somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবশেষে আমি স্কুলে...অভিশপ্ত ৮ বছরের অবসান

৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূল পোস্টটি আমার ইংরেজী ব্লগে

আজ থেকে আট বছর আগের কথা। মিরপুরের শাহ আলী গার্লস হাই স্কুলে তখন পড়তাম। গার্লস স্কুল, তবে ছেলেদেরও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হতো। আমি তখন ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রি-তে প্রমোশন পেয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই ফলাফল প্রদানের দিন বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। অবশেষে এক বছরের পড়াশোনার স্বীকৃতিস্বরূপ একটা প্রমোশন পেলাম। স্বাভাবিক নিয়মে আমার তখন তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হবার কথা ছিল। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীর বদলে আমার পড়াশোনার মোড় ঘুরে গেল অন্যদিকে। কষ্টপূর্ণ (আমি বলবো অভিশপ্ত) আট বছরের সেখানেই শুরু।

আমার জন্মের আগে আমার মা একটা নিয়্যত করেছিলেন। আল্লাহ যদি তাকে আরেকটা সন্তান দেন তাহলে তিনি তার তৃতীয় সন্তানকে ইসলামের পথে পরিচালিত করবেন। আল্লাহ হয়তো তার সেই নিয়্যতের প্রেক্ষিতেই আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কোন এক বছরের ৫ই জুন আমার পরিবারের তৃতীয় সন্তান হিসেবে আমি জন্মলাভ করি।

তৃতীয় শ্রেণীর পরিবর্তে আমার পড়াশোনা শুরু হয় ঢাকা বিখ্যাত (!) এক কওমী মাদ্রাসায়। দেশ-বিদেশের বহু বরেণ্য ওলামায়ে কেরামগণ প্রায়ই এই মাদ্রাসাটিতে আসেন (নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না)। বিশাল দু'টি ভবন ও প্রশস্ত মাঠ নিয়ে নির্মিত মাদ্রাসাটিতেই আমার শৈশবের সূচনা ঘটে।
মাদ্রাসায় আমি পাঁচ বছর পড়ি। আজও মনে পড়ে সেই প্রথম বছরটির কথা, যখন অনেকটা নিষ্ঠুরের মতোই ছোট্ট আমাকে মা-বাবা মাদ্রাসার হোস্টেলে তথাকথিত হুজুরদের তত্ত্ববধানে রেখে আসতেন। আমার মনে পড়ে রাতের পর রাত আমার ঘুম হতো না। মূলত মাদ্রাসার পরিবেশের সঙ্গে কখনোই আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতাম না। আজ আপনারা আমার সা.ইনের যে ব্লগটি পড়ছেন, এটার শুরু হয় সেই মাদ্রাসায় থাকতেই। প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি ছোটবেলা থেকেই এবং আমার ব্লগিং জীবনও শুরু হয় তখন থেকেই। তবে আমার ইন্টারনেটভিত্তিক এসব কাজকর্ম আমার সহপাঠীরা কখনোই বুঝতো না। আর তাই তারা সবাই আমাকে একটু আলাদা চোখে দেখতো। আমিও খুব চেষ্টা করেও তাদের কাউকে মনের মতো পাইনি। যদিও ভালো সম্পর্ক ছিল অনেকের সঙ্গেই।

পাঁচ বছর পর
শুরু হলো আমার অভিযান। পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম আমি। কোনমতেই সেই মাদ্রাসায় আর থাকবো না। পরিবারের কাছে আমি বিষাক্ত 'কিছু একটা' হয়ে গেলাম। কারণ, আমি তাদের কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিলাম না। আমার অনেক বড় একটা 'আবদার' ছিল তাদের কাছে। সেটা হচ্ছে এই যে, আমি সাধারণ লাইনে লেখাপড়া করতে চাই। যেমনটা আমার মতো হাজারো শিশু করছে।
তবুও তাদেরকে মানাতে না পেরে মাদ্রাসা থেকে না বলে বাসায় চলে আসতাম। বাসায়ও কিছু একটা বানিয়ে মিথ্যা বলে কাটিয়ে দিতাম। মাঝেমধ্যে বাসা-মাদ্রাসা কোনখানেই থাকতাম না। তখন অনেকটা যাযাবরের মতো ঘুরে ঘুরে দেখতাম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য। তুরাগ-তীরে অস্তগামী সূর্যের নৈসর্গিক দৃশ্য। আর ভাবতাম, আমার জীবনটাই এমন কেন?
কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা থাকে। অবশেষে একদিন "যা থাকে কপালে" মনোভাব নিয়ে মাদ্রাসা ছেড়ে চলে আসলাম। বাসায় আসার সাহস করলাম না। ঘোরাফেরা করে সময় কাটালাম ঢাকার বিভিন্ন হাইওয়েতে।

তখন দেশে জঙ্গি-জামানা ছিল। জঙ্গিদের উৎপাতে দেশ ছিল অতিষ্ঠ। তাই রাস্তাঘাটেও পুলিশ প্রহরা ছিল কড়া। সেদিনই মধ্যরাতে হাইওয়ে থেকে পুলিশ আমাকে একাকী অবস্থায় পায় এবং মাদ্রাসার পোষাক পরা দেখে সম্ভবত জঙ্গি সন্দেহেই আমার কাছে এসে দাঁড়ায় তাদের অস্ত্রসজ্জিত পেট্রোল। আমাকে খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা তাদের অস্থায়ী আদালতে। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য আমার সঙ্গে ছিল। অফিসার আমার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন আমি কোন খারাপ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নই, বরং এটা সম্পূর্ণই পারিবারিক একটা ব্যাপার। তখন তিনি আমাকে পুলিশ পেট্রোলে করে বাসায় পৌঁছে দেন। তাকে আজ সামনে পেলে দশবার সালাম করবো। কারণ, তিনি রাত ২টায় আমাকে বাসায় পৌঁছে না দিলে আম্মু-আব্বু হয়তো বুঝতেই পারতো না যে আমি সত্যিই সিরিয়াস। যাই হোক, কোন একভাবে আমি মুক্তি পেলার সেই মাদ্রাসা থেকে, যা যেকোন পুলিশ প্রিজন বা কারাগারের চেয়ে অল্প একটু বেশি ভালো ছিল!

কিছুদিন ঘরেই ছিলাম। কিন্তু আমার জন্ম যেন ঘরে থাকার জন্য নয়। তাই আমাকে আবারো বাসার পাশের আরেকটি "কওমী মাদ্রাসা"য় ভর্তি করানো হয়। তখন আমি একেবারে হতবাক হয়ে যাই। এতোকিছুর পরও আবারো আমাকে সেই মাদ্রাসায়ই থাকতে হবে?
নতুন মাদ্রাসায় আমি মাত্র কয়েকঘন্টা ক্লাস করেছি। তারপর আর যাইনি। মা-বাবার জোরাজুরি উপেক্ষা করে মাদ্রাসা মিস দিয়েছি। নষ্ট করেছি তাদের কষ্টার্জিত কিছু টাকা, যা দিয়ে তারা আমাকে সেখানে ভর্তি করিয়েছিলেন।

অবশেষে তারা রাজি হলেন আমাকে জেনারেল লাইনে পড়াতে। কিন্তু দুঃস্বপ্নিল আট বছর তখনো শেষ হয়নি। আমাকে ভর্তি হতে হলো আবারও আরেকটি আলিয়া মাদ্রাসায়। তবুও আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। কওমী মাদ্রাসায় পড়ে মাওলানা হওয়ার শখ নেই। তারচেয়ে সাধারণ শিক্ষা মাধ্যমে আর দশটা ছেলের মতো এসএসসি এইচএসসি দেয়ারই শখ ছিল।

ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই আলিয়া মাদ্রাসায়। সেভেন, এইট এবং গত বছর নাইন পাশ করি এবং চলতি শিক্ষাবর্ষে দশম শ্রেণীতে প্রমোশন পাই। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে থাকতেই আমি আবারো বেহায়ার মতো জেদ ধরি স্কুলে ভর্তি করাতে। "মাদ্রাসার ছাত্র" ট্যাগটি আমি আমার শরীর থেকে খসাতে চাচ্ছিলাম। কোন ভালো সমাজেই "মাদ্রাসার ছাত্র" বলে তেমন একটা গুরুত্ব পেতাম না। নিজেকে নিকৃষ্টতম জীব মনে হতো যখন "মাদ্রাসার ছাত্র" শোনার পর শতকরা আটানব্বইজনকেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতাম।

কিন্তু যথারীতি আমার জেদ জেদই রয়ে গেল। অষ্টম শ্রেণী গেল। নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেল। তবুও স্কুলে নেয়ার জন্য তেমন কোন উৎসাহ দেখলাম না কারো মনেই। অবশ্য গত বছর ফেব্রুয়ারির দিকে একটা স্কুলে ভর্তি কনফার্ম করেছিলাম। কিন্তু মাদ্রাসা থেকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) কোনভাবেই না দেয়ায় ভর্তি হতে পারিনি আর।

এখন ২০০৯। সেই অভিশপ্ত আট বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এবার আমার সেই "অনেক বড় আবদার" স্কুলে পড়ার দূর্দান্ত আশাটা বোধহয় সত্যি হতে যাচ্ছে। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ আম্মু বললো স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আমি তখন অবাক। মাত্র কয়েকদিন পরই ভর্তি পরীক্ষা। আমার তো অষ্টম শ্রেণীর বইয়ের কিছুই মনে নেই। তবুও যদি চান্স পাই, সেই ক্ষীণ আশায় ভর্তি পরীক্ষা দিলাম মিরপুরের দুটি স্কুলে।

ভাগ্য ভালো ছিল। ফলাফলের দিন নিজের নামটা সবার উপরে দেখলাম। কল্পনাও করিনি ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হবো। তাও আবার দুই-দুইটা স্কুলেই। যাই হোক, অবশেষে একটা তে ভর্তি হয়েছি ফলস টিসি ব্যবহার করে। জানিনা ভবিষ্যতে অন্যত্র থেকে আনা টিসিতে কোন সমস্যা হবে কি না। যদি না হয়, তাহলে হয়তো এ যাত্রা বেঁচে যাবো।

আমার জীবনটা মাঝেমধ্যে খুব অবাক লাগে। স্কুলে পড়তে চাওয়ার মতো অনেক ছোট ছোট আবদার, আশা-আকাঙ্খা রয়েছে আমার মনে। কিন্তু সেগুলো কবে সত্যি হবে, বা আদৌ হবে কি না, কে জানে।

একটা প্রশ্ন আমার প্রায়ই মনে আসে। ইসলামের পথে পরিচালিত করতে হলে কি মাদ্রাসায় পড়ানো বাধ্যতামূলক? আমি যদি স্কুলে পড়েও ইসলামের সব নিয়মকানুন মেনে চলি, তাহলে কি আমার গুনাহ হবে? মাদ্রাসায় পড়া কি ইসলাম বাধ্যতামূলক করেছে? যদি এসবের উত্তর 'না' হয়, তাহলে আমার জীবন থেকে আট বছর মাইনাস হয়ে গেলো কেন? এর উত্তর, নিশ্চয়ই কারো জানা নেই।

সবার প্রতি দোয়া চাইছি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে আর পড়াশোনা ভালমতো চললে ২০১১ সালে ইনশাআল্লাহ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবো। একটু টেন্সড আছি অবশ্য। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির প্রথম প্রশ্নটাই আমার হাতে পড়বে। কোন ধারণাও নেই কেমন হবে প্রশ্ন। সারাদেশে নাকি ফেইলের হার বাড়বে। পাশের হার কমবে। সবাই অনুগ্রহ করে দোয়া করবেন। একটা ভালো রেজাল্ট যেন নিজেকে এবং পরিবারকে উপহার দিতে পারি।


[আনরেজিস্টার্ড পাঠকরা এখানে মন্তব্য করুন] ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৪
৩৩টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×