পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ একের অধিক প্রেমে পড়ে।
এই ছোট্ট জীবনে আপনি ,আমি, আমরা প্রত্যেকে বহুবার করে প্রেমে পড়েছি- কামনায় আটকে গেছি। বিকেলে পার্কে বসে প্রেমিকার হাত ধরে বলেছি ; তোমাকে ছাড়া আমার জীবন ঠিক জীবন নয়। আর রাতে হস্তমৈথুন করার সময় কল্পনা করেছি অন্য কাউকে।
মানুষের জীবনের চেয়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ আর নেই- যেকোনো সময় যেকোনো দুর্যোগে শেষ হয়ে যেতে পারে এদেশের পুরো অস্তিত্ব কিংবা শেষ হয়ে যেতে পারে বিশেষ কিছু অঞ্চলের অস্তিত্ব।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তরুর জীবনের একটা বিশেষ অঞ্চল যে ঝড় ধ্বংস করে দিয়েছিলো সে ঝড় সৃষ্টি করেছিলো তারই একমাত্র বন্ধু কিজুকি- আত্মহত্যার মাধ্যমে।
আত্মহত্যা একটা চমৎকার ব্যাপার যদিনা আত্মহত্যাকারীকে ভালোবাসার মত কেউ পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকে। আফসোস, কিজুকিকে ভালোবাসার মত অনেকেই ছিলো। উল্লেখযোগ্য, তার বন্ধু তরু আর প্রেমিকা নাওকো।
কিজুকির মৃত্যু নাওকোকে উপহার দেয় ক্ষণিকের এক প্রেমহীন জীবন আর সারাজীবনের জন্য একটুকরো অপূর্ণতা- তরুকে দেয় ভীষণ একাকীত্ব।
সময় বদলায়, সময়ের সাথে বদলায় মানুষ। তারই প্রেক্ষিতে, একসময় তরু আর নাওকো একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। এরপর মুরাকামির ইচ্ছায়, নাওকোর বিশ তম জন্মদিনে নাওকো আর তরু একে অপরের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। তরু আবিষ্কার করে এটাই নাওকোর প্রথম সঙ্গম অথচ সে কিজুকি আর তাকে নিয়ে কতকিছুই না ভেবেছিলো ! কৌতূহলী তরু সঙ্গম শেষে নাওকোকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “কিজুকির সাথে তুমি কখনও সঙ্গম করোনি ক্যানো?”
পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় দেয়া যায়না বিধায় তরুকে সেদিন এই প্রশ্নের উত্তর না পেয়েই ঘুমাতে হয়েছিলো আর জেগে উঠে মেনে নিতে হয়েছিলো, সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা। নাওকো তরুকে রেখে কোথাও চলে গেছে !
একদিন হুট করে নাটকের ইতিহাস ক্লাসের মেয়ে মিদোরির সাথে পরিচয় হয় তরুর।
আসল গল্পের শুরু এভাবেই। তরু না পারে নাওকোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে, না পারে মিদোরির ভালোবাসাকে উপেক্ষা করতে।
মানুষের জীবনের সবথেকে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে, দুজন প্রেমিক/প্রেমিকার মধ্য থেকে একজনকে বেঁছে নেয়া। তরু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা সে কাকে চায়? মিদোরি নাকি নাওকো?
যেই প্রশ্নটা যন্ত্রণা দিয়ে মারছিলো তরুকে, একসময় সেই প্রশ্নটার উত্তর আশাতীতভাবে দিয়ে দিলো নাওকো !
শুনেছি, জাপানে এমন কেউ নেই যে এই বইটা পড়েনি ! সত্যিই যদি তাই হয় তাহলে অবাক হবার মত কিছুই নেই- অন্তত বইটা পড়ে তাই মনে হচ্ছে। চাইলেই হয়ত যে কেউ তরু, নাওকো, মিদোরি, কিজুকি, নাগাসাওয়া কিংবা রেইকো হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু হারুকি মুরাকামির মত একজন চমৎকার স্রষ্ঠা হয়ে উঠতে পারবে না। কী নেই এই বইয়ে? কী নেই!?
প্রেম, বিষাদ, যৌনতা আর অপূর্ব দর্শনে হারুকি ‘নরওয়েজিয়ান উড’ নামে যে স্বর্গসূখ তৈরি করে রেখেছে গোটা পৃথিবীর পাঠকদের জন্য- তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার অনেক অনেক উর্ধ্বে।
ওহ হ্যাঁ, আরেকটা মানুষ আছে ; কৌশিক জামান- এই বইয়ের অনুবাদক। তাকে কেবল বলবো, “আপনার সাথে এককাপ চা খেতে খেতে গল্প করতে ইচ্ছা করছে”।
অনেকদিন আগে শাহবাগে রাজু ভাস্কর্যে বসে প্রথম কারো মুখে নাম শুনেছিলাম এই বইয়ের। এরপর বাসায় ফিরে করার মত তেমন কিছু না থাকায় গুগলে ঢুকলাম। সার্চ করলাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’ লিখে। বেশ কয়েকটা রিভিউ পড়লাম- আকৃষ্ট হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বইটা পড়বো। এরপর দুর্ভাগ্যক্রমে উইকিকোয়াটের আরেকটা লিংকে ক্লিক করলাম। বইটার সেরা উক্তিগুলো পড়লাম। একটু আগের সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। নতুন করে সিদ্ধান্ত নিলাম, মৃত্যুর আগে বইটা পড়বোই পড়বো।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে বইটা সংগ্রহ করলাম (উপহার পেয়েছি)- পড়লাম। রাত তখন প্রায় শেষ। ৫.৩৩ এ এম। আমি দরজা খুলে ছাদে গেলাম। খানিকটা সময় ভাবলাম। বইটার শেষ পাতায় লিখলাম, “জৈবিক চাহিদার মধ্যে ‘অশ্লীলতা’ বলতে কিছু নেই- থাকতে নেই”।
এবং, অনেকদিন বাদে আমি অন্য কোনো জীবনের কথা ভেবে পাওয়া দুঃখ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
বই আলোচনা
বইয়ের নাম : নরওয়েজিয়ান উড
লেখক : হারুকি মুরাকামি
অনুবাদক : কৌশিক জামান
মূল্য : ২২০
প্রকাশনী : বাতিঘর
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৫:১১