মুম্বাইয়ের কোনও স্টেশনের লেডিস প্লাটফর্ম।
আপ আন্ধ্রা কা হ্যায় কেয়া
মুম্বাইয়ে যেয়ে ভ্রমণে এতোটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে বেশ কিছুদিন দাড়ি শেভ করা আর হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ একদিন দেখলাম, দাড়ির কারণে চেহারাই দেখা যাচ্ছে না। একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে আঁতকে উঠেছিলাম, আরে এটা কি মানুষ না ভাল্লুক! হা হা হা। একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দাঁড়িয়ে আছি মসজিদ বন্দর স্টেশনের প্লাটফর্মে। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় নামবার প্রশ্নই আসে না। হাতে ছাতাটাতা নেই, ব্যাগ সামলাতেই হিমসিম খাচ্ছি, আবার ছাতা! এদিকে বৃষ্টি থামবারও কোনও নাম নেই। কি আর করা! ভাবলাম দূরে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। পাশের একজন ভদ্রলোককে এসময় জিজ্ঞেস করলাম, 'অমুক জায়গার ট্রেন কখন কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে?' ভদ্রলোকের সাথে আরও কিছু আনুষঙ্গিক কথা হলো এই ব্যাপারে। অবশ্যই হিন্দিতে। লোকটা বেশ অবাক হলো, এতো ভালো হিন্দি জানে, অথচ মুম্বাইয়ের পথঘাট সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, বিষয়টা কি! ততক্ষণে সে বেশ বুঝে গিয়েছে, যতো ভালো হিন্দিই বলি না কেন, আমি কিছুতেই মুম্বাইয়ের স্থানীয় নই, বাইরের কোনও রাজ্য থেকে এসেছি। এসময় ভদ্রলোক আমাকে বেমালুম প্রশ্ন করে বসলো, 'আপ আন্ধ্রা কা হ্যায় কেয়া?' (আপনি অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এসেছেন কি?)
তার একথা শুনে হা হা হা করে সশব্দে হেসে উঠলাম সেখানেই। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার অমন বড় দাড়ির কারণে আমাকে অন্ধ্র প্রদেশের অধিবাসী ভেবে বসেছে। ওই দিকে, মানে ভারতের দক্ষিণের সিনেমাতেও দেখেছি, বেশিরভাগ মানুষেরই বড়বড় দাড়িগোঁফ থাকে।
'কিউ কিসিকে সাথ শকল মিলতি হ্যায় কেয়া?' (কেন, কারও সাথে কি চেহারা মিলছে?) হাসতে হাসতে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম তাকে।
আমার কথায় সেও হেসে ওঠে। হা হা হা।
নিটোল মজার একটি স্মৃতি। সত্যি ভ্রমণের এইসব ছোট ছোট মজার ঘটনা আজ মনে পড়লে মিষ্টি সুখানুভবে ভরে যায় মন। সব বিষণ্ণতা আপনা আপনি দূর হয়ে যায়।
পবিত্র মাস চলছে
আরেকদিন বান্দ্রার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার একটি মুসলিম হোটেলে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য গিয়েছি। মুসলিম এলাকাতেই ভাত, বিরিয়ানি, মাংস ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়া মুম্বাইয়ে ভাতের তেমন প্রচলন নেই বললেই চলে। সেখানে পাউরুটির জয়জয়কার। আগেই বলেছি মুম্বাইয়ের মানুষের পাউরুটি প্রীতি আমাকে ভীষণ বিস্মিত করেছে। জানি না পৃথিবীর আর কোথাও এমন পাউরুটি প্রিয় জাতি আছে কিনা। ওখানে ছোটবড় হোটেল রেস্টুরেন্টের সত্তর শতাংশ খাবার পাউরুটির তৈরি, হরেক পদের বার্গার, হট ডগ, বড়া পাও, ভাজ্জি পাও ইত্যাদি। পাউরুটি ছাড়া তেমন কিছু নেই! এছাড়াও সারা মুম্বাইজুড়ে দেখেছি লাইন দিয়ে মানুষ পাউরুটি দিয়ে বানানো বিভিন্ন খাবার খেয়ে থাকে। বড়া পাও তো ওদের একেবারে জাতীয় খাবার। মুম্বাইয়ে আমেরিকান ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস চুটিয়ে ব্যবসা করছে। অনেকগুলো শাখা আছে তাদের। সেখানে তাদের মেনু মূলত নানান রকম বার্গার ও পাউরুটি দিয়ে বানানো অন্যান্য খাবারে ভরপুর। উমম.. ওদের মেনুতে আমি বোধহয় বড়া পাওও দেখেছিলাম! হা হা হা। ঠিক মনে করতে পারছি না এখন। আমি নিজেও শখ করে বেশ কয়েকবার ওদের আউটলেট থেকে বিভিন্ন বার্গার কিনে স্পটেই দাঁড়িয়ে খেয়েছিলাম। খুব যে আহামরি দাম, তা নয়, পচিশ ত্রিশ রুপিতেই ওদের এগ ও ভেজিটেবল বার্গার পাওয়া যায় সেখানে। এমনি মুখরোচক খাবার আরকি! পচিশ ত্রিশ রুপির পঞ্চাশটা বার্গার খেলেও আমার পেট ভরবে না। অন্যদের কথা জানি না। এছাড়াও আমি বার্গার খাবারটা মোটেই তেমন পছন্দ করি না। বার্গার অত্যন্ত বিরক্তিকর আমার কাছে। সুতরাং বার্গার কেমন ছিল এপ্রশ্ন একেবারেই অবান্তর আমার জন্য। বার্গার মোটেও কোনও সুস্বাদু খাবার নয়! এই ফাঁকে একটা কথা সবাইকে জানিয়ে রাখি, যারা বার্গার খেতে পছন্দ করেন, তাদের যদি সুযোগ থাকে, তবে জীবনে একবার হলেও মুম্বাই যাওয়া উচিৎ! বার্গারময় একটি শহর! ওদের বড়া পাও তো একপ্রকার বার্গারই, ছোট গোল একটি পাউরুটির ভিতর আলুর একটা গোল চপ। কী ভীষণ জনপ্রিয় সেখানে!
যাই হোক। আন্ধ্রার সেই মুসলিম হোটেলে দেখলাম, দরজার সামনে বেশ খানিকটা জায়গা কেমন যেন নোংরা একটা কাপড় দিয়ে ঘেরা। বুঝলাম না ব্যাপারটা, হোটেলের সামনে অমন নোংরা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছে কেন ওরা, অদ্ভুত! যাই হোক সেখানে পেট পুরে রুটি আর আলু মটর খেলাম। পরিকল্পনা ছিল ভাত বা বিরিয়ানি খাবার, হঠাৎ শেষ মুহূর্তে মন চাইলো, আলু মটর আগে যেহেতু কখনও খাইনি, খেয়ে দেখি কেমন লাগে? সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল, বিল দিতে গিয়ে দেখলাম আলু মটরের দাম বিরিয়ানি ও মাংসের থেকেও বেশি। খেতেও বিশেষ কিছু না, বাংলাদেশের চটপটিরই মতো। বিল দিয়ে ফেরার সময় কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে বৃদ্ধ হোটেল মালিককে জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'চাচা ইয়ে পর্দা কিউ দিয়া ইহাপে?' (এই পর্দা কেন দিয়েছেন এখানে?)
'রমজান কা মাহিনা হ্যায় না?' (রমজান মাস চলছে না।) জবাবে জানালেন তিনি।
এবার সব পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এখনও রমজান শেষ হয়নি। রমজানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য দরজার সামনে বেশ কিছুটা জায়গা পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে যাতে ভিতরটা দেখা না যায়। খুব ভালো লাগলো ব্যাপারটা। আমাদের দেশেও দেখেছি রোজার মাসে এভাবে পর্দা দেয়া হয়। পবিত্র মাসের পবিত্রতা বলে কথা।
লেডিস প্লাটফর্ম
ঠিক কোন স্টেশনের প্লাটফর্ম এখন আর মনে নেই। হঠাৎ এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় যেয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যানের নিচে বাতাস খেতে খেতে বিশ্রাম নিতে লাগলাম আমি। বেশ ক্লান্ত ছিলাম। খানিকক্ষণ পর চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, আশেপাশে আমি ছাড়া আর কোনও পুরুষ নেই। সামনে একদল নারী ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত। আজব! বেশ কয়েকজন মহিলাকে দেখলাম কটমট করে আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। পরে ইতিউতি তাকাতে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। সেখানে একাধিক ভাষায় পরিষ্কার লেখা, 'মহিলাদের জন্য নির্ধারিত জায়গা'। ওটা দেখে ফ্যান ট্যান ছেড়ে আবার উল্টো পথে দ্রুতপদে হাঁটা শুরু করলাম। এ আবার কিরে বাবা, প্লাটফর্মেরও নারী পুরুষ! ভাগ্যিস বেশি ভিতরে যাইনি। যেতে যেতে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ভাবলাম। সেদিন বা অন্য আরেকদিন কোনও এক লেডিস প্লাটফর্মের কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছিলাম আমার স্মার্টফোনে শখ করে। ওর একটি লেখায় যুক্ত করা হলো। আজ সেকথা ভাবলেই সারা শরীর শিউরে ওঠে, কি করে যে এতো দুঃসাহসিক একটি কাজ করলাম! ধরা পড়লে নির্ঘাত সেদিন আমাকে জেলে যেতে হতো!
(চলবে)