আপনার সাথে আমি সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করছি। এ দেশের সংখ্যালঘু (শব্দে কোনও দোষ নেই, বহু ধর্ম আছে সমাজে, কোনও একটা ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে বাকিগুলো স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যলঘু হবে। আমাদের ব্যথা হচ্ছে এই শব্দটা কেন বারবার আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে) সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। এ অঞ্চলে ইসলাম যারা গ্রহণ করেছে, তারা ধর্মহীন ছিল না, তারা মূলত হিন্দু থেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। মোঘল আমলে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এর মধ্যে এখানে অনেক নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা বর্ণবাদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ইসলামে আসেন, অনেকে বিশেষ লোভে পড়ে আসেন, অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম ভালবেসেও ইসলাম গ্রহণ করেন, ভয়ভীতিও ছিল ইত্যাদি। মূলত বর্ণ বৈষম্যটাই এ অঞ্চলে প্রধান ভূমিকা রাখে। শুনতে আজ আশ্চর্য শোনালেও, আমাদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে এরকম বর্ণ বৈষম্য ছিল যে, ছোট বর্ণের হিন্দুদের অনেক রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পর্যন্ত ছিল না এক সময়। তাদের বিকল্প ঘোরা পথের রাস্তায় চলাচল করতে হতো। কারণ ওই রাস্তাগুলোতে বাবুলোকরা হাঁটা চলা করেন! যাই হোক বিস্তারিত লিখতে গেলে মন্তব্য বিরাট হয়ে যাবে! অল্প কথায় বলছি, ইসলাম এসেছেই এখানে একটা ধর্মের বিরুদ্ধে, নিজে শ্রেষ্ঠ এরকম একটা ধারণা নিয়ে। যারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে অতোটা না থাকলেও পরবর্তীতে ধর্মের চর্চা বাড়ার সাথে সাথে, এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে কম বেশি হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে ওঠে এবং তা আজও চলে আসছে। এছাড়া এটাও তো অস্বীকার করা যাবে না যে, ইসলাম ধর্মে মূর্তি পূজা ও পূজারীদের ঘৃণিত ও নীচভাবে তুলে ধরা হয়েছে। একেবারে প্রাইমারি স্কুলের পাঠ্যবই থেকে এগুলো পড়ানো হয়। এসব পড়ে স্বাভাবিকভাবেই মূর্তি পূজারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অবুঝ শিশু মনেই এক ধরণের ঘৃণা ও অবজ্ঞার সৃষ্টি হয়, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা পরবর্তীতে পরিণত বয়সে এসেও থেকে যায়। আমি নিজেও ছোটবেলায় আমার হিন্দু বন্ধুদের কটাক্ষ করে আরও অনেকের সাথে ছড়া কাটতাম 'হিন্দু হিন্দু গরুর মাথা...'। হিন্দু বিদ্বেষী বা হিন্দু বিরোধী মনোভাব আমাদের দেশে শুরু থেকেই চলে আসছে। আমাদের সমাজের বাতাবরণটাই এরকম, হিন্দুরা হীন নীচ, ওরা আমাদের বন্ধু হতে পারে না, ওরা নানান দোষে দুষ্ট, ওরা পাপী ওদের থেকে দূরে থাকাই ভালো ধরণের। ব্যাপারটা আমরা যেমন বুঝতে পারি, তেমনি হিন্দুরাও পারে, এ কারণেই যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে হিন্দুরা সুযোগ পেলেই প্রতিবেশী হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। তারা সবসময়ই বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ হিন্দুদের সাথে একাত্ম হবার মতো উদার নয়, অদূর ভবিষ্যতেও হবে না।
আপনি নিজেকে বা আপনার পরিচিত দশজন দিয়ে সারাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার, লাঞ্ছনার ধারাবাহিতা অস্বীকার করলে তা আপনার ভুল হবে। এ দেশের আপামর মানুষ কোনদিনও অসাম্প্রদায়িক ছিল না, এখনও নেই। এই তো গেল বছরেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অত্যাচার নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছিল। ২০১৬'র কোনও এক সময় বোধহয় এপ্রিল মে'র দিকে চট্টগ্রামে একজন ষাটোর্ধ প্রবীণ মন্দিরের পুরোহিত বা ধর্মিয় ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হলো, তারপরের দিন নারায়ণগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন সাধারণ নিরীহ দর্জিকে একইভাবে হত্যা করা হলো, তার একদিন বা দুদিন পর পাবনায় আরেকজন মন্দিরের পুরোহিত বা ধর্মিয় ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হত্যা করা হলো। প্রত্যেকটাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য। যাতে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। গেল বছরের কথা। সারা বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের এই একের পর এক ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে খবর প্রচারিত হয়েছিল। প্রত্যেকটা খুনই ছিল মোটিভলেস। পুরোহিত, মন্দিরের কর্মচারী, দরিদ্র দর্জি কারই এমন কোনও শত্রু ছিল না, যারা তাদের এভাবে গলা কেটে জবাই করে হত্যা করতে পারে! এই তিনটাই শুধু নয়, আরও হত্যা ও অন্যান্য অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। ভারতের মুম্বাইয়ে সে সময় আমাকে দুয়েকজনের জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক হিন্দু হত্যা নিয়ে। ওরা আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকেই এসব খবর পেয়েছিল। এটা ২০১৬'র কথা, অর্থাৎ গেল বছর। আমি তো সামান্যই মনে করতে পারছি। সার্চ করলে সে সময়ের পত্র পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আরও ভয়াবহভাবে ধরা দেবে ঘটনাগুলো।
এদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে গেছে, তারা শখ করে বাপ দাদা চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যায়নি! আপনার বোঝা উচিৎ, এটা কোনও উন্নত দেশে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমানো নয়। যারা গেছে তারা কোনও না কোনভাবে এখানে লাঞ্ছনা বঞ্চনার স্বীকার হয়েই গেছে। বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে অনেক দরিদ্র হিন্দু ভারতে যেয়ে উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো পরে নিজেদের অবস্থা ফিরিয়েছেন। এখনও ওপার বাংলার ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষদেরকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, তারা বাংলাদেশি উদ্বাস্তু। এক ২০০১+ সালেই বি.এন.পি জামাত জোটের মধ্যযুগীয় পৈশাচিক বর্বর অত্যাচারের কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ছাড়ে। বাঁশখালি, বাগেরহাটসহ সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বীভৎস নারকীয় পৈশাচিক আক্রমণের ঘটনা আমরা ভুলে যেতে পারি না। প্রতিদিন খবরের কাগজ ভরে থাকতো এসব সংখ্যালঘু অত্যাচারের খবরে। মায়ের সামনে কন্যা, পুত্রবধূ ধর্ষণ, যুবকদের হাত পা কেটে দেয়া, বাড়িঘর দোকানপাটে আগুন, লুটপাট, খুন আরও ভয়ঙ্কর সব অপরাধ অত্যাচার সংঘটিত হয়েছিল হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। কী হয়নি সে সময়! "মা তুমি ফিরে যাও, এ দেশ আর তোমার নয়" দূর্গা পূজার সময় রাস্তায় রাস্তায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মিছিল। এমনকি এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ সে বছর দূর্গা পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চ পদস্থ মহলের অনুরোধে তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
আমি যা বললাম, তা আসলে একেবারে চুম্বক একটা অংশ। নিতান্তই সাধরণ একজন পাঠক দর্শকের স্মৃতিচারণ। বাস্তবতা এর থেকে আরও অনেক অনেক ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিল। আপনি যেভাবে এক বাক্যে এ দেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ব্যাপারটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। বাস্তবতা তার ধারেকাছেও নেই। আপনি আমি বাংলাদেশের শেষ কথা না। এখন কোথায় কে কোলকাতা থেকে এসে কিছুদিন বাংলাদেশে তার হিন্দু আত্মীয়ের কোনও সুরম্য অট্টালিকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে থেকে, ঘুমিয়ে, বাড়ি ফিরে যেয়ে কোথায় ফেসবুক টেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে বসলো যে, "বাংলাদেশের হিন্দুরা ভালো আছে।" সেটাকে হাইলাইট করে বলা হচ্ছে, এদেশে হিন্দুরা ভালো আছে! এখানে কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তি নেই। সবাই মিলেমিশে আছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে একেবারে স্বর্গ বাংলাদেশ। হা হা হা। নাম বলতে চাই না, কিছু প্রবাসী ব্লগারদের নির্লজ্জতা, মানে একেবারে চরম সীমা অতিক্রম করেছে। বলতে গেলে অনেককিছুই বলতে পারি! কিন্তু ওই যে কথায় আছে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। বলতে গেলে উল্টো ব্লগ কর্তৃপক্ষ আবার রুষ্ট হয়ে আমাকেই ব্যান করে বসবে। সব ওই ডলারের জোর ভাই! একটা ঘটনা মনে পড়ছে, 'be দেশী' নামে একটি অনুষ্ঠান হতো ইটিভি-তে। সেখানে দেখেছিলাম আমেরিকা প্রবাসী এক জামাতপন্থী চিকিৎসক। মানে বাংলাদেশ নিয়ে লোকটার আন্তরিক চিন্তা ভাবনা, মায়া কান্না, মিষ্টি মিষ্টি পরামর্শ, পরিকল্পনা। আহা কী বলবো! কী দেশপ্রেম! পরে দেখলাম, সতের আঠার বছর ধরে প্রবাসী লোকটা একবার দেশেও আসেনি! দেশ নিয়ে এদের এতো মায়া কান্না দেখলে, আরেকটা কথা মনে পড়ে যায়, "মা'র থেকে মাসির দরদ বেশি"। সবাইকে নয় মুষ্টিমেয় কয়েকজনের উদ্দেশ্যে আমার এই জোরালো প্রতিবাদ। ব্লগে আড্ডা দিতে এসেছেন, আড্ডাই দিন। মাঝেমাঝে দেশ নিয়ে আপনাদের অতো উসখুস না করলেও চলবে!
যাই হোক পোস্টের জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। নিশ্চয়ই আপনি একজন অসাম্প্রদায়িক উদার মানুষ। কিন্তু সবাই আপনার মতো নয়। ঢাকার দুয়েকটা অভিজাত এলাকার হিন্দুদের দিয়ে আপনি সারাদেশের হিন্দুদের অবস্থা'র মূল্যায়ন করতে পারেন না।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৫৬