক সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক রীতিনীতি ও অনুশাসনমুক্ত ‘অবাধ ভালোবাসা’য় বিশ্বাসী ছিলেন লেনিন। নারী-পুরুষের যে মুক্ত সম্পর্কের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেটা কেমন ছিল?
এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস লিখেছেন, “এর উত্তর মিলবে নতুন বংশধররা যখন বড় হয়ে উঠবে। এক নতুন প্রজাতির পুরুষ, যারা তাদের জীবনে কখনো জানবে না— কীভাবে নারীর ভালোবাসা সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয় কিংবা অন্য কোনো সামাজিক ক্ষমতার জোরে আদায় করতে হয়। অনুরূপভাবে, এক নতুন প্রজাতির রমণী, যারা কোনোদিন জানবে না— পুরুষের কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে সঁপে দেওয়ার আর কী বিবেচনা কাজ করতে পারে। তাদের প্রেমিকের সঙ্গে মিলনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ভীতি প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে না।”
প্রেমের রকম-ফের : প্লেটোনিক প্রেম
প্রেমের মূল রহস্য আবিষ্কার করা না গেলেও প্রেমকে নানা ধরনের ব্যবচ্ছেদ তথা শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত করেছেন অনেকে। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক (বাল্য ও কিশোর প্রেম, পরিণত বয়সের প্রেম, মধ্য ও প্রৌঢ় বয়সের প্রেম) প্রেম যেমন আছে, অন্যদিকে আছে প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, একাধিক ও পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি।
প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, অন্যদিকে প্রেমে শরীরের ভূমিকা কতটুকু কিংবা আদৌ আছে কি না— এ বিতর্ক অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। মতের সমর্থনে দুই পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। প্লেটোনিক লাভের সমর্থকরা তাদের যুক্তির সমর্থনে চেনা-পরিচিত এক বা একাধিক উদাহরণ টেনে আনার পাশাপাশি চণ্ডীদাস-রজকিনী ও দান্তে-বিয়েত্রিচের প্রেমের উল্লেখ করেন।
ফ্লোরেন্সের মহাকবি দান্তে যখন প্রেমে পড়েন তখন বিয়েত্রিচের বয়স মাত্র ৯। এরও ৯ বছর পর বিয়েত্রিচের কাছ থেকে প্রথম সম্ভাষণ লাভ করে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি। তাকে নিয়ে রচনা করেন কাব্যগ্রন্থ ‘ভিটা নোভা’ (নতুন জীবন)। এদিকে বিয়েত্রিচের সঙ্গে দান্তের দেখা হয়েছিল মাত্র দু’-চারবার। ধারণা করা হয়, কবির আবেগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার অবকাশ বিয়েত্রিচ আদৌ পাননি। সুতরাং বলা যেতে পারে, তাদের এ সম্পর্কটি স্বাভাবিক পরিণতি পায়নি। পরবর্তীকালে সাইমন নামে এক লোকের সঙ্গে বিয়েত্রিচের বিয়ে হয় এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান কবির এই প্রেমিকা। বিয়েত্রিচের মৃত্যুর কয়েক বছর পর দান্তেও বিয়ে করেন গেমা নামে এক অভিজাত পরিবারের নারীকে।
অন্যদিকে চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেমকাহিনীর সঙ্গে বাঙালি পাঠক মাত্রেই কম-বেশি পরিচিত। কবি বলেছেন, “রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।”
প্লেটোনিক লাভের তত্ত্বে যারা বিশ্বাসী নন, তাদের কথা হচ্ছে— আগের দিনে যেসব প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ ছিল না, অভিসারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা, ভয়-ভীতি, চক্ষু লজ্জা বা সংস্কার ছিল প্লেটোনিক লাভের প্রবক্তা মূলত তারাই। তবে ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে।তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কবি’ প্লেটোনিক প্রেমের স্বার্থক উদাহরণ। পরিণত বয়সে ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ অমিত-লাবণ্যের প্রেমের সম্পর্কের যে চিত্র এঁকেছেন সেটাও অনেকটা প্লেটোনিক ধাঁচের।
প্লেটোনিক লাভ প্রসঙ্গে এ ধরনের একটি কথাও কেউ কেউ বলেন, ‘মজনু লাইলীকে পায়নি, ফরহাদ শিরিকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ তাদের প্রিয়জনকে পায়নি।’
বিশিষ্ট পণ্ডিত প্রয়াত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “চুম্বন নিরপেক্ষ প্রেম নাই, সুতরাং দেহ নিরপেক্ষ প্রেমও নাই এবং দেহ নিরপেক্ষ প্রেম যখন নাই, কাম নিরপেক্ষ প্রেমও নাই। কারণ কাম, দেহ ধর্ম, অজেয় জীবধর্ম।”
একই প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, “তাই বলিয়া কাম ও প্রেম এক নয়, দুইয়ের পরিধিও সমান নয়। নর-নারীর দৈহিক সম্পর্ক মনুষ্য জাতির দিক হইতে জৈব হইলেও ব্যক্তির দিক হইতে আরও অনেক কিছু। সুতরাং দৈহিক ব্যাপারটা আনুষঙ্গিক, মনের দিক হইতে মুখ্য নয়।”
কবি মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “সৃষ্টিমূলে আছে কাম, সেই কাম দুর্জয় দুর্বার।”
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ প্রেমবিষয়ক এক আত্মজৈবনিক লেখায় বলেছেন, “এক সময় শরীরটাকেই বড় বলে ভাবতাম। আজকাল তেমন ভাবি না। ...কয়েকটি নারীর মুখাবয়ব, কারো ভেজা চোখ, দীর্ঘ ক্ষীণকায়া কারো বেণী এবং আমার পক্ষ থেকে নিরূপায় অক্ষমতার কথা জেনেও আজীবন আমাকে ক্ষমা করে যাওয়ার ঔদার্যকেই আজকাল আমি প্রেম বলে জানি।”
কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের মতে, “প্লেটোনিক লাভ আজগুবি ধারণা। প্রেম মানে ইরোজ নাই, কাম নাই, শারীরিকতা নেই— এগুলো প্লেটোর কথা নয়, ছিল না। দর্শনের গোড়াতন্ত্রে, সেখানে শরীর মুখ্য বিষয়— মনুষ্য শরীর আর ব্রহ্মাণ্ড যেখানে একাকার— যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”
প্লেটোনিক লাভ সম্পর্কে লেখিকা নাসরীন জাহান তার এক বইতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “দেহের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, প্রকৃতি আছে। প্লেটোনিক প্রেমে বিশ্বাসী দু’জন নর-নারী যদি বন্ধনহীন একটি নির্জন স্থানে একত্র হয়, তবে কি তাদের দেহ স্পর্শহীন, আকুলতাহীন স্তব্ধ হয়ে থাকবে?”
বাংলা সাহিত্যে মানুষকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে সার্থকভাবে প্রথম তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের নায়িকা কুসুম ও নায়ক শশী ডাক্তারের দুটি সংলাপ বাংলা সাহিত্যে বহুল আলোচিত। সংলাপ দুটি এ রকম : “কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল- ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন, ছোট বাবু’?”
জবাবে শশী ডাক্তার বলেন, “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”
তবে ভালোবাসা যখন সত্যিকারের হয়, তখন শরীরটা অনেক নিচে পড়ে থাকে। প্রেমিকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের পর সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসের নায়িকা সাকিনার উপলব্ধি: “ভালবাসার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ভালবাসা এর ঊর্ধ্বেও নয়, নীচেও নয়। ভালবাসা এর বাইরে এবং বিযুক্ত।”
একাধিক প্রেম ও পরকীয়া
‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লতার এ গানটি শোনেননি এমন প্রেমিক বাঙালি শ্রোতা খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রেম কি শুধু একবার-ই আসে? যারা সারাজীবনে মাত্র একবার প্রেমে পড়েছেন, সফল হয়েছেন ও সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন- তারা অবশ্যই অসম্ভব ভাগ্যবান ও নমস্য ব্যক্তি।
কিন্তু যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরও নতুন কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি, তারা নিশ্চয় দুর্ভাগা। অবশ্য, এদের মধ্যে যারা নতুন করে সম্পর্কে জড়াতে চান না— তাদের কথা আলাদা।
এর বাইরে চলমান একটি সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যারা যাচ্ছেন, তারাও প্রেমে পড়তে পারেন। তবে সমাজের চোখে এটা অনৈতিক। তবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হলেও ব্যক্তি পর্যায়ে পরকীয়া প্রেমকে কেউ কেউ ‘স্বাভাবিক’ ও ‘দোষের কিছু নয়’ বলে মনে করেন।
সাধারণভাবে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের জীবনে একাধিক প্রেম ও পরকীয়ার বিষয়টি বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে। দেশে-বিদেশে এমন কোনো বড় ও আলোচিত লেখক পাওয়া যাবে না যারা একাধিকবার প্রেমে পড়েননি।
এ বিষয়ে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, “হাওয়ার কাছে আদি পুরুষের যে দাবি, তা মূলত নিজের ভুলে যাওয়া রক্তমাংসের কাছেই দাবি। কবির দাবিও নারীর কাছে তেমনি। এক এক নারীর কাছে কবি দেখে তার হারানো পাঁজরেরই খণ্ড খণ্ড যোজনা। শুধু একজনের দেহে তা পাওয়া যায় না বলেই কবির কাছে কামের চেয়ে প্রেম এত বড়।”
প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন একবার প্রেম বিষয়ক এক আড্ডায় এ বিষয়ে বলেছেন, “আমি তো এখনো প্রেমে পড়ি। সুন্দরী মেয়ে দেখলে এক ঘণ্টার জন্য হলেও আমি প্রেমে পড়ে যাই। আমি দেখেছি আমার মধ্যে প্রেম আছে। প্রতিদিন ভোরে যদি পৃথিবীকে দেখে প্রেমে না পড়ি, তাহলে আমি লিখব কেমন করে! অসম্ভব, অসম্ভব।”
সাহিত্যে পরকীয়া প্রেমের অনেক উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্ট নীড়’ গল্পটি পরকীয়া প্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের এ গল্পটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন তার ‘চারুলতা’ ছবিটি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে কুবের-কপিলার পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি এসেছে খুবই সাবলীলভাবে।
গোপন প্রেম কিংবা পরকীয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সমালোচিত না হলেও শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত-লাবণ্য ও অমিত-কেতকীর সম্পর্ক ব্যাখ্যায় যে তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন এর সমালোচনায় মুখর সচেতন পাঠিকা ও নারীবাদীরা। উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় লাবণ্য ও কেতকীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে— “কেতকীর সাথে আমার সম্বন্ধ ভালবাসার-ই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের সাথে আমার যে ভালবাসা সে হইল দীঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।”
শেষ হয়েও যা শেষ হয় না
মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত প্রেমের অভিজ্ঞতা বড় বিচিত্র ধরনের এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অন্তর্মুখী। আমার পরিচিত এক ব্যক্তি মাঝে মাঝে প্রেম-সংক্রান্ত আলোচনায় বলতেন, ‘আমার বুকের ভেতরটা একটা আর্ট গ্যালারি। এখানে বহু নারীর পোর্ট্রেট ঝোলানো আছে।’ এ ধরনেরই এক আলোচনায় একবার এক অচেনা তরুণকে বন্ধুদের সঙ্গে এই বলে রীতিমতো তর্ক করতে দেখেছি, ‘জীবনে লক্ষ লক্ষ বার প্রেম আসে’। হতে পারে এসব কথা শুধুই কথার কথা কিংবা অতিরঞ্জিত।
তবে এটা ঠিক যে, চলার পথে মানুষের জীবনে কখনো কখনো হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এমন কেউ এসে পড়ে— যা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেই মানুষটিকে মনে রাখে আজীবন, যা হয়তো ওই মানুষটিও কোনোদিন জানতে পারে না। এ ধরনের অনুভূতি বা সম্পর্কের নাম কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হয়তোবা এরা ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি হয়েও কেউ কেউ সারাজীবন জুড়ে থাকেন। ‘বনলতা সেন’ সেই রকমই একজন অসাধারণ নারী। কবির সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারপরও বনলতা সেন আধুনিক বাংলা কবিতায় ক্ল্যাসিক প্রেমিকার প্রতীক।
কবি লিখেছেন— “আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।/… সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী, ফুরায় এ-জীবনের লেনদেন;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:২৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×