somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

দৈনিক পূর্বদেশ এ প্রকাশিত ছোটগল্প

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক.
গভীর রাত। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে।
‘মা, মাগো দরজা খোলো।’
জমিলার মা ও বাবা ছোট ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রাতের খাবার খাচ্ছিল। দরজার কাছে ‘মা’ ডাকার হালকা আওয়াজ পেয়েও কেউ গা করল না। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কে আসবে এখানে! মনের ভুল হবে হয়তো। খাবারে মন দিল জমিলার মা ও বাবা।
‘মা, মাগো আমি জমিলা, দরজা খোলো।’
জমিলার মা জমিলার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল; মুখের ভাত নড়ছে না, চোখের পলক পড়ছে না।
‘জমিলা আইব কইত্তে, হেয় না মইরা গেছে কবে!’ খুব সাবধানে বিড়বিড় করে বলল জমিলার মা।
জমিলার বাপ ভাতের বাসন সামনে ঠেলে দিয়ে দাঁড়ালো এবং দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিল। জমিলার মা থাপ মেরে লুঙ্গি টেনে ধরে চাপাস্বরে বলল, ‘সর্বনাস, যাইন কই?’
‘আমার জমিলার মতো ডাক পারছে কেডা, দেহি’, বলেই জমিলার বাপ দরজা খুলে দিল। ধুপ করে ঘরে ঢুকলো জমিলা।
প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির ভেতর দিয়ে এসেছে জমিলা। তার গায়ে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি নেই।
বাবা জমিলাকে দেখে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
জমিলার মা ডান বাও তাকিয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘আয় হায়, তুই আইছত কইত্তে? তুই ত রানা ভবনের তলে পইরা মইরা গেছতগা। তর জানাজা অইয়া গেছে। সরহার টেহা দিয়ে দিছে। দেশের সব মানুষ জানে তুই মরা।’
‘চুপ, চুপ করো জমিলার মা, আমার জমিলা মরে নাই।’
জমিলার মা জমিলার বাপকে একটা হ্যাঁচকা টানে পেছনে সরিয়ে দিয়ে জমিলাকে কান্নার স্বরে বলল, ‘তুই কইত্তে কেমনে আইলিরে মা। তুই যদি হাছাই জমিলা অইয়া থাহস তো তাড়াতাড়ি চলে যা। আমাদের সর্বনাশ করিস নারে মা, যাহ্।’
জমিলা ঘরের চারদিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল।
‘মা, মন্টু কই, আমার কইলজার টুকরা ভাই মন্টু! তারে আমি এক নজর দেখব। কই, মন্টু কই? মন্টু, মন্টু’..বলে ডাকতে ডাকতে জমিলা চকিতে ঘুমিয়ে থাকা আদরের ছোট ভাইটির দিকে এগিয়ে গেল। জমিলার মা তার পথ আগলে দাঁড়ালো এবং হাতজোড় করে বলল, ‘মা, তুই মরছত ত মরছত, আমগরে আর মারিছ না। সরহার টেহা দিছে, আরো দিবে। আমরা এহন চাইরটা ডাইল-ভাত খাইয়া বাইচ্ছা আছি। তুই আমগর এত কষ্টের সুখ নষ্ট করিছ না মা, তুই চইলা যা।’
‘মাগো আমার ভাইডারে একটু আদর কইরা যাই।’
জমিলার বাবা কি যেন বলতে চাইল। জমিলার মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইত্তা কী কছ তুই? এমনিতে পোলারে ব্যারামে ছাড়ে না। আদরের কাম নাই, সে এহন মেলা আদরে আছে। ঘুম ভাংলে না হোমানে না কান্দাকাটি করব। আর মায়া কইরা লাভ নাই মা। তুই চইলা যা, মাইনসে দেকলে আর উফায় নাই!’

দুই.
জমিলা একটু জোর করেই দাঁড়ালো। সে চকির উপরে তার আদরের ছোট ভাই মন্টুকে দেখল। মন্টু নতুন বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শান্তিতে ঘুমুচ্ছে।
আদরের ছোট ভাই মন্টুকে দেখেই তার মনে শত সহস্র স্মৃতি বিদ্যুতের মতো খেলা করে গেল। চার বছরের ভাইটি তার খেলা ও ঝগড়ার সাথী ছিল। সকালে কারখানায় যাওয়ার সময় সে জমিলার আদর নিতে নিতে আর কাপড় টানতে টানতে বায়না ধরতো চকলেট, বেলুন, আইসক্রিম, খেলনার। জমিলা তার সামান্য আয় থেকে কখনো বা নিজে কষ্ট করে ভাইটির বায়না মেটাতো। সন্ধ্যায় জমিলা ফিরে আসতো বাড়ি। তার আগেই ছোটভাই মন্টু দাঁড়িয়ে থাকতো বোন জমিলার জন্য। দূরে বোনের আবছা ছায়া দেখেই সে ছাগলছানার মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে ছুটে গিয়ে বোনের কোমড় প্যাঁচিয়ে ধরতো। মন্টু বোনের কাছে তার মা-বাবা ও পাড়ার সব দুষ্টু ছেলের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ-অভিমান করে চোখ মুছতো। তারপর সে কিলিয়ে, টেনে-টেনে ঠেলে ঠেলে মহাগেৌরবে বাড়ি নিয়ে আসতো তার প্রিয় আপুটিকে।
শেষ দিন মন্টু খুব করে বায়না ধরেছিল একটা দামি আইসক্রিম আনার জন্য। জমিলা যেভাবেই হোক ভাইটির দাবি মেটাবেই। আইসক্রীমটা হাতে পেয়ে ভাইটি আনন্দে কেমন দিশেহারা হবে এমন কল্পনা জাল বুনতো সে কাজের মাঝেও। এমনই বহু আশা, কল্পনা, স্মৃতি আর সুখস্বপ্নসহ মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গেলো অসংখ্য জমিলা।

তিন.
আজ জমিলা তার ছোট ভাইটির জন্য একটি আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল। এতক্ষনে আইসক্রিমটা গলে গিয়ে তার কনুই বেয়ে মাটিতে পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। জমিলার হাতের আইসক্রিমের মতো তার দুচোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে মাটিতে পড়ছে।
জমিলা আইসক্রিমের কাঠেি মতো ফেলনা হয়ে গেল!
অতঃপর জমিলা তার ঘুমন্ত ভাইটির দিকে একবার ও মা-বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৯
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×