১।
কোটরের গভীর থেকে গভীরে ডেবে যাওয়া একজোড়া নিষ্প্রাণ লাল চোখ , উসকো খুশকো চুলগুলো কাঁধের উপর দিয়ে আলতো করে ছড়িয়ে আছে বুকের উপর । উদ্ভ্রান্ত-বিহ্বল দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা । বা' হাতের আঙ্গুলগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছে ।
মেয়েটার নাম সৃজনি । তানজিলা তাসনিম সৃজনি । ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করে । চতুর্থ বর্ষ ! আর মাত্র একটা বছর ,তারপরেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যাবে ।
হাহ ! গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো সৃজনির বুক থেকে । ডান হাতের মুঠোতে দলা পেঁচানো কাগজটা খুলতেই বেরিয়ে পরলো পলিথিনের ছোট একটা প্যাকেট । প্যাকেট ভর্তি সাদা সাদা ক্ষুদে ক্রিস্টাল দানা ! প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল সৃজনি । তারপর দশ ডলারের একটা চকচকে নোটকে সরু পাইপের মতো করে পেচিয়ে নিল ।
সৃজনির চোখভর্তি ঘোলাটে মাদকতা । পারকিন্সনস পেসেণ্ট এর মতো কম্পমান হাতে কাগজের নলটাকে নাকের ছিদ্রে প্রবেশ করালো ।
দু' মিনিট পর _
চেয়ার থেকে ছিটকে ফ্লোরের উপর বিদঘুটে ভঙ্গিতে পরে আছে সৃজনি । কপালের এক পাশ থেকে সরু ধারায় বেরিয়ে আসছে রক্ত , মুখে ভীতিকর অস্ফুট গোঙ্গানি । বা' হাতে দলা করে পেঁচানো এক খণ্ড সাদা কাগজ ।
২ (১) ।
বুকের ভিতরে ধুবধুব শব্দ হচ্ছে । মনে হচ্ছে তীব্র আক্রোশে হৃদপিণ্ড বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে । সামান্য দূরের স্থির চেয়ারটা হুট করে নড়ে উঠলো । গ্র্যাভিটেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যাচ্ছে । চোখের উপর বা ' হাত দিয়ে ঘষা দিল নওসাদ । চোখের উপর হাতের স্পর্শ অনুভব করছেনা ও । ভীত চোখে হাতের দিকে তাকালো । তিরতির করে কাঁপছে আঙ্গুলগুলো ।
মাথা তুলে দেয়ালের দিকে তাকালো ও । দেয়ালের সাদা রঙ্গের শরীরে অশরীরী সব রঙ্গের নিত্য । প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাথার নিউরনগুলো যেন ছিঁড়ে যাবে । রক্তের শিরা গুলো ট্রেনের সাইরেনের মতো ভাইব্রেট করছে । গলা দিয়ে গোঙ্গানির মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে নওসাদের । চোখের সামনের পৃথিবী এক পলকে যেন নড়ে উঠলো । ঘরের দেয়ালগুলো ছুটে এসে চেপে ধরল ওকে ।
২ (২) ।
' Imagination is more important than anything ! এই ছেলে ! কি বলছি শুনছো ? '
চোখ খুলে তাকাল নওসাদ । পাঁটের আঁশের মতো সাদা চুল মানুষটার , অগোছালো । নাকের নিচে ভারী গোঁফ । মুখ থেকে প্রায় ছয় ইঞ্চি দূরে স্থির অবস্থায় ভাসছে একটা পাইপ । পাইপের ছিদ্র থেকে সরু লাইন করে মানুষটার খোলা মুখের দিকে ছুটে আসছে ধোঁয়া । আর বেরুচ্ছে চোখ , নাক আর কানের ছিদ্র দিয়ে । ভয়ানক অবাস্তব দৃশ্য । মানুষটার সাথে ও নিজেও শূন্যে ভাসছে । কি ঘটছে এসব !
' আপনি কে ? ' খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করলো নওসাদ । কিন্তু অবাক হয়ে দেখল গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না ।
মানুষটা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল । ঠোঁট নড়ার কোন চিহ্নই দেখা গেলো না কিন্তু ও পরিস্কার শুনতে পেল মানুষটার কণ্ঠ । ' আমি আইনস্টাইন ! তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় টুকটাক পড়াশোনা জানা মানুষ । ১৯২১ এ একটা নোবেল প্রাইজও পেয়েছি ।অবশ্য সেটা কোন বিষয় না । তারপর বল তুমি কেমন আছ ?'
নওসাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল । ' ভালো না । শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ । আপনি এখানে কি করেন ?'
' তেমন কিছু না । আড্ডা দেয়ার কোন মানুষ খুজে পাচ্ছিলাম না । তাই ভাবলাম তোমার সাথে কিছুক্ষন গল্প করা যাক । ' খেক খেক করে হাসল আইনস্টাইন ।
' ও । ভালো করেননি । আমার মাথা ভর্তি যন্ত্রণা । এখন আপনার সাথে গল্প গুজব করতে ইচ্ছে করছেনা । আপনি বিদেয় হন তাড়াতাড়ি । '
আইনস্টাইন মন খারাপ করে তাকাল । ' যেতে ইচ্ছে করছেনা তো । তুমি বরং চা খাও । শরীরটা ভালো লাগবে । দাড়াও আমি তোমার জন্য চা আনাচ্ছি । '
ঘরের দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচে আওয়াজে খুলে গেলো । শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে এলো দু ' কাপ চা ।
নওসাদ আর্তনাদ করে উঠলো । ' এটা কি ?'
আইনস্টাইন মুচকি হাসলেন । ' টেলিকাইনেটিকস ! '
' টেলিকাইনেটিকস ! আপনি টেলিকাইনেটিকস এ বিশ্বাস করেন ! চোখ বড় বড় করে আইনস্টাইনের দিকে তাকাল ও ।
' হুম । করি । ক্যান করবোনা বাছা !আজকালকার পদার্থবিদরা মনে করে জগত পদার্থবিদ্যার সূত্রের বাইরে যায়না । সব অপদার্থ । ম্যাটাফিজিক্স সম্পর্কে এদের কোন ধারনাই নাই । এইরকম একটা উচ্চস্তরের গাধা হল ম্যাক্স প্লাঙ্ক । কোয়ান্টাম ফিজিক্স আবিস্কার করছে গাধাটা । কোয়ান্টাম তত্ত ইন হিস এসহোল ! এই রুমের দিকেই তাকাও দেখ চেয়ার টেবিল এমনকি আমরাও গ্রিভিটিকে কাঁচকলা দেখিয়ে কেমন ভাসছি । দেখ দেখ , ওই ফুলদানিটার কনাগুলাও লেভ্ররোটেটরি । গাধা পদার্থবিদরা এই জিনিসের কি ব্যাখ্যা দিবে বল দেখি ? ওমা ! এই ছেলে তোমার কি যন্ত্রণা হচ্ছে ? ' নওসাদের বাকিয়ে উঠা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আইনস্টাইন ।
' হুম ! অসম্ভব । মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার ।বকবক বন্ধ করেন তো আপনি । মেয়েটার ছবি চোখের সামনে ভাসছে । ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে । ভীষণ । '
' কোন মেয়ে ! ও আচ্ছা বুঝেছি !মেয়েটা তোমাকে ভালবাসেনা তাই তো ? '
নওসাদ মাথা উপরনিচ করলো ।
আইনস্টাইন গম্ভীর গলায় বললেন , ' আলো বেঁকে যায় , জানতো । সূর্যের প্রচণ্ড গ্রেভিটেসনাল এনার্জিকে উপেক্ষা করতে পারেনা । এখানেই আলোর পরাজয় । পুরুষরা হল আলোর মতো সোজা পথে ছুটতে থাকে কিন্তু যখনই সূর্যের কাছাকাছি আসে সে বেঁকে যায় । কাজেই কখনোই সূর্যের কাছাকাছি যাওয়া উচিৎ নয় । '
' আপনার কথা বার্তা পুরো পাগলের মতো । মেয়েরা সূর্য হয় কিভাবে ! আপনি ফোটেন এখন । '
আইনস্টাইন নিজের মনে বিরবির করতে করতে মুখ বাকিয়ে অন্য দিকে ঘুরে বসলো । কাঁধের ছয় ইঞ্চি উপরে শূন্যে ভাসছে একটা ভায়লিন । বিষণ্ণ একটা সুর বাজছে ।
নওসাদের চোখের সামনে এক টুকরো কাগজ ভাসছে । নওসাদ মনে মনে ভাবছে _
' আমি কেউ ছিলাম না । আমি কেউই থাকবনা । শুধু ভালবাসা টিকে থাকবে যন্ত্রণাদায়ক অনুভুতিগুলোর ইলেকট্রন আর কোয়ার্কের কনফিগারেশনে ! তোমার জন্য ভালবাসা । '
৩ ।
সৃজনি আধ খোলা চোখে বা' হাতের দিকে তাকাল ।ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে তুলে দেয়ালের সাথে ঠেশ দিয়ে বসলো । হাই তুলতে তুলতে হাতের দলা মোচড়া করা কাগজটা খুলে চুখের সামনে ধরলো । গোটা গোটা হরফে কিছু লেখা । হাতের লেখা ঠিক বলা যায়না আবার কম্পিউটার কম্পোজ ও না ! কেমন যেন বিদঘুটে হরফ গুলো । কাগজের টুকরোটা চোখের আরও কাছে নিয়ে এলো ও ।তাতে লেখা _
' আমি কেউ ছিলাম না । আমি কেউই থাকবনা । শুধু ভালবাসা টিকে থাকবে যন্ত্রণাদায়ক অনুভুতিগুলোর ইলেকট্রন আর কোয়ার্কের কনফিগারেশনে ! তোমার জন্য ভালবাসা ' ।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৃজনি ।চোখ থেকে গাল বেয়ে ফোটায় ফোটায় জল গড়িয়ে পরছে ।মৃদু স্বরে ও বলল _ ' তোমার জন্য ও ভালবাসা । '
৪।
আজিমপুর কবরস্থানে আমার প্রায়ই যাওয়া হয় । ওখানে গেলেই আমি ২১ নাম্বার ব্লকের প্রথম কবরটার সামনে দাড়াই , একটু অগোছালো কবরটা । অযত্নে বাড়তে থাকা লতা পাতায় এপিটাফ ছেয়ে গেছে । অস্পষ্ট এপিটাফের গায়ের লেখাটা অনেকটা এরকম_
' আমি কেউ ছিলাম না ।আমি কেউই থাকবনা । শুধু ভালবাসা টিকে থাকবে যন্ত্রণাদায়ক অনুভুতিগুলোর ইলেকট্রন আর কোয়ার্কের কনফিগারেশনে ! তোমার জন্য ভালবাসা ' ।
_ নওসাদ ।