somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি সাদামাটা কিন্তু বাঙালিয়ানাভরা বৈশাখের খোঁজে

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখার অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থ দুরে থাক, লেখার কথা না বুঝেই বিষ্ফোরক বাঁকা মন্তব্য করে মেজাজ খিচড়ে দেবার মানুষের সংখ্যা সমাজে বাড়ছে। এই লাফাঙ্গাদের উৎপাতে সাধারন কথাও বলতে আজকাল ভয় পাই। কোনোকালেই কোনো লেখা কতজন পড়ল বা হিট করল তা নিয়ে না ভাবলেও, কিছু ত্যানা প্যাচানো মানুষ বুঝুক না বুঝুক, ত্যানা পেঁচিয়ে যখন মূল লেখা বাদ দিয়ে আলাপকে চকির তলায় নিয়ে যায়, তখন লেখার আগ্রহ কমে যেতে বাধ্য। বৈশাখ নিয়ে একজন সহযাত্রীর বাঁকা মন্তব্যের জেরে মাথা গরম করে কয়েকটা লাইন লিখেছিলাম। আমার একজন সৃহৃদ সেটাকে পূর্নাঙ্গ একটি লেখায় রুপ দেবার উৎসাহ দিলেন। আজ ১৩ তারিখ রাতে তাই বৈশাখের কনজুমার উপাচার সংগ্রহ বাদ দিয়ে লিখতে বসলাম। জানি, খুব কম মানুষই সময় পাবেন এটি পড়তে। মাঠে মারা যাবে এতটা উৎসাহ। তবু, কেউ কেউ নিশ্চই পড়বে-সেই আশায়। খুব দ্রূত লিখলাম বলে বানান ভুল থাকবেই জানি। ক্ষমাপ্রার্থী সেজন্য।

এক;
পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তী, নবান্ন’র মতো বাঙলা উৎসবগুলো আসলেই কিছু মানুষের ন্যায়বোধ, ইতিহাসবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ঠিক যেমন কিছু মানুষের কোরবানী এলেই পশুপ্রেম ও সাম্যবাদ চাগিয়ে ওঠে। যাহোক, দুটোই কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত এ্যালার্জি। জানি না কেন, এই দেশে অধুনা একরকম অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাঙালীর যেকোনো উৎসব, অনুসঙ্গ, চর্চা, বোধ, অভ্যাসকে ধর্মের বিপরীতে দাড় করিয়ে দেবার একটা প্রবনতা চালু হয়েছে কিছু বছর ধরে। রাষ্ট্র, ধর্ম, ব্যক্তি ও সমাজব্যবস্থার চির সতন্ত্র স্বত্ত্বাকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে এই আবাঙালগুলো। এই আবাঙালগুলো এটাও ভুলিয়ে দিতে চায়, এই বঙ্গ বা বাংলা নামক দেশটার অতীত জড়িয়ে আছে বাঙাল, বাংলাভাষি মানুষের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনাচরন, মন মানসের সাথে। এই দেশ ‍মুঘলদের নয়, বৃটিশদের নয়, বোগদাদ বা পারস্য হতে আসা কোনো বীরপুঙ্গবের নয়। বাঙালীর এই দেশ বাংলা, বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাঙালা কিংবা বাংলাদেশ। হাজার, লক্ষ বছর আগে হতেই এই দেশ বাঙাল ও বাংলার মানুষের দেশ। সবযুগেই তাই ছিল। মাঝে মাঝে কিছু বহিরাগত এসে এটা বলার চেষ্টা করেছে-”এটা তো তোমার নয়, আমি যা দিচ্ছি সেটাই তোমার।” দুঃখিত, ওই ঐশি বাক্য বাঙালী কোনোকালেই খায়নি। তাই এখানে কী হবে, না হবে; এখানে কী করার কথা, আর কথা না; এখানকার জীবনাচরন কেমন হবে, কেমন হবে না; এখানে কোনটা উৎসব আর কোনটা চাপিয়ে দেয়া ফেসটিভ্যাল/কার্নিভাল-সেটা বাঙাল বা বাঙালীরাই ঠিক করবে, করেও এসেছে। পহেলা বৈশাখ নিয়ে, পৌষ পার্বণ, নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তির মতো বাঙালী উৎসব নিয়ে যারা বাঁকা চোখে তাকান, অপচয়ের ধুয়া তোলেন, তারা তফাৎ থাকুন। বৈশাখ একটি অপচয় আর গরীবের প্রতি তামাশা মনে করা মানুষেরা দেশের গরীব মানুষের চিন্তা যদি সত্যিই করতেন, তবে ২১ শে ফেব্রূয়ারীতে গরুর গোসতের দোকানে নির্লজ্জের মতো দাড়াতেন না। দেশের ইতিহাস/ঐতিহ্যের সত্যি নিয়ে যদি ভাবতেন, তবে আপনিই অফিসের নিউ ইয়ার পার্টিতে হলুদ তরল গেলাসে গেলাসে গিলতেন না। ভন্ডরা, দুরে থাকুন।

দুই;
১লা বৈশাখ নিয়ে বরাবরের মতোই কিছুই পরিকল্পনা করিনি। ইলিশও কিনিনি। শুধু এবার নয়, কোনো বৈশাখেই ইলিশ কিনি নি। কোনো শবে বরাতেই গরুর মোলাম গোসত কিনতে অফিস ফাঁকি দিয়ে মাংসের দোকানে দাড়াইনি, কখনো দাড়াবও না। ২১ শে ফ্রেব্রূয়ারীতে সাদাকালো পাঞ্জাবী কিনতে মার্কেটে ঘুরিনি। উৎসব আমার কাছে আনন্দের, উচ্ছাসের, সারল্যের, উদ্যামের, মানুষের কাছে যাবার, পাবার অনুসঙ্গ। উৎসব আমার কাছে চতুর কনজুমার স্বার্থের তালে সুর মেলানো নয়। আমার ছোটোবেলায় মা আমাদের বৈশাখের পহেলা দিন মানে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে ভাল রান্না করে খাওয়াতো পোলাও, মাঙস, পায়েশ যাতে সারাবছর ভাল খেতে পাই। বাসায় ওইদিন কোনো ঝগড়া যাতে না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতাম তা নাহলে ভাবা হত সারাবছর ঝগড়ায় যাবে। মোটকথা পহেলা বৈশাখে অন্যদিনের চেয়েও সাধ্যমতো ভাল করার চেষ্টা হত। আর এখন শুনি পহেলা বৈশাখে উল্টা পান্তা, ভর্তা খাওয়াটা নাকি হাজার বছরের ঐতিহ্য। অথচ হাজার বছর ধরে বাঙালীর গরীব জনগোষ্ঠি বিশেষত কৃষকরা সকালে রাতের পানি দেয়া ভাত দুটো পোড়া মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে মাঠে যেতেন। অর্থাভাবে কিংবা বাড়তি ভাতটুকু ফেলে অপচয় না করে তাকে সকালে কাজে লাগানোর সেই চিরায়ত বাঙালীর ঐতিহ্য এখন ভুল অনুবাদ হচ্ছে। পান্তা খাওয়াটা আমাদের ঐতিহ্য। তবে সেটা দামী হোটেলে, রেস্তোরায়, পার্কে, ক্লাবে ততোধিক দামী জামাকাপড়ে নিজেকে সজ্জিত করে সেলফী সহযোগে পরিবেশিত হতে থাকলে সেটাকে বানিজ্যিক আর ইয়ো ইয়ো জেনারেশনের মস্তির বাড়তি ধান্দা বলেই মনে হয়। সত্যির চেয়ে যখন মেকির গুরুত্ব বাড়ে, তখন সেটা ভন্ডামী ছাড়া কিছু নয়।

তিন;
মনে পড়ে, ২০১৬ সালের আজকের রাত ১৩ এপ্রিল-রাত ১০:৪৫ টা। আমি মিরপুর এক নম্বর বাজারের পাশে। উদ্বেগ নিয়ে একজন বৃদ্ধ অগ্রজ'র বাসায় না ফেরার অপেক্ষায়। এত রাতে দেখি বাজারে লক্ষাধিক লোক হামলে পড়েছে। তাদের কেনাকাটার ধুমে মনে হল কালকে হয় ঈদ, নয়তো এদের সবার মেয়ের বিয়ে কাল সকালে। কলা, মুলা, তরমুজ, ইলিশ, পিয়াজ, শুকনা ’গড়ুর’ গোস, মুরগা, লেবু, আদা, মুড়ি লোকজন লালসাপূর্ণ লম্পটের মতো খুবলে খুবলে কিনছে। রাত ১১:২০ টা। বিদ্ধস্ত ধর্ষিত চেহারার কিছু রমণী ও পুরুষকে দেখলাম, আবছা কমলা নিয়ন আলোয় কমলা রঙা আড়ঙের গাদাগাদা ব্যাগ হাতে ধুকে ধুকে বাসায় ফিরছে ততোধিক ধর্ষিত আনন্দ চোখে নিয়ে। আহ বৈশাখ। আজ যখন এই লেখাটা লিখছি তার কিছুক্ষন আগে অসুস্থ সহধর্মীনির পথ্য যোগাড়ের জন্য প্রিন্স বেকারীশপে গেলাম একটা পাউরুটি কিনতে। মনে হল, সারা মিরপুরের মানুষ হামলে পড়েছে সেখানে। মিষ্টি কিনতে, কেক, পেস্ট্রি, আরো কত কী? সেলসম্যান আমার পাউরুটির সওদা কিছুতেই পাত্তা দিলেন না। বুঝলাম, অবস্থা বদলেনি। বরং বেড়েছে।

চার;
তবে আবার ভাববেন না, আমি মধ্যযুগীয়, বর্বর, গেয়ো, গোড়া। আমি বাঙালী, আমি বাঙাল। আমি কাল ১৪ এপ্রিল/১লা বৈশাখ তারিখ খুব বেড়াব, প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চষে বেড়াব, বউকে তার পুরোনো শাড়িতে সাজিয়ে তার হাত ধরে হাঁটব, নিজের ক্যাম্পাস দেখাব, হলের রুম দেখাব, টিএসসিতে ফুচকা খাব। সকালে আগের রাতের বাসি লেফট ওভার খাবার খাব। আমি ‍উৎসবের উপাচারকে নয়, উৎসবের ছন্দ, আনন্দ, গান, উৎসবমুখর জনতার ভীড়কে বেশি অনুভব করতে চাই। আমি আমার দেশকে, দেশের সবকিছুকে, দেশের প্রতিটি ঘটনাকে, উৎসবকে তীব্র আবেগ নিয়ে অনুভব করতে চাই।

পাঁচ;
এবারের ও চিরকালের বৈশাখে ইলিশ খাবার মতো আত্মঘাতি ও গরীবদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক সংস্কৃতি বর্জন করি আসুন। একদিকে বাঙালের চিহ্ন হিসেবে পান্তা খেলেন আবার আরেক দিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দুর্লভ ইলিশ-দ্বিচারিতা নয়। আর দয়া করে পরের কাছ থেকে ধার করা চমকদার ভিডিও ক্লিপ, কার্টুন, GIF, পোস্টার, চটকদার টেক্সট দিয়ে হাজার হাজার লোককে মেসেজ পাঠানো বাদ দিয়ে নিজে দুটি লাইল লিখুন, হোক সেটি খুব সাদামাটা। দামী পাঞ্জাবী, শাড়ি নয়, যদি ঐতিহ্য, বাঙালিত্ব, বাংলার প্রেম, লোকজ সংস্কৃতিই আপনার লক্ষ্য হয়, তবে এই আরোপিত বাঙালিয়ানা ছেড়ে পরিবারকে নিয়ে যান গ্রামে। মাঠের মধ্যে বা বটতলায় বৈশাখি মেলায়, চড়কায় চড়ান, মুড়ি, মুরকি কিনুন, ডুবো তেলে ভাজা তিলে গজা, নিমকি, ডালের আমির্তি, গুড়ের জিলিপি কিনুন, নাগর দোলায় দুলুন, নদীর কূলে বসে সূর্যাস্ত দেখুন, রমনায় ভোরে চলে যান। নতুন বছরের নতুন আলোয় অশুভকে বিদায় আর শুভকে আমন্ত্রনের ছায়ানটের ছায়াময় তলে বসুন মাটিতে। আমাদের যতটুকু আছে সেটি নিয়ে বাঙালিত্ব উদযাপন করি। সিমবোলিক হলেও তবু বাঙালী পরিচয় ঝালাই করি হোক সেটা ১লা বৈশাখেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫৯
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×