মাননীয় প্রতিমন্ত্রী,
প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করবার প্রয়োজন মনে করবার জন্যে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জবাবদিহিতার ব্যপারটি খুব কম দেখা যায়। সেই সংস্কৃতিতে আপনি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন-আপনাকে ধন্যবাদ।
উত্তর দেবার আগে আমার অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়ে দিয়ে নিতে চাই। আমি নিরাপত্তা বা আর কোন লক্ষ্যে কোন সময়ের জন্যে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের পক্ষে নই। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে বিতর্কটি শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে নয়-বরঞ্চ সমগ্র বাকস্বাধীনতার ব্যাপারটি নিয়ে। বাকস্বাধীনতা যদিও বাংলাদেশের অনেকের কাছে এখন একটি পরিহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে-কিন্তু আমি একজন রাজনীতিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে জানি যে যদি একটি অগণতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাঝে মোটামুটি মোটা দাগে একটি বিভাজন দেখাতে হয়-সেটি হবে বাকস্বাধীনতা। বাকস্বাধীনতাকে সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দিলে জনগণের ক্ষতি হতে পারে-এই অবস্থান থেকে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তারা হলো চীন এবং রাশিয়ার মতন স্বৈরাচারী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটিই এমন যে বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেই এবং বিরোধ করবেই। আপনি চীন এবং রাশিয়ার মডেলে বাংলাদেশ চালাতে পারবেন না। এই সত্যটি স্বৈরশাসকরা আগে বুঝেছে-অন্য কেউ স্বৈরশাসন চালাবার চেষ্টা করলে তারও বুঝতে হবে।
হ্যাঁ, বাকস্বাধীনতা-বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দেয়া প্রবর্ধিত বাকস্বাধীনতা একটি বিধ্বংসী ব্যাপার। এক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা,এমনকি জনগণের জীবনের ঝুকির মতন ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে পারে। যদি আপনি একটি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে ঘোষণা দিতে চান আপনাকে এই ঝুঁকিটি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে রাষ্ট্র জনগণকে সেই নিরাপত্তাটুকুন দিতে পারে। যদি আপনার মনে হয় আপনার জনগণকে তার বাকস্বাধীনতা দেবার মতন সক্ষমতা নেই-তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশের নাম করে দেশের জনগণের হাতে এই প্রবর্ধিত বাকস্বাধীনতা তুলে দেবার কথা আপনাদের দলগতভাবে বলাই ঠিক হয়নি।
যেই মুহুর্তে আপনি একটি রাষ্ট্রের সংবিধানে বলে দেন যে সেই দেশ জনগণকে বাকস্বাধীনতা দেয়, সেই মুহুর্তে আপনি জননিরাপত্তার ঝুঁকি হিসাবে বাকস্বাধীনতা রহিত করার অধিকার হারান। যদি আপনার সেটা করতেই হবে তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা জারি করে সরকারকে সংবিধান লঙ্ঘনের এখতিয়ার দিতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশে এখন জরুরি অবস্থা চালু নেই এবং আইনের শাসন জারি আছে, সরকারের কোনই অধিকার নেই যে জননিরাপত্তার খাতিরে জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে।
যদি জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সরকারের জনগনের স্বাধীনতাতেই হস্তক্ষেপ করতে হয়-তাহলে আর এতো টাকা দিয়ে সরকার পোষার কি দরকার ছিলো? সরকারের কাজই তো এটা-জনগণ অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে যেটা ইচ্ছা সেটা বলবে এবং করবে, আর সরকার সেটা করার ব্যবস্থা করবে। যদি কেউ অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে,সরকার তার বিহিত করে অন্যদের তাদের অধিকার চর্চা করতে দেবে। কয়েকজন অন্যের অধিকারের হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে সবার অধিকার বাজেয়াপ্ত করে দেই-এই সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য তো এডভোকেট তারানা হালিমকে লাগে না-রাম শাম যদু মধুকে দিয়েও চলে। যেহেতু আমরা আপনার মতন একজন গুণিজনকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পেয়েছি-আমরা আপনার কাছ থেকে আরও ভালো সিদ্ধান্ত আশা করতেই পারি।
এটুকু গেলো নৈতিক বিচার,এবারে ব্যবহারিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রেখে কতটুকু সংঘর্ষ এড়ানো গিয়েছে আমি জানিনা। যদি ফেসবুক বন্ধ করার কারণ হয় সন্ত্রাসীদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া, তাহলে বলে রাখি যোগাযোগের আরো হাজারো মাধ্যম চালু আছে। ইমেল বন্ধ করা হয়নি এবং আমার বন্ধুরা জানিয়েছে এন্ড্রয়েড এপ স্টোরের এমন আরো হাজারো এপ্লিকেশন রয়েছে যেগুলো দিয়ে এখনো তারা তাদের বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। তারচেয়েও বড় ব্যাপার, তাদের সেই বন্ধবীরা এখনও তাদের সাথে ঘুরতে বের হয়ে সেই ফেসবুকেই তাদের ট্যাগ করে ছবি আপলোড করছে। যে মানুষের সামান্য টেকনলজির জ্ঞান রয়েছে-সে-ই ভিপিএন ব্যবহার করে আমার চোখের সামনে ফেসবুক ব্যবহার করছে এবং তাদের করাও উচিত। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহ তার অধিকার, যে অধিকার লঙ্ঘন করার একটি অবৈধ প্রচেষ্টা সরকার চালাচ্ছে। একটি অবৈধ আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা অত্যন্ত বৈধ একটি কাজ করে যাচ্ছে।
এখন যদি আপনারা বলতে চান যে, আমার ফেসবুক বন্ধু ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছোটভাই যে 'ড্রিমবয় ড্রিমলেস'-নামের ফেসবুক একাউন্ট থেকে গতকাল প্রেমের কবিতা পোস্ট করেছে-সে যে ভিপিএন এর ব্যবহার জানে-সন্ত্রাসীরা সেই প্রযুক্তির ব্যবহার জানে না-তাহলে আমার আর কিছু বলবার নেই।
সবশেষ, আমি কেন ফেসবুক নিয়ে এতো কথা বলছি এবং কেন ফেসবুক নিয়ে আমার এতো মাথাব্যথা। কারণ,আমি ফেসবুকের মাঝে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত দেখি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি যে একটি দেশে যখন গণমাধ্যম গণমানুষের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যায়,তখন মানুষ কেমন করে মানুষের কথা থেকে-মানুষের তোলা ভিডিওর থেকে সত্যি খবর জানতে পায়। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে বিভিন্ন বিশ্বাসের বিভিন্ন মানুষ রয়েছে। যখন একটি ঘটনা ঘটে তখন আমি প্রত্যেকের স্ট্যাটাস কমেন্ট ঘুরে ঘুরে পড়ি। তখন সবার চোখ থেকে একবার একবার আমার ঘটনাটা দেখা হয়। সত্যি ঘটনাটা জানা যায়।
বাংলাদেশ গণতন্ত্রে খুব নবীন একটা দেশ। এদেশের গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করার জন্যে আমরা একটা অত্যন্ত চমৎকার হাতিয়ার পেয়েছি-সেটা হলো ফেসবুক। যেখানে যে ইচ্ছা,যা ইচ্ছা বলতে পারে। এখান থেকে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র শেখে। শেখে-কেমন করে কথার উত্তর শক্তি দিয়ে নয়-বরং কথা দিয়ে দিতে হয়। যারা মিথ্যা বলে,ভুল বলে, গুজব ছড়ায়-তারা একসময় নিচেই পড়ে থাকবে। তলানিতে পৌছে যাবে। দূর্বল কথা সবল কথার বিরুদ্ধতায় হারিয়ে যাবে। এইতো গণতন্ত্র।
আর যদি আপনার এই নীতিতে বিশ্বাস না থাকে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য গণতন্ত্রের ভং ধরবেন না প্লিজ। ওই শব্দটার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়ে গেছে। শব্দটা কাঁধে নেয়া মানে তাদের সবার মৃতদেহ কাঁধে নেয়া-এটা আমাদের জানতে হবে।
আবার বলছি-যদি কেউ ফেসবুক দিয়ে গুজব ছড়ায়ে মানুষ মারতে সক্ষম হয়-সেটা আবারও ফেসবুকের দোষ না-আমাদের সরকারের দোষ। সরকারের এগুলো আটকানোর ক্ষমতা থাকা উচিত। সাময়িকভাবে-এক মুহুর্তের জন্যেও যদি কোন গণতান্ত্রিক সরকারের জনগণের স্বাধীনতা রহিত করতে হয়-তবে সেই সরকারের জনগণের ট্যাক্সের টাকা পাবার অধিকার নেই। যদি জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে জনগণ মারা যায়-তার দায়ও আপনাদেরই নিতে অবে কেননা সেই মৃত্যু গণতান্ত্রিক দেশের সরকার হিসেবে আপনাদের ব্যর্থতাকেই সূচিত করে।
কাজেই এই তথাকথিত 'সাময়িক' পদক্ষেপকে আর দির্ঘায়িত করবার চেষ্টা করবেন না প্লিজ। চীনের রাস্তায় হাটবেন না। বাংলাদেশীরা বাংলাদেশী-বাংলাদেশীরা চৈনিক নয়।
নাশকতাকারীদের খুঁজে বের করতে যা ইচ্ছা হয় করুন-কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে। যদি তা না পারেন- হয় সরকার হিসেবে পদত্যাগ করুন অথবা বলে কয়ে স্বৈরাচারিতার নীতি গ্রহণ করুন। গিরগিটি খুব সুদর্শন প্রানী নয়-গিরগিটি দেখলে আমার ঘেন্না হয়।
ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৬