“ভোরবিহানে মনুর মা বদনা হাতে বাইরে গেল। আর ঘরে ফেরার নাম নেই। মনুর
বাপ মনুর মাকে ডাকতে ডাকতে বাইরে গিয়ে দেখে, মনুর মা বদনা হাতে
তালগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কথাও বলছে না, নড়ছেও না! কোনো
সাড়া না পেয়ে মনুর বাপ এগিয়ে গিয়ে মনুর মার হাত ধরে টান দিতেই
মনুর মা মাটিতে পড়ে কাঁচের মত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মনুর বাপ
ভাঙ্গাচোড়া মনুর মা‘র দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কান্না
জুড়ে দিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল!‘
এমনই একটা ঘটনা হাত-পা মেলে মুহূর্তে রটে গেল গ্রামে।
যে-ই শুনেছে সে-ই পাগলের মত হা হা করে ছুটে এসে ভিড় করেছে মনুদের
তালতলায়। কেউ দরজার জিন লাগিয়ে, কেউ না লাগিয়ে ছুটে এসেছে
এখানে। এরা ভয়ে-কৌত‚হলে বলাবলি করছে, এমন আজব ঘটনা তো জীবনেও
শুনিনি!
কোত্থেকে জানি কয়েকজন সঙ্গীসহ মস্তবড় এক ওঝা হনহন করে চলে এলো
এখানে। ওরা এসেই বলল, ‘এগুলান মহা পাঁজি ভ‚তের কাম। এখনই ওদের কোমড়
ভাঙতে না পারলে এ গ্রামের যার-তার ওপর ‘আছর-আবদার‘ করে সাংঘাতিক
ফ্যাসাদে ফেলে দিতে পারে। ছেলে-বুড়ো কেউই নিরাপদ না। এদের কবলে পড়লে
আর দিশা-মিশা পাবে না কেউ! তয় চিকিৎসা শুরু করলে আপনাদেও সামনে
ভাঙ্গা মনুর মা উঠে দাঁড়াবে, মনুর বাপ ফিরে এসে সবাইকে সালাম দিয়ে
ঘরে চলে যাবে!’
‘তাহলে কি শুরু করবো ভয়ঙ্কর পাঁজি ভ‚তের চিকিৎসা?’ সবাই সমস্বরে শুরু
করেন, ‘শুরু করেন, বলে ওঝাকে অনুমতি দিল। কয়েকজন ফিসফিস করে বলল,
‘ওঝা একখান!‘
দুই.
ওঝা তার কাঁধের ঝোলার গভীর থেকে সাপের মত বাঁকা ও মসৃণ একটা কাঠি
বের করল। সে খুব যতেœ পকেট থেকে রঙ্গীন রুমাল বের করে ফুঃ-ফাঃ করল এবং
সেই কাঠি দিয়ে উপস্থিত লোকেদের ঘিরে দাগ কেটে চিৎকার করে বলল,
‘বন্ধসঢ়;ধ, সব বন্ধসঢ়;ধ! কেউ কথা বলবি না, নড়াচড়া করার চেষ্টা করবি না, করলে,
ফানাফানা হয়ে যাবি, রক্ত বমি হবে। ছুঃ ছাঃ ফুনা-ফুন, ফুঃ ফুঃ ফুঃ।’
ওঝার মন্ত্রঝাড়ের ব্যাপক আয়োজন শুরু করে দিল। তার আয়োজনের ধরনটা
সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর ও রহস্যময়! ওঝার অকথ্য মন্ত্রবাণে আর নর্তন-কুর্দনে সবাই
তটস্থ। কিছুতেই কিছু হচেছ না। কাপড়ে ঢাকা কী যেন একটা পড়ে আছে
সামনে। মনুর মা উঠে দাঁড়াচেছ না, নড়াচড়াও করছে না, মনুর বাপেরও
কোনো খবর নেই। ওঝা মাঝেমধ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
‘খামুশ ইবলিশ শয়তান, খামুশ। আমার হাত থেকে বাঁচতে এক সিকন্ড সময়
পাবি না তোরা। এইতো চলে আসছে বলে।’ তারপর সে শূণ্যের দিকে হাত
বাড়িয়ে কী জানি ধরে মুচড়ে ভেঙ্গে কিছু পকেটে ঢুকালো আর কিছুটা
দিল মুখে। মজাকরে খাওয়ার শব্দ করে চিবিয়ে খেয়েও ফেলল। তার হম্বি-তম্বি আর
তেলেছমাতি দেখে সবাই বাকরুদ্ধ।
তিন.
সবাই পড়ে গেল ওঝার গ্যাঁড়াকলে। ওঝা চোখ বড় করে বার বার স্মরণ করিয়ে
দিচেছ যে, ‘পারমিশন ছাড়া এক পা নড়লে রক্ত বমি হবে।‘ এ কথা বলতেই এক
যুবক ওয়াক ওয়াক করে পাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল এবং তার মুখ থেকে
সত্যি সত্যি রক্তের লোল বেরিয়ে এলো। জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখে সবাই হতভম্ব।
ওঝা লাফিয়ে উঠে বলে ‘কেউ যদি এখন নটর-চটর করিস তাহলে কিন্তু সামাল
দেয়া যাবে না। কাজ প্রায় শেষের দিকে। ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। কারণ মনুর মা-
বাপকে বাঁচাতে হবে আগে তারপর অন্যকথা। সবাইকে কাজ শেষ না হওয়া
পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ পালাবার চেষ্টা করলে মুখ দিয়ে
কলিজাশুদ্ধ রক্ত বেরিয়ে আসবে।
ওঝা তার হাতটা টেলিফোনের মত করে কানে ধরে খোলা আকাশের দিকে
তাকিয়ে কথা বলছে, ‘হ্যা হ্যা, হ্যালো হ্যালো, কখন? মনুর মা ও বাপ ঠিক
আছে তো? আসছে কখন? ছেড়ে দে। এদের কোন ক্ষতি হলে কিন্তু কঠিন বান
মেরে চিরদিনের মত ঘুম পাড়িয়ে রাখব। আমার নাম তুফাইন্না ওঝা। বুঝলি
বেটারা, বুঝলি? হ্যা বুঝেই যদি থাকস তো ওদেরকে সসম্মানে ওদের ঘরে
যাওয়ার ব্যবস্থা করে দে। হ্যা, তাইলে কি আমার এখানে থাকার আর প্রয়োজন
নেই, চলে যেতে বলছিস? আর লোকগুলো? অনেকক্ষণ তো হলো। হ্যা হ্যা, তারা
কখন যাবে? আমি চলে আসার পর? আচছা ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
চার.
কান থেকে হাতটা নামিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওঝা বলল কাজ হয়ে গেছে।
আচছা, বেটা-বেটিরা শোন, আমরা গিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি এখনই।
আর তোরা থাক এখানে। মনুর মা এখনই নড়ে-চড়ে উঠবে আর মনুর বাপ
আসামাত্র মনুর মা ও বাপকে এক পাটিতে বসিয়ে লেবুর শরবত খাওয়াবি।
বুঝলি ব্যাটারা?’
সবাই একটু স্বস্তিবোধ করে বলল, ‘ওঝা ভাই আমগোরে চলে যাওয়ার অনুমতি
দিয়ে যান। উদাম রেখে এসেছি ঘর-দুয়ার।’
ওজা বলল, ‘আচছা আমি এখন চলে যাচিছ। মন্ত্র পড়ে দিয়ে যাচিছ আমি
চলে যাওয়ার আধাঘন্টা পর এ সাদা দাগের বান খুলবে। তখন ধীরে ধীরে বাড়ি
চলে যাবি।’ এ কথা বলে ওঝা ঝোলাটা কাঁধে তুলে সঙ্গীদের নিয়ে হনহন করে
চলে গেল।
ওঝার দেয়া সময় শেষ হলো। জবুথবু লোকজন সাবধানে পা তুলে বৃত্তটা
ডিঙ্গিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে যার যার বাড়ি গিয়ে উঠল। ওরা ঘরে ঢুকেই ’ওরে আল্লারে, কি সর্বনাশ
হলোরে' বলে চিৎকার চেঁচামিতে বাতাস ভারী করে তুলল।
কারো ঘরে একটা মূল্যবান জিনিসও আর অবশিষ্ট নেই!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৩০