somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই বিশ্বকাপ নিয়ে লেখা আগের পোস্টগুলো

১৩ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আসছে বিশ্বকাপ ফুটবল



বিশ্বকাপ ফুটবল আসন্ন। এবারের বিশ্বকাপ হবে রাশিয়ায়। বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয়ে থাকে, ‘বিগেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। সারা পৃথিবীকেই এই পুরো একটি মাস মোহাবিষ্ট করে রাখবে ফুটবল। একটি মাস শুধুই ফুটবলের। আমাদের দেশেও বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা মোটেও কম নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে তা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর থেকেও বেশি। বিভিন্ন দেশের রঙবেরঙের জাতীয় পতাকা এসময় উড়তে দেখা যায় দেশের সবখানে- গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর সর্বত্রই। লোকজন দল বেধে সড়কের মোরে ভিড় ক’রে লাইভ ম্যাচ টিভিতে উপভোগ করে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয় শুধুমাত্র বিশ্বকাপ উপলক্ষেই। চায়ের দোকান, লোকাল বাস, অফিস আদালত, রোয়াক, পার্কের বেঞ্চ সবখানে শুধু ফুটবল ফুটবল আর ফুটবল। সত্যি, আমাদের দেশের আপামর মানুষের জন্যে দারুণ আনন্দের একটি মাস, বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি মাস।

মনে পড়ছে, বিগত কোনও এক বিশ্বকাপে একবার সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছিলাম, এসময় নরসুন্দর মহাশয় সেখানে উপস্থিত জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে ফুটবল নিয়ে এমন সিরিয়াস আড্ডা দেয়া শুরু করলো যে, আমার মনে হচ্ছিল কোনও ফুটবল বিশ্লেষক, গবেষক যেন আমার চুল কাটছে! চুল কাটায় তার আদতে কোনও মনোযোগই ছিল না, সব মনোযোগ ফুটবল নিয়ে আড্ডায়। কোনওরকম আর্মিদের মতো চুল ছোট ক’রে ছেটে দিয়েই বিদেয় করেছিল। হা হা হা।

ব্রাজিল আর্জেন্টিনা- দুভাগে মোটামুটি পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে যাবে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্কবিতর্ক, বাদানুবাদ হবে দেশের সর্বত্রই। দুয়েক জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভক্ত সমর্থকদের মাঝে তপ্ত বাক্য বিনিময় ও তা থেকে মৃদু হাতাহাতিও হবে কোথাও কোথাও।

***
এরিয়েল ওরতেগার জন্য ভালবাসা



আর্জেন্টিনা’র এরিয়েল ওরতেগা আমার অত্যন্ত পছন্দের একজন ফুটবলার। এ শুধুই তাঁর ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য। সত্যি বলতে কি, বল ড্রিবলিং কাটানোতে তাঁর মতো দক্ষ খেলোয়াড় আমি আমার এযাবতকালের জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি! এ কাজটা খুব ভালোই পারতেন তিনি। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে দেখেছিলাম তাঁর অতিমানবীয় ফুটবলের জাদু। দিব্যি পাঁচ ছয় জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, ইচ্ছেমতো ডস দিয়ে দিয়ে বল নিয়ে বারবার টুপ করে ঢুকে পড়তেন প্রতিপক্ষের ডি বক্সে। একবার দুবার তিনবার- বারবার। বল পেলেই প্রতিপক্ষের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতেন তিনি। সহযে আর বল পা ছাড়া হতো না, যেন বুটে অদৃশ্য কোনও আঠা লেগে আছে, তাতে লেপটে আছে বল। প্রতিপক্ষকে কাটানো ডালভাতের মতো সহজ ব্যাপার ছিল এরিয়েল ওরতেগার জন্য। চার পাঁচ জন একত্রে ঘিরে ধরেও বল ছিনিয়ে নিতে পারতো না তাঁর পা থেকে। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা বুঝে যেতো, এঁকে বৈধভাবে থামানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই বারবার অবৈধভাবে তাঁকে থামিয়ে দেয়া হতো। বেশিরভাগ সময় দেখতাম প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা জামা টেনে ধরতো, ধাক্কা দিতো, পা'য়ে ল্যাঙ মারতো- এভাবে একের পর এক ফাউল করে বলতে গেলে তাঁকে তাঁর স্বাভাবিক খেলাই খেলতে দেয়া হয়নি; আমি ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপের কথা বলছি। সেবার নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে রেফারি নেদারল্যান্ডের পক্ষে উলঙ্গ পক্ষপাতিত্ব করে অবৈধভাবে লাল কার্ড দেখিয়েছিল ওর্তেগাকে। সে ম্যাচে ড্যানিস বার্গক্যাম্পের শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মনে পড়ছে সে ম্যাচে ওরতেগার অশ্রুসিক্ত চোখে হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে শ্লথ পা’য়ে হেটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তখন বুঝিনি, সেটাই হতে চলেছে আমার দেখা তাঁর শেষ পূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচ! সেসময় সেভাবে ক্লাব ফুটবলের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তাঁর পরের ২০০২ কোরিয়া জাপান যৌথ রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সম্ভবত এরিয়েল ওর্তেগা আর খেলার সুযোগ পাননি। পেলেও পুরো সময় খেলতে পারেননি। সম্ভবত বদলি খেলোয়াড় হিসেবেই খেলেছিলেন দুয়েকটি ম্যাচে। এরকম কিছু হয়েছিল।
জানি না এখনও তিনি খেলেন কিনা। আমি তাঁর চমকপ্রদ অতিমানবীয় ক্রীড়া নৈপুণ্যের সাক্ষী। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে আমি হাই স্কুলে অধ্যায়ণরত কিশোর ছিলাম। খেলাধুলা দারুণ পছন্দ করতাম। বিশেষ করে ফুটবল, ভলিবল ও সবরকমের মারপিটের খেলা- রেসলিং, বক্সিং, জুডো, তায়কোয়ান্দো ইত্যাদি। ক্রিকেট অতোটা নয়। সব থেকে প্রিয় ছিল ফুটবল। সেবার বিশ্বকাপে একমাত্র এই এরিয়েল ওর্তেগা’র কারণেই কিছুতেই চাইতাম না, জুর্গেন ক্লিন্সম্যান, অলিভার কান, লোথার ম্যাথিউস, মাইকেল বালাক’র মতো দক্ষ খেলোয়াড়ে পূর্ণ প্রিয় জার্মানি ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা’র মুখোমুখি হোক।
সে সব দিন ধূসর অতীত আজ। নিটোল সুখের একগুচ্ছ স্মৃতি। অনেককিছুই ভুলে গেছি সময়ের সাথে সাথে, যেটুকু মনে আছে, তাও বিস্তারিত বা পুঙ্খানুপুঙ্খ নয়। কিন্তু আমার পরিষ্কার মনে আছে এরিয়েল ওর্তেগাকে, তাঁর অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়া নৈপুণ্য- খেলার যে কোনও পর্যায়ে বল পেলেই প্রতিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়কে ইচ্ছে মতো নাচিয়ে কাটিয়ে ডি বক্সে বারবার ক্ষিপ্রগতিতে ঢুকে পড়া। এঁকেই বোধহয় জন্ম ফুটবলার বা জাত ফুটবলার বলা হয়ে থাকে! বেশ নস্টালজিক হয়ে উঠছি তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে। তাঁর সাথে সাথে আরও মনে পড়ছে, আমার ছেলেবেলার শহর- রাত জেগে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ওঠা, বাড়ির ছাদে পতাকা ওড়ানো, খেলার পর বিজয়ী প্রিয় দলের পক্ষে মিছিলে শরীক হওয়া... আহ, কতো যে প্রাণোচ্ছল সুমধুর ছিল সেসব দিন! যাই হোক প্রিয় ফুটবলার এরিয়েল ওর্তেগা’র জন্য হৃদয় নিংড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, আজ আমার এ সামান্য লেখার মাধ্যমে। যেখানে যেভাবেই থাকুক তিনি, সুখদায়ক ফল্গুপ্রবাহে ভরা থাক তাঁর অনাগত প্রতিটি দিন।

***
এক কাপ ক্যাপুচিনোতে খেলা শেষ ও আরও কিছু প্রাসঙ্গিক এলোমেলো কথা


লিয়নেল মেসি।

গেল বিশ্বকাপের কোনও একটি ম্যাচ (ঠিক কোন খেলা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, সম্ভবত আর্জেন্টিনার কোনও একটা গ্রুপ পর্বের খেলা ছিল সেটা) ঢাকার গুলশানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে দেখেছিলাম। চিনি ছাড়া ভীষণ কড়া এক কাপ গরমাগরম ক্যাপুচিনো খেতে খেতে। এক কাপ ক্যাপুচিনোতেই আমার খেলা শেষ! হা হা হা। রাত দেড়টা পর্যন্ত সেদিন ছিলাম সেখানে। আমার খুব প্রিয় ছিল সেই রেস্টুরেন্টটি সে সময়। তখন নিয়মিতই যেতাম। খুব ভালো বিভিন্ন কফি পাওয়া যেতো। ছিল, যেতো বলছি, কারণ দীর্ঘদিন সেখানে আর যাই না। ঠিক আজকে থেকে চার বছর আগের কথা এগুলো। এখনও রেস্টুরেন্টটা আছে সেখানে, সম্ভবত সবই তেমনি চার বছর আগের মতোই আছে, যেমন দেখেছিলাম। কিন্তু আমি এর মাঝে আর বহুদিন সেখানে যাইনি। রেস্টুরেন্টটির নাম সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করলাম না। ছোট্ট এক কাপ ক্যাপুচিনোর দাম তখন ছিল, একশত পঞ্চাশ টাকার মতো। এখন নির্ঘাত আরও বেড়ে গেছে। তবুও তুলনামূলক সস্তাই বলা যায়। ওর পাশে হোটেল ওয়েস্টিন’এ একবার একজন ক্যাফে লাত্তে খাইয়েছিল। আলোআঁধারিতে বিলটা এক ঝলক দেখেছিলাম, লাত্তে ছয়শত + টাকা!

যাই হোক রাত দেড়টা পর্যন্ত ছিলাম সে রাতে, সেই রেস্টুরেন্টে। আগেই বলেছি গুলশানের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট ছিল সেটা। ওখানে নিত্য বড় বড় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসা যাওয়া করতো। অনেককে দেখেছিলাম। মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে করতো, ওদের দুয়েকজনকে ধরে গুলশান দুইয়ের মোড়ে নিয়ে যেয়ে ইচ্ছে মতো পেটাই। তখন বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের আগুন সন্ত্রাসের দগদগে ক্ষত আমার বুকে। তাই মাঝেমাঝে এই ইচ্ছা বড্ড মাথাচাড়া দিতো।

এ ব্যাপারে আর তেমন কিছু বলার নেই আমার। শুধু আবারও বলছি, এক কাপ ক্যাপুচিনোতেই আমার সেই খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল! হা হা হা। রাত দেড়টায় ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু কীভাবে ফিরেছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। বাসে নাকি হেঁটে হেঁটেই- এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। তখন অবশ্য গুলশানের খুব কাছে উত্তর বাড্ডায় থাকতাম। আরও অনেক এলোমেলো স্মৃতি এসে ভিড় জমিয়েছে সেই সময়ের। আহা, চারটি বছর চলে গেছে মাঝখানে। এখন আমি আর্জেন্টিনা’র ঘোর সমর্থক। আর্জেন্টিনা’র খুব ভালো একজন পত্র মিতা ছিল আমার, এন্টোনেলা পিনেডা নাম ছিল ওর। ২০১৩ সালে পরিচয় হয়েছিল। অত্যন্ত ভালো ও উদার মনের মেয়ে ছিল। ও তখন অষ্টাদশী। বেচারি ওর বাবাকে কোনওদিন দেখেনি। ওর জন্মের পরপরই ওর বাবা মা’র ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর কোনও যোগাযোগ ছিল না তাদের মধ্যে।

আর্জেন্টিনা’র টেনিস খেলোয়াড় ডেভিড নালবান্দিয়ান আমার অত্যন্ত প্রিয় খেলোয়াড় ছিল। বেশ ক’বছর হলো অবসর নিয়েছেন। কের্টে কখনও হাসি ছাড়া তাঁর মুখ দেখিনি। খেলায় অনেককেই দেখতাম আম্পায়ার লাইনম্যান’র সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে, অনেকে তো রীতিমতো মারমুখী হয়ে উঠতো এসব নিয়ে। ডেভিড নালবান্দিয়ানকে কখনওই এরকম করতে দেখিনি। এক্কেবারে একজন মাটির মানুষ যাকে বলে, নিরহংকার, ক্রোধহীন, জলের মতো সহজ সরল। সবকিছু হাসি মুখে সহজভাবে গ্রহণ করতো। বেশ ক’বার আম্পায়ার লাইনম্যান’র পরিষ্কার ভুল সিদ্ধান্তেও সামান্য খেদ প্রকাশ করতে দেখিনি তাঁকে। একই কথা মেসিসহ সকল আর্জেন্টাইনদের ব্যাপারেই সম্ভবত প্রযোজ্য। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল, রাগবি, টেনিস সবখানেই আর্জেন্টাইনদের মতো সুসভ্যা জাতি আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তাই আমি এখন পুরোপুরিভাবে ঘোর আর্জেন্টাইন সমর্থক। এই বিশ্বকাপেও প্রত্যাশা আর্জেন্টিনার ঘরে যাক বিশ্বকাপ ট্রফিটি, নাহলে আবার জার্মানিই শিরোপা জয়লাভ করুক। তা নাহলে ইংল্যান্ড বা পর্তুগাল। পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র মতো তুখোড় ফুটবলারের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটি ওঠা উচিৎও বৈকি। একই কথা লিওনেল মেসি’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সবই অবশ্য কথার কথা। আমার কথায় তো আর কিছুই নির্ধারণ হবে না। আমি তান্ত্রিক বা জ্যোতিষীও নই। তবে আর সবার মতো মেসি, রোনালদো’র ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখার জন্যে মুখিয়ে আছি। উঠুক না হয় দুজনের একজনের হাতে দারুণ শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন ট্রফিটি।



ডেভিড নালবান্দিয়ান।

***
স্মৃতিতে ৯৪’র ফুটবল বিশ্বকাপ



৯৪ সালে আমি খুব ছোটো ছিলাম, মাত্র সাত আট বছর বয়স। তবুও ফুটবল বিশ্বকাপের কথা মোটামুটি একটু আধটু ভালোই মনে করতে পারি। বিটিভি’র যুগ সেটা। স্যাটেলাইট তখনও আসেনি। টিভিসেটই ছিল হাতে গোনা! যাই হোক খেলা শুরুর আগে এ্যান্ড্রু কিশোর’র গান হতো, দিতি ইলিয়াস কাঞ্চন টিভি পর্দায় নাচতো; ‘রূপসী দেখেছি আমি কতো/ দেখিনি তোমার মতো’, ‘বেলি ফুলের মালা গেঁথে এক প্রেমিক তার প্রিয়াকে ঘরে তুলেছে/ যৌতুক টাকাকড়ি পা’য়ে দলেছে/ যারা পুরুষকে মন্দ বলে/ তারা এমন পুরুষ কি দেখেছে...’। এইসব সিনেমার গান খুব ভালো লাগতো আমার। ঢাকাই সিনেমায় তখন ইলিয়াস কাঞ্চনের দারুণ জয়জয়কার। পাশাপাশি রুবেলও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা সিনেমা হল ছিল। মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা দেখতামও বৈকি। বিশ্বকাপের খেলাও দেখতাম, কিন্তু বোঝার মতো পরিণত ছিলাম না। ফুটবল খেলার মোটেই কিছু বুঝতাম না, শুধু দেখতাম একদল হাফ প্যান্ট ও সাদা কালো জামা পরিহিত মানুষ ফুটবল নিয়ে এলোমেলো দৌড়াদৌড়ি করছে। খুব সম্ভবত খেলাটাকে তখন বিরক্তিকরই মনে হতো! সেবার ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন ও ইতালি রানার্স আপ হয়েছিল। চারিদিকে তখন ‘রোমারিও রোমারিও’ তোলাপার। এছাড়া খুব ভালো মনে করতে পারছি, বিশ্বকাপ শুরুর প্রাক্কালে ম্যারাডোনা’র ড্রাগ কেলেঙ্কারি, খেলা না খেলার দোলাচল নিয়ে সারা শহরজুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। হ্যা পরিষ্কারই মনে করতে পারছি ঘটনাগুলো, সমস্ত শহর তখন ম্যারাডোনাময়। সে কী উত্তেজনা ম্যারডোনা’কে নিয়ে। আমার ফুটবল পাগল পিতাও যারপরনাই উদ্বিগ্ন, সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। স্থানীয় অনেককেই ফুটবল নিয়ে আলোচনায় ফিফা, রেফারি, আমেরিকা (৯৪’র আয়োজক রাষ্ট্র) এর ওর গুষ্ঠি উদ্ধার করতে দেখেছি। অনেকের তো রীতিমতো শোকে জর্জর হয়ে কেঁদে ফেলবার মতো পরিস্থিতি। যাই হোক সেই প্রথম শৈশবে আমার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের ম্যারাডোনাকে নিয়ে এই উদ্বিগ্নতা দেখে, মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম যে, ম্যারডোনা খুব সম্ভবত সম্পর্কে আমার চাচা। বিশ্বকাপ শেষ হলেই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। আত্মীয় না হলে কী আর আমার বাবার মতো এহেন কাঠখোট্টা মানুষও তাকে নিয়ে এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে! বেচারা সর্বত্র অস্থিরতা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে, চেহারা যারপরনাই বিষণ্ণ, জীবনের প্রতি হঠাৎই যেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ আর কি- ভাই বলে কথা। মায়ের পেটের না হলেও কোনওরকমের রক্তের সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে দুজনার মাঝে! আমি অনেকটা নিশ্চিতই ছিলাম এ ব্যাপারে যে, ম্যারাডোনা নির্ঘাত বাবার দিকের কোনও আত্মীয় আমার! হা হা হা।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Show must go on...’(অনুষ্ঠান নিশ্চয় চলতে থাকবে)। কথাটা এই মানবজীবন’রই অত্যন্ত সার সত্য। কারও জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। ৯৪’র বিশ্বকাপও ম্যারাডোনার জন্য থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে দেখেছি, একই ক্রীড়া প্রেমিক মানুষগুলো মেতে উঠেছে ব্রাজিলীয় রোমারিও’কে নিয়ে। চারিদিকে ‘রোমারিও রোমারিও’ হৈ চৈ। এর মাঝে আরও অন্যান্য বেশ কিছু খেলোয়াড়ের নামের সাথেও এর ওর মুখে শুনে ভালো পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। যেমন- বেবেতো (ব্রাজিল), ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা (আর্জেন্টিনা), রজার মিলা (ক্যামেরুন), রবার্টো ব্যাজিয়ো (ইতালি) ইত্যাদি। সেবার ব্রাজিল’র হাতে চতুর্থ বারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি ওঠে। রানার্স আপ হয়েছিল ইতালি। খেলার ফলাফল এক্সট্রা টাইমসহ সম্পূর্ণ ম্যাচ গোলশূন্য, টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৩ - ২ ইতালি। সেই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পাওয়া সেরা ফুটবলার রবার্টো ব্যাজিয়ো পেনাল্টি মিস করেছিল ফাইনালে। খুব সম্ভবত সেটাই এযাবতকালের একমাত্র গোলশূন্য বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ।

এই তো মনে পড়ছে, শহরজুড়ে হৈ চৈ, ইতিউতি ব্যস্তসমস্ত আলোচনা মানুষের, বাবার চেহারায় উদ্বিগ্নতা; খেলা চলছে, ফুটবল... বিশ্বকাপ ফুটবল। শেষের কয়েকটি তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে টুকে দিয়েছি। আগেই বলেছি, খেলা বোঝার মতো পরিণত তখন ছিলাম না আমি, মাত্র সাত আট বছর বয়স। অনেকটা এমনি এমনিই বসে থাকতাম টিভিসেটের সামনে, কিন্তু উল্লেখিত ঘটনাগুলো দারুণভাবে মনে আছে। আর মনে আছে দিতি, ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমার গানগুলো, ‘বেলি ফুলের মালা গেঁথে এক প্রেমিক তার প্রিয়াকে ঘরে তুলেছে/ যৌতুক টাকাকড়ি পা’য়ে দলেছে/ যারা পুরুষকে মন্দ বলে/ তারা এমন পুরুষ কি দেখেছে...’। খেলার থেকে তখন এই গানগুলোই বেশি আকর্ষক ছিল আমার কাছে।

আহ্ ৯৪! আহ্ দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা! সময় যেন বহতা পানি। ২৪ বছর চলে গেছে মাঝখান, দু’ দুটি যুগ, অথচ মনে হচ্ছে যেন এই তো সেদিনেরই কথা!

***
স্পেনের জন্য শুভকামনা



স্পেন মরক্কো’র খেলা দেখছি। এই সেন্টার হলো বলে। স্পেন’র প্রতি আমার বিশেষ ভালো লাগা, শুভকামনা আছে। আমি স্পেনীয় টেনিস খেলোয়াড় কার্লোস ময়া’র খেলা ও ব্যক্তিত্বের একজন অনুরাগী ছিলাম। ছিলাম নয়, বরং বলি, এখনও আছি, কিন্তু তিনি অবসর নিয়েছেন বেশ ক’বছর আগে, আর টেনিসও সেভাবে ইদানীং দেখা হয় না। বিশ্ব ফুটবলে স্পেন ভীষণ রহস্যময় একটা দল। নিয়মিত অংশগ্রহণ যেমন আছে তাদের বিশ্বকাপে, তেমনি ফুটবল বোদ্ধারাও বরাবরই ফেভারিটদের তালিকায় রেখে আসছে স্পেনকে। সেটাই স্বাভাবিক। স্পেনিশ লা লিগা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যয়বহুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেখানকার রিয়েল মাদ্রিদ ক্লাবটি যেমন অভিজাত, ঐতিহ্যবাহী, তেমনি সবচেয়ে ধনী ক্লাব। বিশ্বের সবচেয়ে পরীক্ষিত, শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সংগ্রহ করে থাকে দলটি বেশুমার অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া অলিম্পিক, কনফেডারেশন কাপ, ইউরো ইত্যাদি অন্যান্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বেশ ভালো ফলাফল করে আসছে তারা। কিন্তু বিশ্বকাপে বরাবরই হতাশাজনকভাবে কোয়ার্টার ফাইনালের পর আর যেতেই পারতো না! অনেক পরে ২০১০ এই শেষমেশ শিকে ছিড়লো স্পেনীয়দের। প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করলো। আমার শৈশব, কৈশোরে স্পেনিশ স্ট্রাইকার রউল গনজালেস একজন প্রিয় ও আদর্শ ফুটবলার ছিলেন। ৯৮, ০২, ০৬- ববিশ্বকাপ মাতিয়েছিলেন তিনি, যে পর্যন্ত স্পেন ছিল। মাঠে ভালো খেলার পাশাপাশি সবসময় সহাস্যমুখ দেখেছি তাকে। ভীষণ অমায়িক, উদার মনমানসিকতায় সমৃদ্ধ চমৎকার একজন মানুষ তিনি, একজন ভালো খেলোয়াড় হবার পাশাপাশি। ক্লাব ফুটবলে স্বদেশী ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদের হয়েও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল শৈলী দিয়ে মন কেড়ে নিয়েছিলেন আমার মতো আরও কোটি কোটি ক্রীড়ামোদী দর্শকদের। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছি রউল গনজালেসকে।

এবারের স্পেনিশ দলটিও দারুণ খেলছে। ভরপুর শুভকামনা তাদের জন্য। স্পেনের হাতে আবার উঠুক বিশ্বকাপ।

মরক্কো দুটো ম্যাচ হেরে রেস থেকে আগেই বাদ পড়েছে। কিন্তু পর্তুগাল, ইরানের সাথে দুটো পরাজিত ম্যাচেই তারা প্রতিপক্ষের থেকে ভালো ফুটবল খেলেছিল, কিন্তু গেলটাই শুধু দিতে পারেনি (না দিয়েছে ইরানের জালে নিজের জালে নিজেই হেতে বল জালে জড়িয়েছিল একজন মরক্কান খেলোয়াড়) হা হা হা।

যাই হোক, ভালো পরিচ্ছন্ন উপভোগ্য উত্তেজনাপূর্ণ একটি ম্যাচ দেখার অপেক্ষা...

***
গতকালকের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা


ইংল্যান্ডেরর এ্যালান শিয়েরায় আমার অত্যন্ত প্রিয় ফুটবলার (অধিনায়ক, ৯৮)। দারুণ খেলতেন।

গতকাল রাতে ঢাকার একটি বিশেষ স্থানে জায়ান্ট স্ক্রিনে আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া খেলা দেখছিলাম। কোনও স্টেডিয়ামের ফুল প্যাকড গ্যালারীর মতো ভিড় বেশ বড়সড় একটি মাঠে। তিল ধারণের জায়গাও নেই বলতে গেলে। সত্যি, আর্জেন্টিনাতেও এভাবে তাদের খেলা দেখবার জন্য খোলা মাঠ ভর্তি দর্শক মাঝরাত অবধি থাকবে কিনা এব্যাপারে আমি সন্দিহান! গতকাল রাতের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমি কোনওদিন ভুলবো না। এক্কেবারে যেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে চাক্ষুষ দেখছি খেলাটি। সিংহভাগ দর্শক আর্জেন্টিনার ঘোর সমর্থক। খেলা চলাকালীন মেসি, ম্যারাডোনা পর্দায় এলেই, চিৎকার চেঁচামিচি করে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে লাগলো তারা। অনেকেই ভুডুজেলা, বাঁশী, আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে এসেছিল খেলা দেখতে। অনেকের গা’য়ে আর্জেন্টিনার নীল সাদা জার্সি। একেবারে মেলার মতো উৎসবমূখর পরিবেশ। আমিও হাফ প্যান্ট, টি শার্ট পড়ে হাজির। বড় দলের খেলা হলে আমি সাধারণত মিস করি না, খেলা দেখতে চলে আসি এই মাঠে। যা হোক খেলা শুরু হলো। প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে হলে এ ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয়ের কোনও বিকল্প ছিল না। মনে মনে অনেকটা নিশ্চিতই ছিলাম, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে আর্জেন্টিনা আফ্রিকান বা এশিয়ান কোনও দলের কাছে পরাজিত হবে না (এর আগে কখনও এরকম ঘটেনি)। প্রথম অর্ধের শুরুতেই মেসি জ্বলে উঠলো। ১৪ মিনিটে দারুণ এক গোল করে এগিয়ে দিলো আর্জেন্টিনাকে। আর অমনি অনাবিল উল্লাসে মেতে উঠলো সেই মাঠে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখতে আগত উপস্থিত দর্শকবৃন্দ। হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল চারিদিকে। ভুডুজেলা, পটকা ফোটানোর শব্দে কান ঝালাপালা একেবারে। ‘মেসি মেসি’ চিৎকার উল্লাস সর্বত্র। ‘আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা’ কলরব। এর খানিক পর শুরু হলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কী যে বিড়ম্বনা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই খেলা দেখছিলাম, আরও অনেকের সঙ্গে। অনুমিত ছিল, এই বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। থেমে গেলে টি শার্ট খুলে মাথা ও শরীর যথাসম্ভব মুছে নেবো। এভাবেই ঝঞ্ঝাটে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ খেলা দেখলাম।

খেলা চলতে লাগলো। আর্জেন্টিনা ১-০ গোলের লীড নিয়ে খেলছিল। এভাবেই শেষ হলো প্রথমার্ধ।

***
শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও আরও দুয়েকটি ছন্নছাড়া কথা



গ্যাব্রিয়েল জেসুস।

বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হতে যাচ্ছে আজ। এ পর্যন্ত ভালো, সফল, নির্ঝঞ্ঝাট একটি বিশ্বকাপ সমাপ্তির দিকে চলেছে। আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, যাদের শিরোপা জয়ের দৌড়ে এগিয়ে রেখেছিল ফুটবল বোদ্ধা বিশেষজ্ঞরা, তারা কেউ প্রথম কেউ দ্বিতীয় রাউন্ডের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছি, দ্বিতীয় রাউন্ডে মেক্সিকোর পরাজয়ে। খুব আশা করেছিলাম, ব্রাজিলকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাবে তারা। কিন্তু তা হয়নি। পরের দিকে খেলাই আর দেখিনি। ব্রাজিল প্রথম রাউন্ডের তৃতীয় ম্যাচ থেকে ছন্দময় ফুটবল খেলছে। আমার এই ব্রাজিল দলের সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় গ্যাব্রিয়েল জেসুস। খুবই ভালো লাগে ওকে। প্রচুর পরিশ্রমী ও পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলে থাকে, ফাউল টাউল একেবারেই করে না, আর নেইমারের মতো ন্যাকামো ট্যাকামো তো নয়ই। ওর জন্য বিশেষ শুভকামনা। বড় ক্লাব দলে দেখতে চাই জেসুসকে।

রাশিয়ার উথ্থান চমকে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। প্রথম রাউন্ডে দারুণ খেলেছে তারা, তবে সাবেক এক চ্যাম্পিয়ন দল স্পেনকে ২য় রাউন্ডে টাইব্রেকারে হারানোটা সবচেয়ে চমকপ্রদ। এই বিশ্বকাপের মাঠ থেকেই পুতিন আমেরিকার দীর্ঘ একক আধিপত্য ভেঙে আবার বিশ্বের (সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন ছিল) সমান্তরাল আরেকটি প্রধান পরাশক্তি হবার মিশনে নামবেন, বা ইতিমধ্যেই নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। ইদানীং রাশিয়াকে প্রায়শই আন্তর্জাতিক নানান বিষয়ে মত ভিন্নতা থেকে সরাসরি যুদ্ধ, আক্রমণ, সামরিক পদক্ষেপ ইত্যাদির ভয় দেখাতে দেখা যায় সারা বিশ্বকে। রাশিয়ানরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত উন্নাসিক, বেপরোয়া, জেদি আর উগ্র স্বভাবের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান সৈন্যরা জার্মানিতে পৌছে অত্যন্ত বর্বরতা ও স্থানীয় নারীদের ওপর ভয়াবহ পৈশাচিক শারীরিক অত্যাচার করেছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক যোসেফ স্ট্যালিনকে এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে, তিনি সরাসরি কোনওরকমের ভণিতা ছাড়াই বেমালুম বলে বসেন, "পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করে জার্মানিতে গেছে আমার ছেলেরা। তারা স্বভাবতই এখন ক্লান্ত, এ সময় তাদের একটু আনন্দ ফুর্তির দরকার আছে বৈকি!"

যাই হোক, আজকে প্রথম খেলা উরুগুয়ে বনাম ফ্রান্স। দারুণ একটি ম্যাচ দেখার অপেক্ষা করছি। দুটো দলই সমমানের শক্তিশালী দল। তবে উরুগুয়ের রক্ষণভাগ আর্জেন্টিনার তুলনায় ঢের শক্তিশালী। ফ্রান্সকে গোল পেতে হলে প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে। বিগত খেলাগুলো দেখে আমি এই ম্যাচে উরুগুয়েকেই এগিয়ে রাখবো। ফ্রান্সের রক্ষণভাগ ত্রুটিপূর্ণ। আর্জেন্টিনা প্রচুর সুযোগ তৈরি করেছিল গত ম্যাচে। তবে আবারও বলছি, আমার কথায় বা ভাবনায় তো আর কিছু হবে না, হয়ও না! নইলে ৯৪ সাল থেকে মেক্সিকো কেন কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডিই পেরোতে পারে না! হা হা হা। আমার তো প্রতিবারই মনে হয়, ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানিকে হারিয়ে দেবে তারা, শ্রেয়তর দল হিসেবেই। কিন্তু কোনওবারই তো তা হয় না!

পরের খেলা ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম। এটাও খুব বড় একটা ম্যাচ হতে চলেছে। উভয়ই ফিফা রেটিংয়ের শীর্ষস্থানীয় দুটো দল। ব্রাজিল ১, বেলজিয়াম ৩। এখানেও আমি এগিয়ে রাখবো বেলজিয়ামকে। এ পর্যন্ত বেলজিয়ামকেই আমার ব্রাজিলের থেকে পরিণত, সুগঠিত, শ্রেয়তর দল মনে হয়েছে। মনে পড়ছে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টারে ফাইনালেই উভয় দল খেলেছিল, দারুণ লড়াই হয়েছিল সেই ম্যাচে। সেখানে তখনকার বেলজিয়াম অধিনায়ক উইলমোস্ট’র শুরুর একটি গোল অফসাইড বা অন্য কোনও কারণে রেফারি কর্তৃক বাতিল করা হয়, পরবর্তীতে এটা নিয়ে অনেকের সাথে, কিংবদন্তী আর্জেন্টাইন ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনাও রেফারির সমালোচনা করেছিল। এই বিশ্বকাপেও রেফারিং নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে, হবেও। এটাসহ আসন্ন প্রতিটি বিশ্বকাপেই হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, "মানুষ মাত্রই ভুল করে"। আর রেফারিরাও তো মানুষই, রোবট কিংবা ফেরেশতা নয়!

***
সেমি ফাইনাল লাইনআপ চূড়ান্ত, সমাপ্তির কাছে বিশ্বকাপ


ঢাকায় জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখা।

বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল লাইন আপ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়া। দুটো সেমি ও পরবর্তীতে ফাইনাল ছাড়াও, ফাইনালের আগে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলা হবে। সবমিলিয়ে শেষ চারটি ম্যাচের অপেক্ষা এখন সবার। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক একটি ম্যাচ ছাড়া আর কোনও গুরুত্ব বহন করে না- সাধারণ দর্শকের জন্যে যেমন, তেমনি সেমি ফাইনালে পরাজিত দেশ দুটির জন্যেও। আমি খুব খুশি হবো, বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া’র মধ্যে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হলে। নতুন এক চ্যাম্পিয়ন দেখার জন্যে মুখিয়ে আছি। নতুন একটি দেশ চ্যাম্পিয়ন মানেই শিরোপাধারী দেশের কুলীন ক্লাবে আরেকটি নতুন নাম যুক্ত হওয়া। সেই কবে ১৯৬৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। সেই থেকে চির ফেভারিট হয়ে আছে তারা বিশ্বকাপ আসরে। এবার এই তালিকা আরও স্ফীত হোক।

বেলজিয়ামের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে চার দলের মধ্যে। ফ্রান্স’র খেলোয়াড়রা রাফ, পাওয়ার ফুটবল খেলছে। উরুগুয়ের সাথে ম্যাচে প্রচুর ফাউল, নাটক, টাইম কিলিং ইত্যাদি অসাধুতা করেছে তারা। আমি কিছুতেই চাই না, ফ্রান্স ফাইনাল খেলুক। এছাড়া বিগত খেলাগুলো দেখে সার্বিকভাবে আমি বেলজিয়ামকেই শ্রেয়তর দল হিসেবে এগিয়ে রাখবো। তবে এটা যে মোটেও সহয হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। ২য় রাউন্ডের খেলায় আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকেও পরপর তিন গোল করে ফ্রান্সের এগিয়ে যাওয়া ছিল বিস্ময়কর। যে কোনও সময় গোল করার দক্ষতা রয়েছে ফ্রান্স দলের। বেলজিয়ামকে জিততে হলে ডিফেন্স খুব শক্ত রাখতে হবে, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে খেলোয়াড়দের। আর আমার মনে হয়, বেলজিয়ামের ডিফেন্স ফ্রান্সকে রুখে দিতে সক্ষমও বৈকি। দেখা যাক, কী হয়। খেলা তো আর অঙ্ক নয় যে, সূত্রানুযায়ী সব করলেই সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে। ফলাফল যে কোনও কিছুই হতে পারে। দেখা গেল, আমার সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে বেলজিয়ামকে সেমি ফাইনালে ৫-০ গোলে হারিয়ে দিল ফ্রান্স! হা হা হা।

ইংল্যান্ড ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে আমি ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে রাখবো। ক্রোয়েশিয়া ইংল্যান্ডের থেকে ঢের শ্রেয় দল। ইংল্যান্ড দলটা অনেকটা ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে সেমিফাইনালে এসেছে। তুলনামূলক তরুণ ও সাধারণ মানের একটি দল। এ পর্যন্ত তেমন কোনও শক্ত প্রতিপক্ষের সামনে পড়েনি তারা। কলম্বিয়া, সুইডেন দুটো দলই তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ ছিল। এবার সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া দুটো দলের থেকে অনেকটাই দক্ষ, সুগঠিত দল। শতাংশের হিসেবে আমি আমি উক্ত ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ৭০% বনাম ৩০% জয়ের সম্ভাবনায় এগিয়ে রাখবো। ক্রোয়েশিয়া চমৎকার দল। ওদের খেলা বরাবরই উপভোগ্য। মনে পড়ছে ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল তারা। ডেভর সুকার নামের একজন দারুণ ফুটবলার ছিল সেই দলে। ক্রোয়েটদের খেলার একটা দিক আমার খুব ভালো লাগে, তারা কখনওই সেভাবে ডিফেন্সিভ খেলে না। একাধিক গোলে এগিয়ে থাকলেও তারা সবসময় চেষ্টা করে গোল ব্যবধান আরও বাড়ানোর। শুভকামনা তাদের জন্য। পক্ষান্তরে ইংল্যান্ড, আগেই যেমন বলেছি, তুলনামূলক তরুণ অনভিজ্ঞ, সাধারণ দল। এই ইংল্যান্ড দল কিছুতেই গুণে মানে ক্রোয়েশিয়া’র সমকক্ষ নয়। তাদের জয় মানে নেহাতই বিশ্বকাপে আরেকটা অঘটনের জন্ম দেয়া।

ক্রোয়েশিয়া বা বেলজিয়াম’কে এই বিশ্বকাপের সম্ভব্য শিরোপা জয়ী দল হিসেবে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখছি।

সবমিলিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে দারুণ উপভোগ করেছি এই বিশ্বকাপ। প্রচুর গোল হয়েছে, প্রত্যেক ম্যাচেই গোল হয়েছে, আর এবারের বিশ্বকাপেই খুব সম্ভবত প্রথমবার কোনও গোলশূন্য ম্যাচ দেখতে হয়নি আমাদের। রাশিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ দুর্দান্ত একটি বিশ্বকাপ উপহার দেবার জন্য। গতকাল রাতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ট্রাইবেকারে দুঃখজনকভাবে হেরে গেছে তারা। তবে তাদের খেলা দারুণ উপভোগ্য ছিল। রাশিয়ানরা খেলোধূলায় বরাবরই ভালো। অলিম্পিক গেমসে প্রচুর পদক পায় তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গড়া অন্যান্য দেশও বিভিন্ন খেলাধূলায় ভালো করে আসছে নিয়মিতভাবে।

যাই হোক এখন অপেক্ষা সেমি ফাইনালের...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:৩২
৪টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×