somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজয়ের মাসে প্রিয়দর্শিনী স্মরণে

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
We all dance to a mysterious tune, intoned in the distance by an invisible piper! Albert Einstein



বিয়ের আসনে গলায় ফুলের মালাপরা কনে মেয়েটির নাম প্রিয়দর্শিনী আর বর ছেলেটির নাম ফিরোজ জাহাঙ্গীর। প্রিয়দর্শিনী নামটা কবি গুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। ফিরোজ জাহাঙ্গীর বিয়ে করছেন কাশ্মীরের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মন পরিবারের এই একমাত্র সন্তানটিকে! যে বাড়িতে এই বিয়ে আসর বসেছে সেই বাড়িটার নাম "আনন্দ ভবন", বাড়িটা এলাহাবাদে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় যারা একটুখানি শিক্ষিত বা একটুখানি খোঁজখবর রাখতেন তাঁদের আর বলে দেবার দরকার হতোনা যে এই আনন্দ ভবন নামের বাড়িটা কার বাড়ী কিংবা এ বাড়ীর ঠিকানা যে এলাহাবাদ। বলে দেবার প্রয়োজন হতোনা কারণ, ঐ সময় দৈনিক কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার খবরে প্রায়ই এই আনন্দ ভবনের উল্লেখ থাকতো। প্রিয়দর্শিনী ও ফিরোজের বিয়ের এই সাদা কালো ছবিটা তোলা হয় বাহাত্তুর বছর আগে ২৯শে মার্চ, ১৯৪২ সালে।

আনন্দ ভবনের মলিক কাশ্মীর থেকে আসা ঐ কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মন পরিবারের একমাত্র সন্তান নিজ ধর্মের বাইরে কাউকেও বিয়ে করবে তা মেয়ের বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে আসা অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্বির পাহাড়ে বসে থাকা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তিনি দেখা করেছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু এক নেংটি পরা সৈন্যাসীর কাছে।

ঐ সৈন্যাসীটি আবার কেবল ঐ মেয়েটির বাবার দীক্ষাগুরুই ছিলেননা শুধু।
উত্তরে হিমালয়, দক্ষিনে কন্যা কুমারীকা, পশ্চিমে বেলুচিস্থানের মরুভূমি আর খাইবার গিরিপথ থেকে পূর্বে বার্মার আরাকান সীমান্ত অবধি এক বিশাল জন গোষ্ঠির তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট, কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মনি। হৃদয়ের মনি, কারন পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির এই ছোট্ট মানুষটি শুন্য হাতে লড়াই করছিলেন ভারতবর্ষকে প্রায় দু'শ বছর ধরে দখল করে রাখা তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তির সাথে! মেয়েটির বাবা এ বিয়ে থামাতে করজোড়ে মিনতি করেছিলেন লাঠি হাতে, চশমা চোখে, বিলেত থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করে আসা তাঁর দীক্ষাগুরু মোহন দাশ করমচাঁদ গান্ধীর কাছে। গান্ধী কিছুই করতে পারেন নি। পারেন নি, কারণ এ যে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার। এখানে তাঁর কিছুই করবার ছিলনা! বাবার দু'নয়নের অশ্রু নয়নেই শুকিয়ে গিয়েছিল!

বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে শান্তিনিকেতন তার পুরানো ভর্তি খাতা খুললে দেখা যাবে এই মেয়েটি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন এক সময় কিছুদিনের জন্য । রবি ঠাকুর এই নুতন ছাত্রীটির আলাদা নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী - মেয়েটির পুরো নাম দাঁড়িয়েছিল ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। "প্রেমেরই ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!" মোটামুটি ছেলেবেলা থেকেই এই সাদা কালো ছবির বর-কনেটির পরস্পরের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা দু'জনকে দু'জনার অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। অজান্তেই ওঁরা পরস্পরের হৃদয়ে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন! কিন্তু সেই ফাঁদ আরো শক্ত বন্ধনে ওঁদের বেঁধেছিল ওঁরা যখন লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী!

বিয়ের আসনে বসা মেয়েটিকে আগুন সাক্ষী রেখে পুরোহিত হয়তো বিয়ের মন্ত্র পড়িয়ে শোনাচ্ছেন "যদিদং হৃদয়ং তবঃ তদিদং হৃদয়ং মমঃ - তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় হোক তোমার"। এই ছবি তোলার ২৯ বছর পর ছবির এই মেয়েটির হুকুমেই ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। বিয়ের এই কনেটির নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু। বিয়ের আসনে বসা এই মেয়েটিই পরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতন্ত্রের একশ কুড়ি কোটি মানুষের ভাগ্যদেবী হয়ে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এই মেয়েটির নির্দেশেই নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে বন্দী করে নিজের দেশে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে অনেক ভারতীয় পত্রিকা এই মেয়েটির নামের সামনে উল্লেখ করতো আয়রন লেডি!

ছেলে বেলায় দাদাভাই নৌরোজী, জামশেদজী টাটা নাম গুলো শুনে খুব কৌতুহল হতো - এদের নাম গুলো এমন কেন! কি এদের পরিচয়! শুনতে পেতাম ওরা যেমন মুসলমান নন তেমনি ওরা আবার হিন্দুও নন!

ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সাথে সাথে এই নুতন ধর্ম যেমন দ্রুত বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তেমনি মুসলমানদের বীরত্বের কাছে হেরে গিয়ে একের পর এক দেশ মুসলমানদের অধিকারে আসা শুরু হয়! এখনকার ইরান তখন পরিচিত ছিল পারস্য নামে আর পারস্যবাসীদের ধর্ম ছিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জোরাষ্টার প্রবর্তিত এক ধর্ম। অনেক প্রাচীন এই ধর্মে উপাসনার একটা বিশেষ দিক ছিল আগুন, তাই অনেক সময় ওরা অগ্নি উপাসক বলেও আখ্যায়িত হতো।

মুসলমানেরা যখন পারস্য সীমান্ত রেখার কাছাকাছি এবং যে কোন সময় দখল করে নেবে সেই সময় জোরাশট্রিয়দের একটা অংশ পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ভারতের মুম্বাই ও গুজরাট এলাকায়। পারস্য থেকে থেকে এসেছে বলে ভারতীয়দের কাছে ওদের পরিচয় হয় পার্শী সম্প্রদায় হিসেবে!

পৃথিবীর সব ধর্মেই মৃতদেহ সৎকার করা হয় প্রধানতঃ দু'টো উপায়ে। মরদেহ দাহ করে অথবা মাটিতে কবর দিয়ে। কিন্তু পার্শী সম্প্রদায়ের মরদেহ সৎকার যেমন বিচিত্র তেমনি অদ্ভুত। মুম্বাইয়ে বিশাল উঁচু ইটের দেয়ালে গোল করে ঘেরা একটা জায়গা আছে ওদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য। প্রথমে বাড়ীতে ও পরে ওদের উপাসনালয়ে মৃতের জন্য যথারীতি প্রার্থনা শেষে মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে সম্পুর্ন বিবস্ত্র অবস্থায় ঐ প্রাচীর ঘেরা জায়গায় রেখে আসা হয়! সেখানে শকুন/কাক মৃতদেহ খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলে। আগুন ও মাটি দু'টিই অতি পবিত্র বলে মৃতদেহকে ছুঁতে দেওয়া হয়না!

আজকের স্বাধীন ভারতে ওদের সংখা এক লক্ষের কিছু কম কিন্তু অর্থ, বিত্ত আর শিক্ষা দীক্ষায় ওরা প্রথম সারিরও প্রথমে! ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিত দাদাভাই নওরোজী, টাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি স্যার জমসেদজী টাটা, যাঁর নামে জমশেদপুর নামে আলাদা একটা শহর গড়ে উঠে, গোদরেজ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা আরদেশির সরাবজী গোদরেজ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানিকশ যাঁর অধীনে জেনারেল অরোরা বাংলাদেশে যুদ্ধ করেছিলেন আর বিয়ের এই সাদা কালো ছবির বর ছেলেটি ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী এঁরা সবাই কিন্তু ইরান থেকে পালিয়ে আসা ঐ জোরাশট্রিয়দের পরবর্তী বংশধর - ভারতে যাঁদের পরিচয় পার্শী সম্প্রদায়।

ছবির ডান দিকে বসে আছেন কনের ফুপু বা পিসি - বাবা জহরলাল নেহেরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত - জাতিসংঘে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত। পরে গুজরাটের রাজ্যপাল (গভর্নর)।

একমাত্র সন্তানের বিয়ে অথচ বিয়ের ছবিতে কনের মা-কে দেখা যাচ্ছেনা কেন? কোথায় তিনি? তিনি কি এ বিয়ে মেনে নিতে পারছিলেন না বলে দুরে সরে থাকলেন? চমৎকার প্রশ্ন! মেয়েটির মা কমলা নেহেরু রাজরোগ যক্ষায়, অকালে, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ভারতবর্ষের মাটি থেকে অনেক অনেক দুরে সুইজারল্যান্ডের এক স্যানিটারীয়ামে, ১৯৩৬ সালে শয্যাপাশে একমাত্র সন্তান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী ও স্বামীর মা স্বরূপ রানীর উপস্থিতিতে দেহ রেখেছিলেন! চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে!!



Everything is determined by the forces over which we have no control. It is determined for the insects as well as for the stars, human beings, vegetables or cosmic dust! We all dance to a mysterious tune, intoned in the distance by an invisible piper! Albert Einstein






সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×