somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিতাগাছ

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মামার একটা পুরোনো মোটর বাইক আছে। পুরোনো বলতে কি, বেশ পুরোনো। বছর বিশেক তো হবেই। হোন্ডা সিডিআই ১০০। বর্তমান সময়ের মোটর বাইকগুলোর মতো জ্বালানি সাশ্রয়ী না হলেও বেশ শক্তিশালী। ধান ক্ষেতের আইল দিয়েও চালানো যায়। আমার মোটর সাইকেল চালনায় হাতে পায়ে খড়ি হয় এই বাইকটা দিয়েই। তখন বাইক চালানো একটা থ্রিল ছিলো। রোমাঞ্চকর ব্যাপার। এখন বিষয়টা যত প্যাচপ্যাচে হয়ে গেছে ততটা তখন ছিলো না। এই বাইকে করেই আমরা রওনা হলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। এই এলাকার পথঘাট মানচিত্র একসময় আমার মুখস্থ ছিলো। কিন্তু এই কয় বছরে বেশ খানিকটা বদলে গেছে চারপাশ। আগে যেখানে জঙ্গল, জলা, পুকুর, ডোবা ছিলো সেখানেও এখন মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হয়েছে বা হওয়ার প্রিপারেশন চলছে। হঠাৎ চারপাশ দেখলে কেমন জানি অপরিচিত মনে হয়। তবু খানিক সময়ের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গেলো চোখ।

মামার বাসা থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসা বা বাড়ির দূরত্ব ছয় কিলোমিটারের মতো হবে। শহর ছাড়িয়ে আরো অনেকটা যেতে হয়। রাস্তা অবশ্য পাকা। পিচ করা পথ। দুই পাশে সদ্য লাগানো একাশিয়া আর ইউক্যালিপটাসের বাহার। আট/দশ বছর আগেও এই জায়গাগুলোতে পুরোনো গাছগাছড়ার দেখা মিলতো হামেশাই। ছাতিম, ক্যাওরা, ম্যাড়া থেকে শুরু করে বট, রেন্ট্রি। আম, জাম, কাঁঠালের কথা তো বলাই বাহুল্য। রাস্তা পাকা ও চওড়া করার সময় হয়তো ওই আদি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। রাস্তার দুই ধারে লাগানো হয়েছে নতুন নতুন বিদেশি গাছ। দ্রুত বর্ধনশীল গাছগাছালি। ফলে এই কয়েক বছরেই গাছগুলো বেশ লম্বা আর পুষ্ট হয়ে উঠেছে। লম্বা অথচ সরু হওয়ায় ছায়া খুব একটা পড়ে না। রোদ-গরমের দিনে তাই হয়তো ছায়া বা বাতাসও খুব একটা পাওয়া যায় না। এখন বাদলার সময় চলতে থাকায় আকাশ কালো কালো মেঘে ঢেকে আছে। রোদ নেই। রোদের সম্ভাবনাও নেই।

মোটর বাইকের পেছনে বসেও আলী ঝিমাচ্ছে। এত ঘুম যে ব্যাটার কোত্থেকে আসে! সুযোগ পেলেই ঘুমায়। না পেলেও ঝিমায়। আমাদের বয়সের অন্যরা যখন ঘুম, খাওয়া কমিয়ে ঘাম ঝরাতে চেষ্টা করে, সে তখন ঘুম, খাওয়া আর রোগভোগ নিয়ে পড়ে থাকে। কিছুদিন পরে পরে ডাক্তারের কাছে দৌড়া ছাড়া নিয়মিত কোথাও যেতে হয় না। অবশ্য চাকরীটা করতে হয় কেননা চাকরী না করলে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না। আলী মাঝে মাঝে বলে, কিছু টাকা যদি জমাতে পারি, বুঝলি রূপম, ছেলেপিলের জন্য রেখে যাব। ব্যাটাদের চাকরী বাকরী করে খেতে হবে না। নিজের মেধা ব্যবহারের সুযোগ পাবে। আমি মনে মনে বলি, এখনো বিয়ের নাম গন্ধ নেই, ছেলেপিলের ভবিষ্যত ভাবতে বসেছো ভায়া।

আমরা যখন গন্তব্যের ঠিক কাছাকাছি তখনই বিকট শব্দে বাজ পড়লো। চমকে উঠলাম আমি। চলন্ত অবস্থা থেকেই থামিয়ে ফেললাম বাইক। আলীও বিরাট একটা ঝাঁকি খেলো। ও বললো, আমাদের ঠিক পেছনেই কোথাও পড়েছে বাজ। পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটা নিঃসঙ্গ তালগাছ পুড়ে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের থেকে বড়জোর একশো গজ হবে দূরত্ব। মনে মনে আল্লাহ নবীজির নাম নিলাম। আরেকটু সামনে পড়লেই তো কেল্লা ফতে হয়ে যেতো।

সাথে সাথেই বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি মানে কি, একেবারে কুকুর বিড়ালের যুদ্ধ। কোনোমতো আধভেজা হয়ে বাড়ির উঠানে উঠলাম। আমি আধভেজা হলেও আলী প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছে। দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে গলা, মাথা মোছার সাথে সাথেই ইয়া দশাসই চেহারার এক পালোয়ান আমাদের সামনে এসে হাজির।

কারে চান? কড়া ভাষায় আমাদের প্রশ্ন করে। এই বৃষ্টি-বাদলের তাড়া খেয়ে কোনো পথিকও তো উঠতে পারে উঠানে। লোকটা সেই দিক থেকে কোনো চিন্তাই করে নি। নাকি তার ধারনা হয়েছিলো কারো এমন সাহস নেই।

আমি বললাম, চেয়ারম্যান কাকা আছেন?
এবার তার ভাব কিছুটা বদলালো। বললো, আপনের নাম কি রূপম?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
মুখের ভাব একেবারে গলে গেলো তার, আসেন আসেন, মালিক বৈঠক খানায় আপনেদের লাইগ্যা ওয়েইট করতাছে। বলেই কাঁচুমাচু হয়ে ভেতরবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আমরাও তাকে ফলো করলাম।

বাড়ি তো নয় যেন মহল্লা। বেশ বড় পরিধি। তিন দিক দিয়ে ইটের দেয়াল। সামনের দিকটা অবশ্য খোলা। খোলা না থেকে যদি সেখানেও কোনো ইয়া বড় লোহার গেট থাকতো, তাহলে আমাদের কপালে আরো ভোগান্তি হতো নির্ঘাত। অবশ্য সামনের দিকে পাকা রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে আমরা এসেছি। বাকি তিন দিকেই জঙ্গল। ওদিক দিক দিয়ে সাপখোপ বা অন্য কোনো ক্ষতিকর কোনো প্রাণি বাড়িতে যাতে না ঢুকতে পারে সে জন্যেই হয়তো ওই দিকগুলো দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে।

বেশ খানিকটা হেঁটে আমরা বৈঠক খানায় উপস্থিত হলাম। বিরাট বড় হলঘর। এক কোণায় ঝকঝকে ফরাস পাতা। ঘরের প্রায় মাঝামাঝি। তিন দিক থেকে তিনটা বড় সোফা ফরাসটাকে ঘিরে রেখেছে। বাকী দিকে একটা সিঙ্গেল সোফা। আয়তনে বেশ বড়। বোঝা যায় ওটা চেয়ারম্যান সাহেব নিজে ব্যবহার করেন। ওটার যতœআত্মিও করা হয় অন্যগুলোর চেয়ে নিয়মিত। ফলে ওটা যত ঝকঝকে, বাকি তিনটা সোফা ততটা ঝকঝকে নয়। আমাদের ইঙ্গিতে বসতে বলে পালোয়ার আরো ভেতরবাড়ির দিকে চলে গেলো। আমরা বসলে সোফাটাই ভিজে যাবে। তারচেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। আলী দেখলাম কোনো সংকোচ না করেই বসে পড়লো। ওর চোখে মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে। জাপানীদের মতো ফুলে থাকে চোখের উপরটা। ফলে মনে হয় খুব ঘুম পেয়েছে অথবা এইমাত্র বেশ জমিয়ে একটা ঘুম দিয়ে উঠলো।

কয়েকবার হাঁচি এসে যাওয়ায় বুঝতে পারলাম ঠা-া লেগে গেছে ইতোমধ্যে। জ্বরটরও শুরু হতে পারে। ঠিক দুপুর বেলায় কারো বাড়ির বৈঠক খানায় এভাবে বসে থাকতে কেন জানি না সংকোচ লাগতে লাগলো খুব। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে অনেক বছর যাবৎ আমার সাক্ষাৎ হয় নি। এখানে থাকাকালীন মাঝে মাঝে হতো। মামার সাথে আসতাম। মামা যখন চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দাবা খেলায় মগ্ন থাকতো আমি তখন ভেতর বাড়ির লোকজন বিশেষত বাচ্চাদের সাথে খেলাধূলা করে সময় কাটাতাম। বাচ্চাগুলোর কথা মনে করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কারো মুখই সেইভাবে মনে এলো না। আসলে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না তো। শুধু মাঝে মাঝে খেললেই তো আর সবার মুখ মনে থাকে না।

ভেজা জামা গায়ে লেগে প্রচ- শীতও করছে। আলীকে বললাম, কি রে, চোখ বন্ধ করে ফেলছিস যে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?

চোখ বন্ধ রেখেই ও উত্তর দিলো, চেষ্টা করছি।

আর ঠিক তখনই চেয়ারম্যান সাহেব ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। মামার কাছেই একবার শুনেছিলাম চেয়ারম্যান সাহেব নাকি কোনোদিন চেয়ারম্যান নির্বাচনে পাস করতে পারেন নি। তবু কয়েকবার ফেল করার পরেও সকলে তাকে চেয়ারম্যান সাহেব বলেই ডাকে। সম্মান করে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ধন-সম্পদেরও একটা প্রভাব আছে এই সম্মানের পেছনে।

ভদ্রলোক আমাকে বললেন, কি রে ব্যাটা, একেবারে ভিজে গেছিস দেখছি। বোস। তারপর ভেতর বাড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন, কবিরুল, দুইটা শুকনা পাঞ্জাবী আর দুইটা লুঙ্গি নিয়ে আয়। বলার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী চলে এলো। আমার চেয়ে দ্রুততায় আলী তার কাপড় পাল্টে ফেললো আর চেয়ারম্যান সাহেবকে কদমবুসি করে অত্যন্ত ধীরে ধীরে কী সব কথা বার্তা বলতে লাগলো। আমার তো হাঁচি দিতে দিতে জান শেষ হওয়ার অবস্থা। তাই আর ওইদিকে মন দিতে পারলাম না।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×