somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শোধ

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[গল্প লিখতে পারি না। কোনো একটা অদ্ভূত সময়ে একটা প্লট মাথায় চলে এসেছিল। চেষ্টা করে দেখলাম। অসঙ্গতি থাকার সমূহ সম্ভবনা]
................”স্যার, আমার বাপ নাই। আমি বেজন্মা!”
...
আমার হাতের কলমটা হাত হতে ধপ করে পড়ে গেল।
“আমি বেজন্মা”-এমন তীব্র ভাষায় নিজের জন্মের অসঙ্গত ইতিহাস কাউকে কখনো বুক চিতিয়ে বলতে শুনিনি। আমি ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। বছর উনিশ-কুড়ি হবে। সারামুখে বসন্তের দাগ। তুবড়ানো চোয়াল। ঘনকালো চোখের দিকে তাকালে একটা গভীর বিষাদের ছায়া দেখা যায়।

সেটা ছিল ’৯০ সাল। প্রত্যন্ত একটা গ্রামে এসেছি একটা খুনের কেসের তদন্তে। আমার মুখে প্রচন্ড বিরক্তি। আজকে একটা জরুরী দরকার ছিল। সব ঠিকঠাক ছিল।
স্রেফ আরজ আলী দস্তগীর নামক একজন ‍স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা খুন হওয়ায় বড় সাহেবের আদেশে নিজেকে আসতে হল। নির্ঘাত পূর্বশত্রূতা কিংবা স্থানীয় রাজনীতি। আরজ আলীর মেয়ে মানুষ প্রীতির খবর আসামাত্রই এসআই আমাকে দিয়েছে।
হতে পারে কোনো মেয়েকে কাজে লাগানো হয়েছে ফাঁদ পাততে। একবার উঁকি মারি ঘরটাতে। পুলিশের চাকরীর সুবাদে জীবনে বহু মার্ডার করা লাশ দেখেছি। আজকের কেসটা একটু অদ্ভূত। চেয়ারম্যান আরজ আলীর লাশ পড়ে ছিল তার বৈঠক ঘরে। বিছানা আর মেঝেতে ভাগাভাগি করে।

লাশের অবস্থানের চেয়েও অদ্ভূত তার মৃত্যুর ধরন। বিকৃত। সাধারনত ঘাতক লাশ নিয়ে সময় নষ্ট করে না।
কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে ঘাতক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল সে কী করবে।

লাশের জিহবা বেরিয়ে গেছে। পরিস্কার বোঝা যায়, গলা টিপে বা অন্যকোনোভাবে শ্বাসরোধে হত্যা। কিন্তু লাশের জিহবার অর্ধেক খন্ডিত। রাতের বেলাতেই গুপ্তঘাতক হামলা করে।

ফাঁদ পাতলেও একা একটা মেয়ে মানুষের পক্ষে একটা মানুষকে খুন করা কঠিন। তাও শ্বাসরোধ করে। নাহ, আমার পুলিশি জ্ঞান তা বলে না। তবে কি একাধিক মানুষ?...........চোখদুটো মনে হচ্ছে সূচালো কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে গেলে দেয়া হয়েছে।
”নৃশংস”................আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আমার কথায় ছামেদুল আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। কখন যেন পাশে এসে দাড়িয়েছে। আমি ছামেদুলের দৃষ্টি পড়তে পারি না।

আমি নিজেকে একটু ধাতস্থ হতে সময় দিই। ছামেদুলকে দেখি মন দিয়ে।
ছামেদুল চেয়ারম্যান আরজ আলী দস্তগীরের বাড়ির লোক। পরগাছা কিসিমের, আধপাগলা মনে হল। গাঁয়ের সব চেয়ারম্যানদেরই কিছু নিজস্ব পালিত পরগাছা ক্যারেকটার থাকে। জোঁকের মতো লেগে থাকে এরা ক্ষমতাবানদের সাথে। নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। ছামেদুলকে কাছে ঘেষতে বারন করেছিল চেয়ারম্যানের লোকজন। কোন ফাঁকে দিয়ে সে ঠিকই ঢুকে পড়ে ভীড় ঠেলে।
আমি লাশ আর খুনের তত্ত্ব তালাশে লোকাল ফাঁড়ির এসআই আর কন্সটেবলদের লাগিয়ে দিয়ে বাইরে এসে চম্বল গাছের নিচে পাতা চেয়ারে বসে ছামেদুলকে নিয়ে পড়ি।

।।-----
”তোর বাপ নেই?
তুই বলতে চাস, তুই হারামজাদা?”

আমার রসিকতায় পাবলিক মরা বাড়িতেও হেসে ওঠে। মুরব্বী গোছের একজন মৃদু ধমক লাগায়।

“জ্বে স্যার। তয় অহন এতিমও কইবার পারেন। চেয়ারম্যান দাদায় তো আমারে হারামজাদা কইয়াই বোলাইত।
উটতে বইতে ডাক পাড়ত, “কই রে, ছামদুল হারামজাদা কই।”

গল্পের ফাঁকে ছামেদুল একটা খেজুর কাঁটা দিয়ে নির্বিকারভাবে দাঁত খোচায় যেন তার মনিব দস্তগীর চেয়ারম্যানের মৃত্যুতে বা খুনে তার কোনো কিছু আসে যায় না। চোখা একটা কাঁটা দিয়ে কীভাবে সে মাড়ি বাঁচিয়ে দাঁত খোচাচ্ছে, আর এত জিনিস থাকতে কেনই বা সে খেজুর কাঁটাই বেছে নেবে সেটা এক রহস্য।
আমি খুনের তদন্তে মন দিতে চাই। ছামেদুল আমাকে নিয়ে পড়ে।

”মাইনষে কইত,” ছামেদুল শুরু করে,
”তোর জন্ম যুদ্ধের পরে। তোর বাপে হেই যে বঙ্গবন্ধুর ভাষুনের পর যুদ্ধে গিয়া সারছে, আর খবর আছিল না। তারপর তোর জন্ম অয় যুদ্ধের শেষে। তোর তাইলে বাপ কিডা?” স্যার, আপনেই কন। আমার মায় বেডি মরল আমার ১৪ বচ্ছর বয়সে। তারে জিগাইতাম, আমার বাপের নাম কী” মায় খালি কানত, আর কইত, তোর বাপ ক্যাডায়, হেইডা তোরে কইলে তুই আরেকবার বাপ হারা হইবি রে।” তয় হ্যায় মরনের আগে ঠিকই কইয়া গেছিল কার কুত্তা নজর জন্ম দিছিল আমারে।
আর মায়’র কতাও শ্যাষতক সত্যি অইল.................।”

আমার একটা জোর ধাক্কা লাগে। পূর্নদৃষ্টি দিয়ে ছামেদুলকে দেখি। ছামেদুল অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে ওঠে। আমি সেই হাসিরও রহস্য ধরতে পারি না। তবে কি ছামেদুল?....................

আমার চিন্তায় ছেদ পড়ে প্রাপ্য খাতিরের যোগাড়ে। চেয়ারম্যান খুন হলেও তার লোকেরা বাড়ির ডাব পেড়ে দারোগার তেষ্টা মেটাতে কসুর করে না। ভেতর বাড়ি হতে দেশী মুরগীর ডিম পোচ আর সেমাইও আসে। আমি সব রেখে উঠে পড়ি।
লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহরে সদর হাসপাতালে পাঠানোর অর্ডার করে উঠলাম। দু’জন কন্সটেবলকে পাহারায় রেখে চেয়ারম্যানের খাস চাকর লোকমানকে জেরা করার জন্য সাথে নিয়ে নিলাম। ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। আজ কমিশনার সাহেবের সাথে ডিনারে মিট করার কথা। প্রেমাও যাবে।
ওকে একটু ভাল করে সেজে যেতে বলেছি। প্রোমোশনটা বাগাতেই হবে এবার..................।

।।-------
গাড়িতে উঠব, ছামেদুল দৌড়ে আসে আরেকবার।
”স্যার, শহরে এতিমখানায় নাকি মাগনা খাওন পাওয়া যায়?” বলেই সে অদ্ভূত করে হাসে।
আমি আধপাগলা ছামেদুলের কথায় আর গুরুত্ব দিই না। গাড়ি ছেড়েছে ততক্ষনে। চলন্ত গাড়ির লুকিং গ্লাসে ছামেদুলের অপ্রকৃতস্থ হাসির মুখটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে। গাড়ি যখন প্রায় গাঁ ছাড়িয়েছে, লোকমানের কথায় আমার সম্বিত ফেরে।
অবচেতনে লোকমানের কথা শুনি আর কেসটার রহস্য নিয়ে ভাবি।

”স্যার, পাগলা ছামেদুইল্লার কতায় আপনে কিছু মনে নিয়েন না স্যার। অর কতার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। যারে তারে কইয়া বেড়ায় হ্যায় বেজন্মা আর ক্যাডায় হ্যারে জন্ম দিছে হেইডা হের মায়ে হ্যারে কইয়া গেছে। অর বাপে মুক্তিযুদ্দে গেছিল গন্ডগোল লাগার পরেই। আর ফেরে নায়। অর জন্ম স্বাধীনের পরে।
মাইনষে নানান কতা কইত। আড়ালে আবডালে আমগো চেয়ারম্যান সাবরে প্যাচাইয়াও কতা কইত। চেয়াম্যান সাবে আবার পিচ কমিটির মেম্বার আছিল।”

আমার ২২ বছরের পুলিশের চাকরীর সেন্স ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। লোকমান যন্ত্রের মতো বলে চলে,..............
“অর বাপে যুদ্ধে যাওনের পরে............ অর মায়রে চেয়ারম্যান সাবে বাড়িত লইয়া রাহে। গায়ে গতরে ভালই আছিল............ অর মায়। .................................”
আমার কানে তখন কিছু আর ঢুকছে না। আমি তীব্রস্বরে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরানোর অর্ডার করি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৮
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×