somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কারকোল চিকেন এবং সাগরের সাথে কিছুক্ষন

১৯ শে জুলাই, ২০০৬ সকাল ৭:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ন্যাড, খোদার এক সৃষ্টি বটে! প্রথম প্রথম ওর কথা বুঝতে আমার খুব সমস্যা হত। সমান তালে চিটাগঙী, বাংলা আর ইংরেজী ছাড়ে, একদম ল্যাটকা খিচুরি বানিয়ে। খুব দ্রুত কথা বলে। চালচলন পাইরেইটস অফ ক্যারিবিয়ানের জনি ডেপ ওরফে ক্যাপ্টেন স্প্যারোর মত, প্রমিস। সারাক্ষণ ননস্টপ কথা বলছে আর হাত পা ছুঁড়াছুঁড়ি করছে, লাফাচ্ছে। লোকালয়ে ওকে নিয়ে হাঁটতে আমাদের লজ্জাই লাগে। যেখানেই যাই, স্পষ্ট বুঝি আশে পাশের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হয় ও বিকট বিকট সব মন্তব্য ইংরেজিতে করছে আর না হয় বাংলায় কথা বলছে কিন্তু বিকট ভাবভঙ্গীমায় হাত পা ছুঁড়ছে। এক এক বার বলি, দোস্ত, দেখি তো, ওই লাইনটা ধরে সোজা হাঁটতে পারিস কি না! দু'কদম পরেই আবার সে জনি ডেপ! পুরো কমেডি কেইস। ন্যাচারালি হিলারিয়াস, ইউনিক। স্রষ্টা ওকে পাঠিয়েছইে এক গাদা লাফিং গ্যাসসহ। কখখনও ভুলার মত না।

কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার বন্ধুত্ব হয় সব পাগল, বা শুড আই সে 'আউট রেইজাস' মানুষদের সাথে, আত্মভোলা পাবলিকের সাথে। বাংলাদেশে ছিল, সিডনীতে এসেও হল। এর মধ্যে ন্যাড হচ্ছে 'দি ক্লাসিক'। আজ বেটি আমাদের, বন্ধুদের খাওয়ালো। হলিডে তে একটা দোকানে কাজ করেছে, সেদিন জনে জনে ফোন করে বলছে, 'দোস্ত, সাতশ ডলার জমাইছি, তোদের কারকোল চিকেন খাওয়ামু। টাইম প্লেইস ঠিক কর!'

কারকোল চিকেন ওর নিজেস্ব ডিকশনারীর শব্দ, ইংরেজিতে যা কিনা 'চারকোল' চিকেন। বহুদিন আগেই এই বিবর্তন হয়েছে ন্যাডের ডিকশনারীতে। কতবার যে ঠিক করে দিয়েছি, 'আরে গাধা, চারকোল'। ও নির্বিকার, 'ওই হল'। এখন আমরাও সমান তালে বলি, 'কারকোল চিকেন'।

সবার সময় সুযোগ বুঝে আজকের দিনটাই বেছে নেয়া হল। আমার দায়িত্ব ছিল সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করা। ইউনিভার্সিটির আশে পাশের হালাল দোকানগুলোতে খেয়ে ভাজাভাজা করে ফেলেছি। চাচ্ছিলাম গতানুগতিক সব ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে। যা বেছে নিলাম, সেটা বেশ নামী বটে, কিন্তু স্টেশন থেকে অন্তত আড়াই কিলোমিটার দুরে। কখনও যাই নি। সকালে ব্লগাতে ব্লগাতে ডিরেকশন ভাল করে দেখা হল না, তাই স্ট্রীট ডাইরেকটরির দু'টো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে দিলাম দেঁৗড়।

যাওয়ার পথে ট্রেইনে ন্যাডের ফোনকল, 'দোস্ত, স্টেশনে আসতে আসতে আমার স্কার্টটা এক ইঞ্চি ছিড়ে গেছে, পারা লাগায় দিছিলাম। কি বেইজ্জতি কারবার! ইশিকে ফোন করে দিছি, সুঁই সূতা নিয়ে আসতেছে'। আমি এক চোট হেসে নিলাম। এই না হলে ন্যাডু!

এক ঘন্টার একলা ট্রেইন ভ্রমণ শেষে যখন রকডেল স্টেসনে পৌছলাম, ততক্ষণে সবাই চলে এসেছে। আমাকে দেখে ন্যাড দূর থেকেই ঝাপাঝাপি শুরু করেছে, আর দুই হাত মাথার উপর তুলে তীব্র বেগে নাড়াচ্ছে। জড়িয়ে ধরলাম কাছে গিয়ে, অনেক দিন পরে দেখলাম।

এবার হাঁটার পালা, ছয় হিজাবীর দল। ন্যাডকে নিয়ে একটু ভয়ে থাকি সারাক্ষণ, যেই হারে চেঁচাতে থাকে, একটু পর পর বলতে হয়, দোস্ত, আস্তে। নইলে লোকজন টেররিস্ট ভেবে তোরে ধরায় দিবে। ভয়ে ভয়ে কাওকে বলছিলাম না, দুরত্বটা এত বেশি, মানে আড়াই কিলোমিটার। শুধু বললাম, দূর আছে, হাঁট।

একে তো দুরত্ব তার উপর পূব দিক থেকে আসা তীব্র বাতাস, আমাকে গালি দিতে দিতে যখন আর রাখছে না তখন অবশেষে পৌছলাম ন্যান্ডোজ। স্প্যানীশ সালসার তালে দুলতে দুলতে ছয় জনে ছয় রকম অর্ডার, এক জনে একটা নেয় তো আরেক জন সিদ্ধান্ত পাল্টায় এই করতে করতে ওয়েটার ব্যাটার মাথার সব ক'টা চুল পাকিয়ে ফেললাম। খাবার আসতেই সবাই হামলে পড়লাম। ঝালের ছয় রকম রেইনজ আছে, আমি সব চেয়ে ঝালের এক ধাপ কমটা নিয়েছিলাম। পারফেক্ট। ন্যাড চিটাগঙি হয়েও চিটাগঙের ইজ্জত রাখতে পারল না, সব চেয়ে ঝালটা খেয়ে ওর চোখের পানি নাকের পানি এক হল। বার্গার একটা শেষ করে আরেকটা অর্ডার দিল, 'ধূর শালা খাইতেই তো পারলাম না, মরিচের ডিব্বা খালি করে ঢাইলা দিছে।' তাসিন সব চেয়ে কম ঝালটা নিয়েই টমেটোর মত লাল হয়ে বসে আছে আর ড্রিংকস ঢালছে গলায়। র্যাবস অবাঙালি বেচারী আমাদের সাথে থাকতে থাকতে বাংলা কথারও উত্তর দিচ্ছে। একটু পরে শুরু হল অদ্ভূত ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। ইয়া হা করে বার্গারে কামড় ইত্যাদি ইত্যাদি, হাই স্কুল কান্ডকারখানা। ন্যাডের বেফাঁস কথাবার্তা তো আছেই। সবাইকে ও বিশেষ বিশেষ নামে ডাকে, ইশিকে ডাকে 'লুজার'। রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের সাথে ইংরেজিতে কথা বলার সময় ন্যাড ডাক দিল, 'ওই লুজার!' ইশির সিরিয়াস অভিমান, পুরানো দম্পত্তির মত, 'তুই আমাকে মানুষের সামনে লুজার ডাকবি না তো!' ওয়েটারটা আমাদের দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল + চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল সে বাঙালি। কিছুক্ষণ পরে ন্যাড ওর স্বভাব মত হঠাৎই বলে, দ্যাখ দ্যাখ, কি সুন্দর করে ক্লীন করতেছে মাশাল্লাহ। তাকিয়ে দেখি ওয়েটারটা কি যেন মপ করছিল, ন্যাডের কথা শুনেই আগুন গরম চোখ করে তাকালো। ন্যাড মাথা নিচু করে ভাল মেয়ে হয়ে খেতে লেগে গেল।

ওরা সবাই একই হাই স্কুলে গিয়েছে, আমার হাই স্কুলে কোন বাঙালি ছিল না। বিভিন্ন প্রোগ্রামের বদৌলতে এদের সাথে ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। হাই স্কুল শেষে এখন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এক এক ইউনিভার্সিটিতে। এক সাথে হলে আমাদের বয়স দশ বছর পিছিয়ে যায় ঠিক।

ওদের এত করে হাঁটালাম, পুরোটাই ফালতু ছিল না। ন্যান্ডোজ থেকে বেরিয়ে বললাম, চল একটু ওদিকে হাঁটি। পূব দিকে নাক বরাবর হাঁটা দিলাম। সোজা হাইওয়ে বরাবর আরেকটু এগুতেই সবাই চিৎকার করে উঠল। রাস্তাটা হঠাৎই 'টি' তে শেষ হয়ে গেছে। এরপর একটু ফুটপাথ, তারপরে উঁকি দিচ্ছে সাগরের নীল জল! ফুটপাথের পরের ঢালু অংশটা কংক্রীট দিয়ে বাঁধানো, সিঁড়ি দিয়ে কয়েক মিটার নিচে নামলে সমুদ্র সৈকত, এরপরেই সমুদ্র। সমুদ্র সৈকতটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না উঁচু ফুটপাথটা দেয়াল হিসেবে কাজ করছে তাই। আমরা তরতরিয়ে নেমে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নামলে 100% প্রাইভেসি! 'দীর্ঘ' সমুদ্র সৈকত বলতে হলে একেই বলতে হবে বোধ হয়। দুই দিকে যতদূর চোখ যায় সমুদ্র সৈকত। আকাশ মেঘে ঢাকা বলেই হবে, কোথাও কেউ নাই! শুধু এক পাল গাঙচিল খেলা করছে। সমুদ্র সৈকত তখনও ভার্জিন, মসৃণ। ভাটা হওয়ার পরে কেউ হাঁটে নি। একেবারে কেউই না। আমরা আর পারলাম না, স্যান্ডেল খুলে নেমে গেলাম। মিহি, মসৃণ বালু। কিছু কিছু সৈকতে বালুর দানা এত গোবদা মাকর্া হাঁটার সময় পায়ে লাগে। এটারটা পারফেক্ট। ব্যাগ ট্যাগ ফেলে রেখে একদম ভুলে গেলাম সব কিছু। শিশুকালের নিষ্পাপ অবস্থা ফিরে পেলাম ক্ষনিকের জন্য, প্রচন্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। বহুদিন পরে দেঁৗড় দিলাম, হাত ধরাধরি করে। মসৃণ বালিতে ছন্দময় ছাপ ফেলে। সাগরের ঢেউয়ের সাথে ছোঁয়া ছোঁয়ি খেললাম। সাদা সাদা গাঙচিলের সাথে দেঁৗড়ালাম। ছোট বেলার একটা খেলা রিইনভেন্ট করলাম: দু'জন দু'জনের হাত ধরে পা গুলো কাছাকাছি রেখে মাথা পিছনে হেলে তীব্র বেগে ঘুরন্তি। কিছুক্ষণ পরে মনে হয় আমরা স্থির, সারা পৃথিবী পাগল হয়ে ঘুরছে! তাসিন তো ফ্যান্টাবুলাস কার্টউইল করে ফেলল, এত্ত হিংসা হল, আমি পারি না! ঝিনুক কুড়ালাম, সবাই পা দিয়ে বিশাল এক পোট্রেইট এঁকে ফেললাম সৈকতের বালুতে। উচ্ছ্বাস নিশ্চয়ই সংক্রামক, আশে পাশের সারা প্রকৃতি সত্যিই আমাদের সাথে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল। নইলে পাশে তাকিয়ে হঠাৎ কেন দেখব ইয়া লম্বু একটা গাছ আরেকটা গাছে হেলান দিয়ে আছে, যেন কাছাকাছি যাওয়ার পাঁয়তারা, প্রেমে পড়লে যা হয়! ওই নিয়ে হাসছিলাম তখনই র্যাবসের চিৎকার, গাইজ, লুক! পিছনে তাকিয়ে অভাবনীয়, অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। আমার (প্রায়) বিশ বছরের জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য খুব কম দেখেছি...

বিশাল সমুদ্রের এপাশ থেকে ওপাশে বি-শা-ল এক রংধনু, জীবনের সব রং নিয়ে জেগে উঠেছে ছয় কিশোরীর উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হতে...
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০০৮ সকাল ৮:৩৮
৩৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×