somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলকাতার আদম টানা রিক্সা নিয়ে আমার কিছু কথা

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



[ছবি: সংগ্রহ। ছবিতে সার বাধা কয়েকটি কোলকাতার হাতে টানা রিক্সা দেখা যাচ্ছে।]


সেটা ছিল কোলকাতায় আমার দ্বিতীয় দিন। হোটেল খুঁজতে বেরিয়েছি। ভবানী দত্ত লেনের রাজা হোটেলের ভাড়া আমার পক্ষে বহন করা কষ্টকর। তাই সকালে উঠেই বেরিয়েছি তুলনামূলক সস্তা হোটেলের খোঁজে। বেলা তখন দশটা বা সাড়ে দশটা বেজে থাকবে। স্থান কলেজ স্ট্রিট। আমি হাঁটছি প্রধান সড়কে। আশপাশে তাকাচ্ছি কোনও হোটেল পাওয়া যায় কিনা। একটা মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। এ সময় প্রথম কোলকাতার হাতে টানা রিক্সা চোখে পড়লো। কয়েকটি রিক্সা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একটি রিক্সার ভিতরে দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক, বয়স ষাটের নিচে হবে না, বসে আছে রিক্সার পা'দানিতে। বিশ্রাম করছিলো। ভীষণ ক্লান্ত তার মুখাবয়ব। অনবরত ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। ভিজে জবজবে তার সাদা নোংরা টি শার্ট। এই প্রথম কোলকাতার এই তথাকথিত বিখ্যাত হাতে টানা কিংবা আদম টানা যে নামেই ডাকি না কেন, রিক্সার মুখোমুখি হলাম! এই রিক্সা আজ কেবল পৃথিবীর এক জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়, কোলকাতায়। সবে গেল রাতে এখানে এসেছি। এটাই আমার প্রথম ভারতে আসা। এবার রিক্সাগুলোর খানিকটা বর্ণনা দেয়া যাক। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের রিক্সার মতোই। তবে আয়তনে বেশি লম্বা আর চাকাগুলো বড় বড়। এ রকম হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ এগুলোকে হাত দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে হয়। এতে পেছনে দুটো চাকা আছে, সামনে নেই। রিক্সার চৌকোণা বর্গক্ষেত্রের ভিতরে দাঁড়িয়ে কাঠের হাতল ধরে রিক্সা টেনে নিয়ে যেতে হয় চালককে। রিক্সাগুলো দেখে সে সময় আমার হঠাৎ করে মনে হলো, আমি যেন প্রাচীন কোনও শহরে এসে পড়েছি; এই সময়ের থেকে আরও অনেক, অনেক পিছনের কোনও এক সময়ে। এ ধরণের পুরাতন বাহনে আমি মোটেও অভ্যস্ত নই। বাংলাদেশে এরকম রিক্সা চলে না। সত্যি আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ এই আধুনিক, সভ্য, উন্নত পৃথিবীতে এ ধরনের একটা পুরনো সেকেলে বাহন বড্ড বেমানান মনে হলো আমার কছে। আমার সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। ওই বৃদ্ধ রিক্সা চালককে রিক্সার পা'দানিতে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সহসা আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো। কি ভয়ানক কষ্টই না তাদের করতে হয় জীবিকা উপার্জনের জন্য। যাত্রী রিক্সায় উঠে বসামাত্রই আগুন তপ্ত পিচঢালা সড়কে একটানা দৌড়ে হেঁটে, রিক্সা টেনে নিয়ে যেয়ে যাত্রীদের পৌছে দিতে হবে গন্তব্যে। এটাই তাদের নিত্যদিনের জীবন, নিত্যদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এখানে দাঁড়াবার সুযোগ নেই এতোটুকু। এভাবেই কোলকাতার বুকে যুগের পর যুগ ধরে চলছে, এই প্রাগৈতিহাসিক কিম্ভুতকিমাকার দুচাকার আদম টানা রিক্সাগুলো। এই রিক্সা আজকের দিনে একেবারেই অস্বাভাবিক, অমানবিক। একে এভাবে ঐতিহ্য হিসেবে লালন করার কোনও মানেই হয় না!
উপনিবেশ যুগে আফ্রিকার কালো মানুষরা তাদের শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের কাঁধে তুলে রাস্তা, সেতু পারাপার করিয়ে দিতো, পৌছে দিতো গন্তব্যে। এরকম বাস্তব দৃশ্যের ছবি দেখেছি পত্র পত্রিকায়, ইন্টারনেটে। বর্ণবাদের অভিশাপ আমাদের পৃথিবীকে বহুদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তারপর এসেছিল মুক্তি। তবে এই মুক্তি একদিনে বা হঠাৎ করে আসেনি, এর জন্য মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এর জন্য তাদের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। আর এ লড়াইয়ে শোষিত, বঞ্চিত মানুষের হয়ে সব রকম প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং'র মতো কালজয়ী মহান অগ্রণী পুরুষেরা। এঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন এই ভারতবর্ষেরই সন্তান। সারা বিশ্বকে বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়েছিলেন তিনি, এ কথা আমাদের সবারই জানা। অথচ তাঁর দেশেই যে আজও সেই উপনিবেশ যুগের বর্ণবাদের ভূত করছে বসবাস, এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই! কী এক রহস্যময় কারণে সেখানকার সরকার, প্রশাসন এই ব্যাপারে একদম নীরব। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোলকাতার নাগরিক সমাজও মৌনব্রত ধারণ করে আছে। আসলে ব্যাপারটা একেবারে গা' সওয়া হয়ে গেছে সেখানে। কিন্ত বাইরে থেকে কোলকাতায় যেয়ে যারা হঠাৎ এর মুখোমুখি হবে, তাদের কাছে নির্ঘাত সেখানকার এই হাতে টানা দুচকার রিক্সাগুলো বিস্ময়কর ঠেকবে। আজকের দিনে এ ধরণের পুরাতন বাহন কল্পনাও করা যায় না!
সত্যি এই একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ যান্ত্রিক আধুনিক বিশ্বে, মানুষের এই হাতে টানা দুচাকার কিম্ভুতকিমাকার রিক্সাগুলো শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, রীতিমতো অমানবিক। আমি কিন্তু কোলকাতা মূল শহরের বাইরে সবখানে প্যাডেল চালিত সাধারণ রিক্সাই চলতে দেখেছি। তবে কোলকাতায় কেন নয়! ইচ্ছে করলেই এই হাতে টানা রিক্সাগুলো বর্জন করা যেতে পারে। সেখানে প্যাডেল চালিত সাধারণ রিক্সা চলাচলের অনুমতি দিলেই এর সমাধান হয়ে যায়। এছাড়া এই রিক্সাগুলোকে প্যাডেল চালিত রিক্সায় রূপান্তর করাও কঠিন কিছু নয়। আসলে এটা অত্যন্ত তুচ্ছ একটি ব্যাপার, প্যাডেল চালিত সাধারণ রিক্সা কোলকাতার সড়কে চলাচলের অনুমতি দিলেই এই সেকেলে, মধ্যযুগীয় অভিশপ্ত বাহন থেকে মুক্ত হতে পারে কল্লোলিনী কোলকাতা, সিটি অফ জয় কোলকাতা, নোবেল নগরী কোলকাতা। কিন্তু তা না করে, তারা এই প্রাগৈতিহাসিক মধ্যযুগীয় অভিশপ্ত বাহনটিকে কোলকাতার ঐতিহ্য হিসেবে লালন করে চলেছে!

(২০১১ বা ২০১২ সালের কোনও একদিন দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত। লেখাটা বেশ আগের, কিন্তু আমার নিজেরই খুব প্রিয় একটি লেখা। পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:২০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×