‘যাবি নাকি?’
‘কই?’
‘মিনুদের বাড়ি।’
‘এত রাতে?’
‘ডাব খাবো। দেখিসনি, মিনুদের ঘরের কোণে গাছভর্তি কচি কটি ডাব? কাঁদিসুদ্ধ সাবাড় করে দেবো, চল।’
‘মিনুটা যা ত্যান্দড়রে বাবা! এই ডাকাত মেয়ে টের পেলে আর রক্ষে নেই; চিল্লাচিল্লি করে পাড়া মাথায় তুলবে, তখন?
‘এই যে কালো চাদরটা দেখছিস, এটা গায়ে প্যাঁচিয়ে ভয়ংকর ভূতের রূপ ধরে এমন ভয় দেখাবো, মিনু ঠাস্ করে পড়ে যাবে মাটিতে। তখন তার চিল্লাচিল্লি করার জোর থাকবে না, মুখ দিয়ে খালি লাল-নীল ফেনা বেরোবে; আর এই ফাঁকে তুই ডাব নিয়ে সোজা চলে আসবি ময়নার বাপের ধান ক্ষেতের আলে। চল্।’
গাছতলায় গিয়ে কবির তার গায়ের জামা খুলে আমার হাতে দিল। আমি এগুলো গলায় পেঁচালাম। সে ফিসফিস করে কাঁপাস্বরে বলল, ‘ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, বুকটা কেমন ডিব্ডিব্ করছে, দেখ।’
‘ভীরুদের মতো কথা বলিস না তো! যা, উঠ্।’
কবির কষে নেংটি দিল। সে হাতের তালুতে থুতু ঘষিয়ে গাছে উঠছে। আমি গায়ে কালো চাদর পেঁচিয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
দুই.
ঘটাংঘট শব্দে দরজা খুলে গেলো। ভয়ে আমার বুক ডিব্ ডিব্ করছে আর কানে করছে শো শো শব্দ। মিনু ঘর থেকে বেরিয়ে বিড়ালের মতো হেঁটে গাছ তলায় গিয়ে উপরের দিকে তাকালো। আমি ধুম করে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মিনু একটা চিৎকার করে আমাকে খাবলা মেরে ধরে ফেলল। আমি কোনো মতে ছুটে দিলাম ভোঁ দৌড়। কিন্তু চাদরটা রয়ে গেলো মিনুর হাতে। মিনু গাছের দিকে তাকিয়ে ‘ডাবচোর’ ‘ডাবচোর’ করে চিৎকার করতে লাগল। কবির অর্ধেক গাছ নেমে ডাবসহ লাফিয়ে পড়ল। ফট্টাস করে একটা শব্দ হলো। দুঃসাহসী মিনু পানিতে মাছ ধরার মতো খপ্ করে ধরে ফেলল কবিরকে। আর যায় কই। গাছের তলে চোরে, ডাবে আর মিনুতে মাখামাখি। একচোট কোস্তাকুস্তি হয়ে গেলো। মিনু ছাড়ে না ডাব চোরাকে।
কবির গায়ের গেঞ্জি খুলে উর্দ্ধশ্বাসে দিল দৌড়। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বাংলাঘরে এসে বেদম হাঁপাচ্ছে। তার নেংটি অর্ধেক খোলা, গায়ে খামচির দাগ। আমি বললাম, ‘তোকে চিনতে পারে নি তো আবার?’
সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘চুপ, কোন কথা বলবি না তুই। জীবন নিয়ে টানাটানি। পানি দে, পানি খাব।’
আমি তাকে কী বলে শান্ত্বনা দিব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
তিন.
সকালে আমাদের ডাক পড়ল মিনুদের বাড়ি। গেলাম। উঠোন ভর্তি মানুষ। ডাবচুরির নালিশ বসেছে। আমি আর কবির মাতবরের সামনে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে একটা গূঞ্জন শুরু হলো। লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে গেলো।
ঘর থেকে বিছার মতো লাফিয়ে এলো মিনু। সে এক হাতে কালো চাদর, ছেঁড়াফাঁড়া গেঞ্জি দেখিয়ে বলল, ‘আপনারা দেখেন, ডাব চুরির প্রমাণ দেখেন। এরা আজ করেছে ডাব চুরি কাল করবে ডাকাতি।’
মাতবর বড় ভাল মানুষ। তিনি আমাদের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘বাবারা, ডাব চুরি করতে গেলি কেন, চাইলে কি দিত না?’
‘চাইলেও দেয় না, না চাইলেও দেয় না। এদের মতো কিপটা মানুষ এই গাঁয়ে নাই। চুরি করব না তো কি।’ অভিমানে বলল কবির।
তার কথা শুনে সবাই হো হো হি হি করে হেসে উঠল। মিনু রাগে গজ গজ করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। মাতবর বলল, ‘মা মিনু দুই গ্লাস ডাবের পানি নিয়ে আয় তো দেখি।’
মিনু ডাবের পানি ভর্তি দুটি গ্লাস নিয়ে এসে মাতবরের হাতে দিল। তিনি আমাদের হাতে গ্লাস দিয়ে বললেন, ‘নে খা।’ আমি মনে করছি এটা বোধ হয় চুরির কোনো শাস্তি। আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে খেলাম। মাতবর আফছুছ করে বললেন, ‘আহারে আমরা এ বয়সে কত কি করেছি। এ সব নিয়ে বিচার-নালিশ হয় নাই। পোলাপান মানুষ, এরা এই সামান্য ডাবের পানি খেতে গিয়ে মেলা নাজেহাল হয়েছে। আর চুরিমুরি করিস না বাপ, যাহ।’
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু চলে আসার সময় মিনু ‘ডাবচোর’ বলে গ্লাসের অবশিষ্ট পানি ছুড়ে মারল আমাদের গায়ে।
মিনুর দেওয়া 'নাম' আমাদের গায়ে আজও আঁঠার মতো লেগে আছে!