ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং মহানগরের সর্বশেষ কেনা শ্বেতবর্ণ ট্রেনগুলোর ভেতর সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিক এবং সামাজিক অংশটি হচ্ছে বগিগুলোর ঠিক মাঝখানের চারটি করে মুখোমুখি আটটি আসন। তথাপি ঐ অংশে সিট পড়লে খুব কম লোকই খুশি হন। তবু, সেখানে যারাই বসেন না কেন, একে অপরের অপরিচিত হওয়া স্বত্বেও পথে অবশ্যই গল্পগুজব জুড়ে দেন এবং রীতিমত পথভর জম্পেশ আড্ডা পিটিয়ে পারলে পরস্পরের ফোন নম্বর মোবাইল দাবা করে তবেই অবতরণ করেন। এমন কি এই অংশের যাত্রীদের কেউ যুবক-যুবতী হয়ে থাকলেও (যারা সাধারণত যাত্রাপথে কিছুটা একান্ততা কামনা করেন এবং জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখতেই পছন্দ করেন বেশি) তাদেরকেও একরকম বাধ্য হয়েই গল্পগুজবে অংশগ্রহণ করতে হয়। চা-পর্বে আন্তরিকভাবে সাধা (কিছুটা জোরজবরদস্তিরও) চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আর যাই হোক, গল্পগুজব, আলাপআলোচনা উপেক্ষা করে বাইরের দিকে চেয়ে থাকা, বইয়ে মুখ গোজার চেষ্টা করা কিংবা কানে 'ইয়ার-ফোন' সেঁধিয়ে কালা সাজা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠে না। জানালার মিষ্টি রোদ, চলমান গ্রামীণ দৃশ্যাবলীর কারণে ট্রেনের ভেতরের আরামপ্রদ আবহে উৎসাহ পাওয়া আড্ডাতে সবাক-ভাবে অংশগ্রহণ না করতে চাইলেও, অন্তত হাসি মুখে ঈষৎ অবাক ভঙ্গীতে কথাবার্তা শুনতে শুনতে (কিংবা শোনার ভান করে) সম্মতিসূচক মাথা তো নাড়তে হয়’ই! এ থেকে রেহাই নেই।
যাহোক, এটা মূলত ছিল মাত্র কিছুদিন আগের কথা। তখনও স্মার্ট-ফোন,ট্যাব, নোট, প্যাড ইত্যাদি যাদুকরী এবং সুবহ যন্ত্রগুলো সাধারণের সাধ্যের ভেতর চলে এসে বাজারে ছয়লাপ হয়ে যায়নি। এদের প্রয়াত প্রজন্ম যা শুরু করেছিল, তা সফলভাবে, বৈপ্লবিক দ্রুততায় বাস্তবায়ন করেছে এই স্মার্ট যন্ত্রগুলো। এদের আবিষ্কার ও আগমন সবকিছু ব্যাপক পাল্টে দিয়েছে। দারুণ ক্ষমতাবান, স্বয়ংসম্পূর্ণ এরা! কী নেই এই ছোট ছোট ঐন্দ্রজালিক বাক্সগুলোতে? এরা এক তুড়িতে একজন মানুষের যেকোনো অনলাইন-অফলাইন চাহিদা পূরণ করতে পারে, চোখের পলকে মানবিক-অতিমানবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে! এদের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, এদের আহ্বান অনতিক্রম্য। যেমন, আজ সকালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার সময় আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম এক সময়কার আন্তঃনগর ট্রেনের সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ, উষ্ণ এবং আন্তরিক অংশ- সেই মুখোমুখি আটটি আসনে বসেছিল প্রায় মূক আটজন ব্যক্তি যারা আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র ফোনে ও চা-খাবার বিক্রেতার সাথে কথা বলতে সক্ষম। এক দিকের পাশাপাশি দুটি আসনে বসে ছিল দুজন কম বয়সী ছেলে। এদের একজনের হাতে ছিল সাদা রঙের একটি বিশালাকারের ট্যাব। সারাটা পথ মিটি মিটি হাসাহাসি করছিল সে যন্ত্রটির সঙ্গে, কানে কানেক্টেড হয়ে। তার পাশের জনের অবস্থা ছিল এই অবস্থার অবিকল নকল! শুধু দ্বিতীয়জনের স্মার্ট-যন্ত্রটি ছিল আকারে প্রথম জনেরটির তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট এবং যে তারটির দ্বারা সে নিজেকে যন্ত্রটির সাথে সংযুক্ত করেছিল, তার রং ছিল কুচকুচে কালো ও ধুলো-হীন। হয় সে বেশ পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, পরিপাটি অথবা এরকম বায়ুরুদ্ধ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস করে সে অভ্যস্ত। তারা কী দেখছিল? ছবি, গান? হয়ত বই পড়ছিল!
তাদের মুখোমুখি বসেছিল দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। তাদের একজন বেশ লম্বা; দোহারা গড়নের; তার ছোট করে ছাটা চুল কানের কাছে কিছুটা সাদা হয়ে এসেছে কিন্তু মুখের চামড়া এখনো টান টান, উজ্জ্বল-বর্ণ। ভদ্রলোকের মুখের কাছটায় আরোপিত সৌম্যতা স্পষ্ট, কিন্তু থুতনিটি সত্যি সত্যি আত্মবিশ্বাসে সুদৃঢ়! কোনও বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (বহুজাতিক হবার সম্ভাবনা বেশি) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবেন হয়ত, যিনি নিশ্চিত করেন তার আদেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। অথবা স্বাধীন ব্যবসা করেন। এবং ব্যবসাটি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। তিনি তার পাশে বসে থাকা মাঝারী আকারের ভদ্রলোকের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন হাসি মুখে, যদিও ঐ ভদ্রলোকও সামনের ছেলে দুটির মত গান শুনতে পছন্দ করেন খুব। তার জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে উঁকি দেয়া দৃশ্যত ব্যয়বহুল যন্ত্রটির প্রতি কোনও মোহো থেকেই কিনা জানি না, কিন্তু পাশের সেই সম্ভ্রান্ত চেহারার আলাপী-দর্শন যাত্রীর সাথে কথা বলতে মোটেও উৎসাহ পাচ্ছিলেন না তিনি। উদাসীন, নিদ্রাতুর তার চেহারা। দোষ দেয়া যায় না। নিজের একাকীত্বকে উপভোগ করার অধিকার সব বয়সের মানুষেরই আছে। তবে এরকম বয়স্ক লোকদের মধ্যে মোবাইল জাতীয় যন্ত্রের প্রতি অমন আগ্রহ সচরাচর চোখে পড়ে না।
এই চারজনের আসনের বিপরীত পাশে একদিকের দুটি আসনের একটিতে বসেছিলেন পাঞ্জাবী পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, যিনি পুরোটা রাস্তা পরে পরে ঘুমচ্ছিলেন। তার কাছে কোনও স্মার্ট ফোন ছিল না; তাই এই বর্ণনার চিত্রানুপাত বিবেচনায় মানুষের আন্তঃসম্পর্কে স্মার্ট-ফোনের প্রভাব সনাক্তকরণে এই ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না। ঘুমপাগল ভদ্রলোকের পাশে বসেছিল তার ছেলে। চোখে ভারী চশমা ছিল ছেলেটির; মুখে সদ্য ওঠা মিহি দাড়ি-মোচের রেখা। কত... আঠারো, উনিশ হবে বয়স! তার আড়াআড়িভাবে বিপরীত দিকের আসনে বসা সেই দুটি ছেলের সমান হবে। তার হাতে যে ফোনটি শোভা পাচ্ছিল, সেটি স্মার্ট না হলেও, আনস্মার্ট ওটাকে বলা চলে না। বরং এর ক্ষমতা যে স্মার্ট-যন্ত্রের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, তা প্রমাণ করতেই যেন ছেলেটি রীতিমত নাকের কাছে ফোনটি গুজে রেখেছিল সারাটা পথ। তার মুখে (ও চশমায়) এসে পড়া মুঠোফোনের আলোকিত পর্দার বিচ্ছুরিত রং ছিল গাঢ় নীল।
আর তাদের মুখোমুখি বসেছিল এই আট আসনের মধ্যে সবচেয়ে অনুজ্জ্বল এবং সবচেয়ে কম কৌতূহলোদ্দীপক দুজন ভদ্রলোক যাদের বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে যে কোনও কিছু হতে পারে। তাদের একজন... অবশ্যই আমি। এবং আমিও সারাটা পথ রবি ফ্রম টুমরো আর কায়ার আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে ধুমধাড়াক্কা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে কিছুক্ষণ জানালায় ছোট ছোট দ্বীপের মত গ্রামগুলোকে কোলে নিয়ে গভীরে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়া সবুজ ধানক্ষেতের হ্রদ, সাদা বকে ভরে থাকা সবুজাভ জলাভূমিগুলোকে দেখার ফাঁকে ফাঁকে এদেরকে দেখছিলাম গুপ্তচরের মত কুচকুচে কালো রোদচশমা চোখে। তবে আমার পাশে যে বসে ছিল তাকে লক্ষ্যই করা হয়নি। আমার মোবাইল ফোনখানাও স্মার্ট কিনা!