somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

নতুন বাবা

৩১ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নতুন বাবা হয়েছে সাজু। দেশ থেকে এইমাত্র ফোনে খবরটা পেল সে। কান দিয়ে শুনেছে আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে, সে বাবা হয়েছে।

বাবা হওয়ার খবরটা যখন পায় তখন সাজু ছিল রান্নার কাজে। আনন্দের ঠেলায় সে আলু, পটল, বেগুন, সিম, লাউ যা ছিল তাই ঢিলাঢিলি করে, লাফিয়ে-ধাপিয়ে, হই-হুল্লোড় আর চিল্লাচিল্লি করে একাকার করে দিল। তারপর সে বেরোলো পথে। সে শূণ্য আকাশের দিকে মুখটা তুলে বলে, হে পৃথিবী, চেয়ে দেখ, আমি বাবা হয়েছি। আজ আমার চেয়ে সুখী, আমার চেয়ে গর্বিত আর কেউ নেই। আমি বাবা হয়েছি।

যাকে সামনে পায় তাকেই ঝাপটে ধরে একচোট কোলাকুলি করে ফেলে সে। তারপর হাত দুটো ধরে মাথাটা কাত করে মিনতির স্বরে বলে, দোয়া করবেন ভাই, ফোনে খবর পেলাম, আমি এইমাত্র বাবা হয়েছি। আমার একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। দোয়া করবেন ভাই, দোয়া করবেন। যাকে বলে সেও হাত বুলিয়ে তার আনন্দে সায় দেয়।

এসব করতে করতে নেচে-গেয়ে সে গেল মিষ্টির দোকানে। যা ছিল দোকানে তার প্রায় সবটাই নিয়ে এলো। সে যেখানে কাজ করে সেখানে গেল। বাবা হওয়ার আনন্দে টগবগ করতে করতে সে দুইহাতে মিষ্টি বিলিয়ে দিল। তার সমস্ত শরীরে আনন্দ-ফুর্তিরা ঢেউ খেলছে। তার চোখ ঠিকরে আনন্দ আলোর বান ছুটেছে।

আচ্ছা কী নাম রাখা যায় মেয়ের? পৃথিবীর সেরা নামটাই যে রাখতে চায় সাজু। নবজাতকের সুন্দর নামের একটা বই কিনেছে। তার পরিচিতদের সাথে যখন-তখন পরামর্শ করে নামের ব্যাপারে। তারপর পছন্দসই একটা তালিকা করল। তালিকার নামগুলোর মধ্যে যে কয়টা বেশি ভাল লাগে সেগুলোকে প্রথম দিকে নিয়ে রাখল। তালিকার প্রথম দশটি নাম সে বারবার আওড়ায়। বলতে, শুনতে কোনটা কেমন লাগে, সে বারবার বলে সেটা টেষ্ট করে। একা একা সেই নাম ধরে মেয়েকে ডাক পাড়ে। তার পরিচিতদের তালিকা দেখিয়ে বলে, এ নাম ধরে একটা একটা ডাক দাও তো দেখি কোনটা শুনতে কেমন লাগে। তারা একটা একটা নাম ধরে ডাক দেয়। সে কানপেতে শোনে। তারপর সাদা কাগজ নিয়ে এলো বাসায়। চিকন-মোটা কলম দিয়ে নানাভাবে নানা ডিজাইন করে লিখে দেখে কেমন দেখা যায় নামটি। এভাবে কন্যার নাম রাখার কসরত করে নতুত বাবা সাজু।

সাজু স্ত্রীকে ফোন করেই বলে, আমার মাইয়ারে দেও। স্ত্রী বলে, হায় হায় কন কি আপনি। মাইয়া কি কথা বলতে পারে যে ফোন দিব? মাইয়া আমার ঘুমাইতেছে। সাজুও জানে তার মেয়েটি কথা বলতে পারে না। তবুও এসব বলে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে ভীষণ ঝগড়া বাধায় সে। মেয়ের সাথে ফোনে আলাপ করাকে নিয়ে স্ত্রীর সাথে ভীষণ ঝগড়া করে সে। এ ঝগড়ায় কখনও রক্ত ঝরে না, আনন্দাশ্র“ ঝরে।

এসব নিয়ে নতুন বাবাটি যখন আনন্দে আর স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখন সাজুর অশিতিপর নিঃসঙ্গ বাবা একমাত্র সন্তান সাজুকে দেখার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে। সাজুর মা নেই।

বাবা তাকে পর পর দুবার বিদেশ পাঠিয়েছে জমি বিক্রির টাকা নিয়ে। বিদেশে অনেক পরিশ্রম, সুবিধা নেই এসব বলে সে ফিরে আসে দেশে। তাকে সংসারী করার জন্য এবং বৃদ্ধ বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য সাজুকে বিয়ে দেয়। সাজু আবারও বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা চায় বাবার কাছে। বাড়ির ভিটামাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। তার বাবা তাকে টাকা দিতে পারেনি। তার বউ বাপের বাড়ি থেকে এবং গয়নাগাটি বিক্রি করে সাজুকে বিদেশ পাঠায়। সাজু বিদেশ যাওয়ার সময় তার বাবার সাথে খুব একটা ভাল আচরণ করে যায়নি।

সাজু বিদেশ যাওয়ার পর মাস তিনেক তার স্ত্রী সাজুর বাবার সাথেই ছিল। তারপর একটু দূরে আলাদাভাবে একটি ঘর করে শ্বশুর থেকে আলাদা থাকতে থাকে সাজুর স্ত্রী। শ্বশুরকে সে ভাল চোখে দেখে না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনবেলা যা খেতে দেয় তা-ই খেয়ে কোনোমতে দিন কাটে সাজুর বাবার।

বাবার একমাত্র ছেলে সাজু। তাকে দেখার জন্য এবং তার সাথে কথা বলার জন্য বউমার কাছে অনেক করে বলেছে বাবা কিন্তু বউমা কোনোদিন ফোনে তার বাবার সাথে ছেলেকে আলাপ করতে দেয়নি।

সাজুর বাবা দুঃখে-কষ্টে দিনে দিনে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। একমাত্র সন্তানকে একটিবার দেখে মরতে পারলেও শান্তি। কিন্তু সাজুর স্ত্রী মনে করে তার বারার সাথে আলাপ করিয়ে দিলে সাজু সবকিছু জেনে যাবে এবং বাবার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সে বাবার বদনাম করে, নানা ছলে বাবা ও ছেলের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে।

কণ্যার বয়স এখন পাঁচ মাস।
সাজু ফোন করে কন্যার সাথে কথা বলতে চায়। স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলে, মাইয়া এখনও কথা বলতে পারে না, খালি গাই-গুই করে, ফোন দিয়ে লাভ কী?। সাজুর বলে তাও দেও, তার মুখের সামনে ধরো আমি তার গাই-গুইই শুনব। তার স্ত্রী মেয়ের মুখে ধরে ফোন। মেয়ে ফোন কামড়ে, আউমাউ, গো গো, উঁআ করে। সাজু মেয়ের মুখের এ গাই-গুই শুনেই শান্তি পায়।

সাজু আরেকদিন বিকেলে ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইল। তার স্ত্রী বলল, মাইয়া আমার নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এখন ডিসটার্ব করার দরকার নেই। সাজু অনুরোধ করে বলে, মাকে ঘুম থেকে টেনে তোলে তার সামনে ফোন ধরো, আমি আমার মায়ের কান্নার শব্দই শুনব। স্ত্রী বলে, অসম্ভব। কাঁচা ঘুম। এখন তুললে সে যে কান্না ধরবে আর থামানো যাবে না।

সাজু বলে, তো ফোনটা নিয়ে আমার কলিজার টুকরার নাকের সামনে নিয়ে রাখ তো। স্ত্রী এবার হেসে দিয়ে বলে, আপনার মাইয়া কি নাকে কথা বলে যে ফোন রাখব নাকের সামনে। জ্বালা।
সাজু বলে আরে রাখো না তুমি। মাইয়ার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা তো শুনতে পাব। সেটাই আমার আনন্দ।

সাজু তার আদরের কন্যার শ্বাস-প্রশ্বাস, গাই-গুই, উআ এরকম শব্দগুলো রেকর্ড করে রেখে বারবার শোনে আর আনন্দ পায়। এ তার এক অপার আনন্দের বিষয়।

তিন বছর পর বাড়ি আসছে সাজু। এ কথাটা সাজুর বাবার কানেও গেল। সাজুর বাবা এখন হাঁটতে চলতে পারে না। কোনোমতে বারান্দায় আসতে পারে। সাজুর বাবা দুর্বল শরীর নিয়ে বারবার কষ্ট করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দাঁতহীন মুখে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে সাজুর বাবা।

বিমান বন্দরে সাজুর স্ত্রী, কন্যা, শ্যালিকা গিয়ে অপক্ষা করছে। ওই যে দেখা যায় সাজুকে। সাজু এক দৌড়ে এসে মেয়েকে বুকে আগলে ধরে আদরে চুমুতে অস্থির করে ফেলল। এই আদর করতে করতেই সে গাড়িতে উঠল। গাড়িটা তার বাবার ঘরের সামনে দিয়ে যখন তার নতুন বাড়ি যায় তখন সাজুর বাবা অনেক কষ্ট করে বারান্দায় ছেলের অপক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সাজু যখন তার বাবার বাড়ি পার হয়ে তার নতুন বাড়ি গিয়ে উঠল, তখনও তার বাবা হা-করে অপোয় দাঁড়িয়ে ছিল। না, সাজু তো এলো না। তার বাবার পাওয়ারের চশমাটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। বাবা তার শুকনো মুখে একটা ঢোক গিলে লাঠিতে ভর করে তাওড়াতে তাওড়াতে চলে গেল ঘরে।

সাজুর ঘরে আনন্দ-উৎসবের বন্যা। বন্ধু-বান্ধব, আতœীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ভীড়ে সাজু তার কলিজার টুকরোকে কোলে নিয়ে হইচই করছে। বিদেশ থেকে আনা নানান জিনিসপত্তর বিতরণ করছে তার মেয়ের হাত দিয়ে। মাঝেমধ্যে উঠছে হাততালি। উপাদেয় খাবারের গন্ধে ম-ম করছে পুরো বাড়িটা। আনন্দে রঙ্গীন হয়ে উঠেছে সাজুর বাড়ি।

সন্ধ্যার পর একে একে চলে গেল সবাই। রাগ ১১টায় সাজুর মনে পড়ল বাবার কথা। সে তার মেয়েকে কোলে করে বাবার জন্য এক প্লেট খাবার আর বিদেশ থেকে আনা একটা তোয়ালে আর কয়টা খোরমা নিয়ে বাবার ঘরে গিয়ে উঠল। দেখে, তেল চিটচিটে কাঁথা ও বালিশে শুয়ে আছে কংকালসার বাবা। মুখটা আছে হা করে। পাশে নড়বড়ে একটা বাঁকা লাঠি। চোখে পাওয়ারের মোটা গ্লাসের চশমা। একটি ফ্রেম আছে অন্যটি সুতায় বাধা। বাবার দুচোখ থেকে গড়িয়ে অশ্র“ পড়ার অষ্পষ্ট দাগ। পাশেই একটা পুরনো বাসনে শক্ত রুটি, পাতলা ডালের বাটি আর পাশেই কাত হয়ে পগে আছে একটা বড় মগ।

সাজু এসব এক নজর দেখে কোমল হাতে বাবাকে ডাকল, বাবা, বাবা, আমি এসেছি বাবা। আবারও ডাকল বাবা আমি তোমার সাজু, এই দেখ বাবা, আমি বিদেশ হতে চলে এসেছি উঠো বাবা, উঠো।
বাবার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×