somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই শহরে

০৯ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাইয়া, আপু, আমার কিছু কথা শুনবেন?
আমি খুব কৃপণ। আপনি চাইলে আমাকে কঁজুসও বলতে পারেন। আমার বন্ধুরা আমাকে হাড় কেপ্পন বলে। শশুর বাড়ির শালা শালীরা আড়ালে আবডালে টিপ্পনী কাটে, “দুলাভাইয়ের হাতের তালু দিয়ে পানি গলে না।”
এলাকার পোলাপান ফুটবল ম্যাচের জন্য চাঁদা চাইতে এলে আমি দিই না। বলি, “কাল নিও”, আর তারপর সেই কাল আর আসেনা।
অফিস যাবার জুতা পুরোনো হলে সেটা আমি প্রথমে ঘরে পড়ার জুতা বানাই, তারপর সেটা আরও পুরোনো হলে বাজারে, দোকানে, মসজিদে জুমা পড়ার জুতা বানাই। তারও পরে, টয়লেটে যে জুতা থাকে, সেইটা ফেলে দিয়ে এটাকে কাজে লাগাই।
ওষূধের দোকানে গেলে আমি তাদের কাছ থেকে ফ্রি সিভিট চেয়ে নিয়ে এসে জমাই। অনেকগুলো জমলে আমার অন্য গলির দোকানে বিক্রি করে দিই।
ঘরে পড়ার নীট কাপড়ের শর্ট প্যান্ট পুরোনো হলে একটু ছেঁটে নিয়ে তা দিয়েই ইনার গার্মেন্টের কাজ চালাই।
বউয়ের ওড়না পুরোনো হলে সেটা গামছার কাজে লাগিয়ে দিই।
আমার বাচ্চার কাশির ওষূধ বেঁচে গেলে সেটা আমি খেয়ে নিই।
বাসায় চা না খেয়ে একবারে অফিসে গিয়েই খাই। অফিসে যে টি ব্যাগ চা দেয় সেটা ব্যবহার করে আমি শুকিয়ে রাখি। তারপর জমিয়ে বাসায় এনে আরেকবার ব্যবহার করি। তারও পরে সেই ব্যাগ আমি ফুলগাছের গোড়ায় দিই। আলাদা সার কেনা লাগে না।
সবার নীলগিরী, পাতায়া বেড়াবার ছবি দেখে মন কেমন কেমন করলে আমি আমার বউকে নিয়ে রমনা পার্কে কিংবা বাঁধের পাড়ে চলে যাই।
দোকান হতে কোনো খাবার কিনতে হলে সাথে বেশি করে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, বিটলবন আর সস চেয়ে নিয়ে আসি। তাতে ওগুলো কম কিনে পারি।
টুথপেষ্ট শেষ হয়ে গেলে তার পেছন হতে কেটে ব্রাশ ঘষে কয়েকবার চালাই।
শ্যাম্পুর বোতল খালি হলেও তাতে পানি ভরে কয়েকদিন কাজ চালাই।
গায়ে দেবার সাবান ক্ষয় হয়ে এলে সেটা চলে যায় টয়লেটের কাজে।
বাসায় ইফতার না করে একবারে অফিসে করে আসি। ইফতারের পয়সাটা বাঁচে।
শুক্রবারে অনেক হাসপাতালে ফ্রি রোগী দেখে। অসুখ বিসুখ হলে ওখানে যাই।
অফিস যাবার জন্য আরো অভিনব টেকনিক। একটা গাড়িতে উঠি। কতকটা গেলে বলি, ”এই গাড়ি অমুক যায়গায় যাবে না? আগে বলো নি কেন? ফাজিল কোথাকার!” তাড়াতাড়ি নেমে পড়ি। তারপর আবার আরেকটা বাসে উঠি। একইভাবে আরেকবার বদলে অফিসে যাই, ফিরিও এভাবে।
ছাতা কিনি না। বর্ষা নামলে পাশের বাসা হতে চেয়ে নিয়ে যাই। তারপর ৬ মাসেও ফেরত দিই না।
বন্ধুদের কোনো আড্ডায় যাই না। মাগনা ওয়াইফাইতে গেলে ফেসবুক ব্রাউজ করে ওদের আড্ডার ছবি দেখি।

কী ভাইয়া আর আপু? আমার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে, তাই না? চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছেন? ভাবছেন নিজের কিপটামোর কথা কেন ফলাও করে বলছি? শুনবেন তবে?

আপু, ভাইয়া, শুধু আমিই জানি,
এই শহরে আমি আমার হল লাইফে অনেক মাস প্রতিদিন একবেলা করে খেয়েছি।
এই শহরে আমি ফ্রি খাবার পাবার জন্য কয়েক মাইল হেঁটে একটা আশ্রমে দীর্ঘদিন খেতে গিয়েছি।
এই শহরে আমি টিউশনির বাসায় দেয়া একটি নোনতা বিস্কুট আর পিঁপড়ে পড়ে থাকা লাল চা খেয়ে বিকেল সন্ধার নাস্তা সেরেছি কয়েক বছর।
এই শহরে আমি ৩টি টিউশনি করতে রোজ প্রায় ১৫ মাইল যায়গা হেঁটেছি।
এই শহরে আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট, কোচিং সেন্টারের লিফলেট বিলি করেছি মসজিদের, কলেজের গেটে দাড়িয়ে, রোজ ঠিকা ৮০ টাকার বিনিময়ে।
এই শহরে আমি বহু প্রতিষ্ঠিত লেখকের হয়ে গোপনে লেখা লিখে দিয়ে কিছু পয়সা পেয়েছি।
এই শহরে আমি হ্যাংলা, হাভাতের মতো দেয়ালে সাঁটা চাকরীর বিজ্ঞাপন বুভুক্ষুর মতো খুঁজেছি।
এই শহরে আমি একটি চাকরীতে জয়েন করার জন্য দুশো টাকা দিয়ে ব্ল্যাক মার্কেট হতে জুতো কিনেছি।
এই শহরে আমি আমার বন্ধুর শার্ট ধার করে পড়ে প্রথম ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি।
এই শহরে আমি আমার বসের নোংরা গালি শুনতাম, চাকরীটা ধরে রাখার ভয়ে।
এই শহরে আমি ঈদের ছুটিতে হোস্টেলে থেকে গেছি বহুবার, বাড়িতে যাবার টিকেটের টাকা ছিল না বলে।
এই শহরে আমি রুমমেটের বাসা হতে আসা শবে বরাতের রুটি হালুয়া খেয়ে বহু শবে বরাত চোখের জল লুকিয়েছি।
এই শহরে আমি ঈদে মার জন্য একটা শাড়ি কেনার জন্য একব্যাগ রক্ত বিক্রি করেছি।
এই শহরে বাসে কারো ফেলে যাওয়া এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট পেয়ে আমি আর সেটা ফেরত দিইনি। ওটাই ছিল কয়েক মাস আমার গোপন রাতগুলোর প্রিয় সঙ্গী।
এই শহরে বহুরাতে আমি নয়াপল্টনের মোড়ে বাসের অপেক্ষায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিয়নের আলোয় দাড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর অফার করা লাল চা হ্যাংলার মতো খেয়েছি।
এই শহরে বই কিনতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বাধ্য হয়েছি নিজের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ আর শরতের কালেকশন বিক্রি করে দিতে।
এই শহরে আমি, হ্যা, এই আমি, শাহবাগের ফেলে দেয়া ফুলের ভাগাড় হতে কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে প্রেমিকাকে উপহার দিয়েছি বহুবার।
এই শহরে আমি আমার প্রেমিকার জন্মদিনের ‍উপহার কিনবার জন্য নিজের প্রথম কবিতার পান্ডূলীপি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।
এই শহরে প্রেমিকাকে বিয়ে করে আমি বাধ্য হয়েছি হাতের ঘড়িটা বিক্রি করে আমকাঠের একটা চকি কিনতে। চাপাচাপি করে তাতে শুতে।
এই শহরে আমাদের ভালবাসার প্রথম ফুল আমার চোখের সামনে ঝরে গেছে, অপারেশনের টাকা সময়মতো যোগাড় না হওয়ায়। এই নিষ্ঠূর শহর দেয়নি আমার প্রিয়তমার চিকিৎসার জন্য দুটি টাকা।

আপনারাই বলুন, তারপরও কি আমি পারি, আজ আমার টাকায় বিলাস করতে? নিজেকে একটু আয়েস কিনে দিতে? টাকা আমার হবারই ছিল বলে আজ সে ধরা দিয়েছে পায়ের তলে। টাকাকে আমি চিনি সেই যবে থেকে থেকে এই শহরে এসেছি। টাকা বড় মূল্যবান। তাকে কি আমি বিলাসে হারাতে পারি?

জানেন কি ভাইয়া, কতজন আজও বসে আছে এই শহরে, আমার সেই দিনগুলোর মতো, যাদের ভালোবাসা বাঁচাতে, ভাল থাকাকে বাঁচাতে আমার টাকাই একমাত্র ভরসা। সময়মতো ওদের পৌছে দিতে হয় যে আমার কৃপনতার সবটা সঞ্চয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×