somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

|| 'জয় বাংলা' 'শ্লোগান' - এর ইতিহাস ||

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৬২ সাল থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছিল ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা দাবী উত্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত তার সামনে কোন সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না।হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী কে গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রথম এই আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ।তারপর ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ও তৎকালীন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবীতে আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে ।এই আন্দলনে প্রধান ভুমিকা ছিল ছাত্র সমাজের ।এই সময় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও আইয়ুব প্রদত্ত শাসনতন্ত্র বিরোধী শ্লোগান ছাড়া আর যে
কয়টি শ্লোগান প্রধান ভাবে উঠে সে গুলি হল-

"পূর্ন গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র-দিতে হবে"
"মৌলিক অধিকার-দিতে হবে"
"রাজবন্দীদের-মুক্তি চাই"

"আইয়ুবশাহীকে-খতম কর"


১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের হত্যাকান্ডের পর সরকার শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট কে সাময়িক ভাবে স্থগিত করে এবং তারপর থেকে আন্দোলনে ভাটা আসে । এই ভাটার মুহূর্তেও ছাত্ররা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবীতে আন্দলনের ধারা অব্যাহত রাখে ।১৯৬৪ সালে নির্বচনের প্রাক্কালে আবার আন্দোলনের সে ধারায় নতুন প্রান সঞ্চারিত হয় ।এবার ছাত্ররা শিক্ষা সংক্রান্ত একটি ২২-দফা দাবী উত্থাপন করে এবং তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন চালায় । জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তখনো গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের
দাবীরই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে । ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের সময়
আওয়ামী লীগ , জাতীয় আওয়ামী পার্টি , জামাতে ইসলামী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি বিরোধী দলই একত্রিত হয়ে গঠন করে "সম্মিলিত বিরোধী দল" ।
এই "সম্মিলিত বিরোধী দল" এর ও উল্লেখযোগ্য কোন কর্মসূচি ছিল না ।
তারা তখন যে কর্মসূচি , তার সকল বিষয়ে প্রতিও অন্তর্ভুক্ত সকল দলের
আন্তরিক সমর্থন ছিল না ।কেমল মাত্র আইয়ুব সরকারের পতন ঘটানো ও গণতান্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগানেই তখন ঐ-সব রাজনৈতিক দল একমত ছিল । গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞা নির্ধারিত না থাকার ফলে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণাও ছিল বিভিন্ন রুপ । আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের পূর্বে প্রথম আওয়ামী লীগ ও
ছাত্রলীগের বিশেষ আগ্রহ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে শ্লোগান দানের ,আর জাতীয় আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ প্রবনতা ছিল শ্রমজীবী জনসাধারনের বিভিন্নদাবী-দাওয়ার পক্ষে শ্লোগান উত্থাপনে ১৯৬৬ সালে ৬-দফা উত্থাপিত হলে আন্দোলনের সামনে একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য পরিলক্ষিত হয় ।
এতদিন পর্যন্ত আন্দোলনের লক্ষ ছিল নেগেটিভ । এবার তার সামনে এলো একটি পজেটিভ লক্ষ্য ।
সূচিত হল আন্দোললনের আর এক নবপর্ব ।
এই পর্বে আন্দোলনের প্রধান শ্লোগান-

"জাগো জাগো -বাঙালী জাগো" ।

ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালী জাতিকে মুহুর্তের মধ্যে জাগিয়ে তুলে
এক আশ্চর্য টনিকের মত কাজ করে । "জাগো জাগো -বাঙালী জাগো " শ্লোগানের পাশাপাশি অন্য পক্ষ
থেকে -
"জাগো জাগো -সর্বাহারা জাগো "
"জাগো জাগো -মুসলিম জাগো"


প্রভৃতি শ্লোগান উত্থাপিত হয় । ৬-দফা উল্লেখিত পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় "জনগণতন্ত্রের" শ্লোগান
এইসব শ্লোগান সাময়িক ভাবে কিছু সাড়া জাগায়
১৯৬৮-৬৯ এর "গণ-অভ্যুত্থানের সময়
"জেগেছে জেগেছে -বাঙালী জেগেছে " ও
"বীর বাঙালী জেগেছে -রক্ত সূর্য উঠেছে "


প্রভৃতি শ্লোগানই প্রধান ভাবে উঠে । আর এর পাশাপাশি অন্য পক্ষ থেকে উঠে -
"মুক্তির একই পথ-সশস্ত্র বিপ্লব"
"মুক্তি যদি পেতে চাও-হাতিয়ার তুলে নাও"
"শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর-জনগণতন্ত্র কায়েম কর"
প্রভৃতি শ্লোগান ।
"স্বাধীন -জনগণতন্ত্রিক পূর্ব বাংলা" প্রতিষ্ঠার পক্ষেও এই সময় কিছু কিছু
শ্লোগান উঠে এবং প্রচারপত্রে বিলি হয় ।অভ্যুত্থানের পর ছত্ররা ও তরুন সংগ্রামীরা অনেক নতুন শ্লোগান উদ্ভাবন করেন ।
এইসব শ্লোগানের অধিকাংশই বাঙালী জাতিয়তাবাদের বিকাশের লক্ষকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবিত হয় । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় আইয়ুব সরকার জাতীয় পরিষদে এই মর্মে আইন পাস করে যে , পূর্ব পাকিস্তানকে 'পূর্ব বাংলা' নামে অভিহিত করলে কঠোর দন্ড প্রদান করা হবে । এই আইনের ফল হয় সরকারের অভিপ্রায়ের বিপরীত ।ছাত্ররা তখন ব্যাপক ভাবে পূর্ব পাকিস্তান কে 'পূর্ব বাংলা' নামে অভিহিত করে চলে ।
১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াইয়া যে বেতার ভাষন দেয়
তাতে সে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিলের কথা ঘোষণা করে ,
এবং ঘোষণা কে কার্যকরি করার তারিখ ও প্রদান করে ।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সে নিরব থাকে । এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়
পূর্ব পাকিস্তানকে 'বাংলাদেশ' নামে অভিহিত করার দাবী উঠে ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে "বাংলাদেশ"
নামে অভিহিত করে চলেন এবং বলেন যে "ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র প্রনীত হলে তাতে এই অঞ্চল বাংলাদেশ নামেই অভিহিত হবে । মাওলানা ভাষানী ও আতাউর রহমান খানও তখন বিবৃতি প্রদান করে বাংলাদেশ নামকরণের প্রতি সমর্থন জানান ১৯৬৯ সালে ভাসানী অনুসারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের "একাংশ" 'স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা" রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগান প্রকাশ্য ভাবে উত্থাপন করে এবং এই শ্লোগান সাময়িক ভাবে বেশ সাড়া জাগায় ।

'শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধর-পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর'
'মাগো তোমায় মুক্ত করব-শপথ নিলাম শপথ নিলাম' ও
'মুক্তির একই পথ-সশস্ত্র বিপ্লব'
প্রভৃতি ছিল তখন তাদের শ্লোগান ।
১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় এই ছাত্ররা 'স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ১১-দফা কর্মসূচি' ঘোষনা করে ও তা পরে প্রচারপত্র আকারে প্রকাশ্যে বিতরন করে । আন্দোলনের এই পর্বের গোড়াতেই ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি 'জয় বাংলা' শ্লোগান উত্থিত হয় জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দল ছাড়া অন্যান্য দল তখন থেকেই পারতপক্ষে" পাকিস্তান জিন্দাবাদ" শ্লোগান উঠায়নি । ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনের সময় "জয় বাংলা" শ্লোগানের শক্তি ও তাৎপর্য উপলব্ধি হয় এবং সুচিন্তিতভাবে তখন থেকেই এই শ্লোগান উঠানো হয়।
এই শ্লোগানের পাশাপাশি ছাত্রলীগের মধ্য থেকেই তখন
"তোমার আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ" ও
"পদ্মা- মেঘনা- যমুনা তোমার আমার ঠিকানা "

প্রভৃতি আরো অনেক জাতীয়তবাদী শ্লোগান উঠতে থাকে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন "জয় বাংলা" শ্লোগান সমর্থন করেন এবং বক্তৃতার সময় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই শ্লোগান দিতে আরম্ভ করেন । ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় সারা বাংলাদেশে এই শ্লোগান বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে ।
এই পর্বে Pakistan Observer পত্রিকায় এই শ্লোগানের বিরুদ্ধে অনেক চিঠিপত্র ও মন্তব্য প্রকাশিত হয় ।
জামাতে ইসলামী ও পিডিপি প্রভৃতি দল নির্বাচন অভিযানে প্রচার চালাতে থাকে যে ,"এই শ্লোগান 'জয় হিন্দ' শ্লোগানের দ্বারা প্ররোচিত এবং যারা এই শ্লোগান উত্থাপন করছেন তার ভারতের দালাল" ।
জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বোঝাতে চেষ্টা করে যে ,
"এই শ্লোগানের প্রতি সমর্থন দান করলে অচিরেই হিন্দুর গোলামে পরিনত হতে হবে"কিন্তু তাদের অপপ্রচারের ফল হিতে বিপরীত হয় ।
জনগণ "জয় বাংলা" শ্লোগান কে আরো গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহন করে ।
নয় মাস যুদ্ধ চলাকালে "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র " থেকে ভেসে আসে
"জয় বাংলা" শ্লোগান ও সঙ্গীত সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণের বিজয়ের আশা সঞ্জীবিত রেখেছিল । যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তি যোদ্ধারাও এই শ্লোগান থেকে সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করেছেন ।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে
এই শ্লোগান বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।

[ ঈষৎ সম্পাদিত]
তথ্য সূত্রঃ
"স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব"
-খন্দকার কামরুল হুদা
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×