সারাদিনের ঘোরাঘুরির ক্লান্তি, তারপরেও খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। বারান্দায় এসে দাড়ালাম। একরাশ মুগ্ধতা গ্রাস করলো আমাকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাড়ী, মেঘগুলো অনেকটা নিচে নেমে এসে কুয়াশার মতো আবহ তৈরি করেছে, তার ফাকে ফাকে বাড়ী, গাছপালা দৃশ্যমান। মনের ভিতরের ওয়াও নজরুল গীতি হয়ে বেড়িয়ে এলো মুখ দিয়ে, গুনগুনিয়ে উঠলাম, ’আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। কবি আমি কোনকালেই ছিলাম না, গান বোমা ফাটালেও আমার মুখ দিয়ে বের হয় না। সেই আমি গান গাইছি! অন্য সময় হলে হেসে ফেলতাম। আসলে প্রতিটা বা্ঙালীই মনে হয় মনে-প্রানে একজন কবি, একজন গায়ক। মনে হলো সারাটাদিন যদি এখানে বসে কাটিয়ে দিতে পারতাম!
আজ সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাতে ঘরে ফিরবো, কাল থেকে আবার সেই একঘেয়ে জীবন! চিন্তা করেই ক্লান্তিতে শরীর-মন ভেংগে পড়তে চাইলো। জীবনের সুন্দর সময়গুলো এত ক্ষনস্থায়ী হয় কেন?
ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে নাস্তার টেবিলে আসলাম। গৃহকর্তা এখন নাস্তা সার্ভ করছেন, পড়নে তার স্কটিশ হাইল্যান্ডের ওইতিহ্যবাহী পোষাক, টারটান। বললাম, তোমাকে তো দারুন দেখাচ্ছে! মাথা নুইয়ে প্রশংসার জবাব দিল। খাঁটি স্কটিশ ব্রেকফাস্ট করে বিদায়-টিদায় নিয়ে আবার পথে বেড়িয়ে পড়লাম। আজ আমরা ফোর্ট উইলিয়াম যাবো, সেখানে ঘোরাঘুরি করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবো।
(ড্রামনাদ্রোচিট থেকে ফোর্ট উইলিয়াম এর পথে)
আমাদের মূল গন্তব্য ফোর্ট উইলিয়াম এর কাছে ’ইলেক মোর’ নামে একটা পর্বত। এটি নেভিস পর্বতমালার অষ্টম উচ্চতম পর্বত। কেবলকারে করে এর মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠা যায়। শীতকালে এটা স্কীয়ারদের একটা অতি পছন্দের স্পট।
(পূর্ন শীতে ’ইলেক মোর’, নেট থেকে নেয়া)
ফোর্ট উইলিয়াম এর কাছাকাছি এসে একটা পর্বতের চুড়ায় দেখলাম বরফ জমে আছে। রাস্তা থেকে অত উপরে ছোট্ট সাদামতো দেখাচ্ছে। ঘোর সামারে চুড়ায় বরফ দেখে আমরা সবাই যারপরনাই উত্তেজিত। হাসান বললো, ইশ্, যদি একেবারে কাছে গিয়ে দেখতে পারতাম! তখন কে জানতো যে, ওটাই আমাদের গন্তব্য! তো জায়গামতো এসে টিকেট নিয়ে গন্ডোলা বা কেবলকারে চড়ে বসলাম। গন্ডোলা হেলে-দুলে রওয়ানা দিল, রোমান্চকর যাএা। নীচের গাছপালা আস্তে আস্তে ছোট হওয়া শুরু করলো এবং একপর্যায়ে গন্ডোলা মেঘের ভিতরে ঢুকে পড়লো। কিছু মানুষ বাস-ট্রেন এমনকি টয়লেটেও তাদের বিভিন্ন বিভিন্ন মনের কথা লিখে রাখে। দেখলাম কেবলকারের কাচের মতো প্লাষ্টিকের দেয়ালও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কেবলকার এসে ল্যান্ডিং ষ্টেশনে থামলো, নেমে দেখি বেশ ঠান্ডা। শীতকালে এটা যেমন স্কী-রিসোর্ট, সামারে তেমনি মাউন্টেইন বাইকারদের স্বর্গরাজ্য। বিভিন্ন ট্রেইল বিভিন্ন দিকে গিয়েছে। একটু হাটতেই চোখে পড়লো সেই পর্বত-চুড়ার বরফ দৃশ্য। আমরা এখন পর্বতের মাঝামাঝি, তাই ওটাও ভালো ভাবে দৃশ্যমান।
(কুয়াশা নয়, মেঘের ভিতরে)
(পর্বতের মাঝামাঝি, গন্ডোলা থেকে নেমে। দুরে বরফ-রাজ্য। রাস্তা থেকে যেটা বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিল সেটা ভালোভাবে দৃশ্যমান। ঝর্ণা ও তার উৎস। বরফ-গলা নদীর মতো বরফ-গলা ঝর্ণা। একই জিনিস, পার্থক্যটা শুধু সাইজের।)
সবাইকে একে একে জিগ্গেস করলাম, কে কে ওখানে যেতে চায়, হাসান ছাড়া আর কেউই আগ্রহ দেখালো না। ননীর পুতুল সব! বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম, হাসান আর আমি। উঠছি তো উঠছিই, যখনই আমাদের গন্তব্যের দিকে তাকাই, দেখি ওটা দুরে, দুরত্ব আর কমে না। মরুভূমির মরিচীকার কথা বইতে পড়েছি, সেদিন বাস্তবে কিছুটা হলেও স্বাদ পেলাম। এদিকে আমাদের জিহ্বা আধ-হাত বের হয়ে গিয়েছে। আধাআধি পথে দেখি একটা কাঠের কেবিন, গিয়ে দেখি কেউ নাই, তালাবন্ধ। এটা আসলে একটা ষ্টোর কাম কফি শপ, শুধুমাএ শীতেই খোলা থাকে, স্কীয়ারদের জন্য। হাসান কেবিনের সিড়ি দেখিয়ে বললো, আমি এইখানে বসি, আপনে গিয়ে ঘুরে আসেন, আমার দ্বারা হবে না। ওর পাশে আমিও ধপ করে বসে পড়লাম। ভাবলাম যথেষ্ট হয়েছে, এখান থেকেই ফিরে যাই, এত কষ্ট করে ওই বরফ-রাজ্যে যাওয়া এমন কোনো জরুরী বিষয় না।
(কেবিন, পিছনে মেঘ)
(কেবিন থেকে তোলা)
১৫ মিনিট রেষ্ট নেয়ার পর একটু তাজা হলাম, ভাবলাম এতদুর আসলাম, আর একটু কষ্ট করে দেখেই যাই। হাসানকে ’ইজ্জতের উপর হামলা’ সংক্রান্ত কিছু মোটিভেশান দিলাম, শেষে ও বললো, আল্লা ভরসা, চলেন যাই। অবশেষে পৌছলাম। ফটো সেশানের মধ্যেই উপর থেকে একজন নেমে আসলেন। উনি এডিনবরা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর। ভদ্রলোকের শখ হলো পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ানো। আমাদের পোশাক-আশাক, জুতা দেখে হাল্কা তিরস্কার করলেন, বললেন যথাযথ পোষাক, জুতা এবং কিছু আনুষাংগিক জিনিস পএ ছাড়া পর্বতারোহনে যে কোনও সময় যে কোনও বিপদ হতে পারে। দুঃখ প্রকাশ করে বললাম যে আমাদের আসলে কোন প্ল্যান ছিল না, হঠাৎ করেই উঠেছি। উনার কথা সত্যি প্রমান করার জন্যই সম্ভবত নামার সময় ৩/৪ বার পিছলা খেয়ে পড়লাম। তেমন কিছু হয়নি, ২/১ জায়গায় হাল্কা ছিলে গিয়েছিল।
(’ইলেক মোর’ থেকে নীচে)
নীচে নেমে কেএফসিতে দুপুরের খাবার খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম, একরাশ ভালো-লাগা স্মৃতি নিয়ে।
(ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বাড়ীর দিকে যাএা)
-সমাপ্ত-
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৬