হুমায়ুন আহমেদের ’নক্ষত্রের রাত’ বইটা নিশ্চয়ই অনেকেই পড়েছেন। গল্পে বাংলাদেশের এক মেয়ে, রেবেকা একটা কোর্স করতে আমেরিকায় যায়। সেখানে ক্লাসে বাংলাদেশ নিয়ে হাসাহাসির একটা ঘটনায় মেয়েটা কেদে-কেটে একাকার অবস্থা করে। সেই ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন ডঃ রেলিং। ঘটনার পর ক্লাশের শেষে ডঃ রেলিংএর সাথে রেবেকার কথোপকথনের একটা অংশ তুলে দিচ্ছি।
ডঃ রেলিংঃ আজ তুমি কিছুটা অপমানিত বোধ করেছ বলে আমার ধারনা। আমি তার একটি প্রধান কারন। তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কাউকে অপদস্থ করা আমার পেশা নয়। তবে রেবেকা, কোন ব্যাপারেই এত সেনসিটিভ হওয়া ঠিক না। বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত দরিদ্র দেশ - এটা তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো। আমরা সবাই জানি। জানা সত্বেও দেশকে দরিদ্র বললে তুমি একটা শিশুর মতো আচরন করবে এটা ঠিক না।
এই ইউনিভার্সিটিতে অনেক আগে একটি বাংলাদেশী আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্র তোমার মতোই শিশুসুলভ আচরন করেছিল। তার দেশ সম্পর্কে কে যেন কি বলেছে, সে ঘুষি মেরে তার দুটি দাত ভেঙ্গে ফেলেছে।
আমি স্বীকার করলাম তোমরা তোমাদের দেশকে দারুন ভালোবাসো। অথচ আমি যতোদুর জানি, তোমাদের দেশে সামরিক শাসন চালু আছে। যে দেশের মানুষ তাদের দেশকে এতো ভালোবাসে তারা কি করে সামরিক শাসন চুপচাপ মেনে নেয়? এবং আমি শুনেছি, যে ব্যাক্তিটি তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নায়ক, তাকে সপরিবারে মেরে ফেলা হয়েছে এবং কেউ একটি কথাও বলেনি। আমি যা বলছি, তা কি সত্যি?
রেবেকাঃ হ্যা সত্যি।
ডঃ রেলিংঃ তোমাদের দেশের প্রতি যে ভালোবাসা, তা কেমন ভালোবাসা বলতো রেবেকা?
রেবেকা চুপ করে রইলো।
চুপ করে থাকা ছাড়া রেবেকার আর কোন উপায়ও ছিল না। গত সপ্তাহে অনেকটা এমনই একটা ঘটনার মুখোমুখি আমি হয়েছিলাম এবং চুপ করে থাকা ছাড়া আমারও আর কোন উপায় ছিল না। হুমায়ুন আহমেদের বইটা লেখার সময়ে দেশের যে প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে, তার খুব একটা পরিবর্তন কি হয়েছে? ডঃ রেলিংএর মতো আমারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, দেশের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, তা কেমন ভালোবাসা?
দেশ আমাদের মা। একজন মা যেভাবে অনেক কষ্ট করে সন্তান ধারন করেন, জন্ম দেন, বড় করেন, দেশও তাই করে। তাই দেশকে আমরা মায়ের মর্যাদা দেই। কিন্তু বড় হয়ে আমরা যখন মায়ের বুক প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করি, বিশ্ব-দরবারে মায়ের মাথা নীচু করি, মায়ের সঠিক পরিচর্যা, সেবা-শুস্রষা না করে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর পর্যায়ে নিয়ে যাই - তখন সন্তান হিসাবে আমাদের অবস্থান কোথায় থাকে? এমন কুলাঙ্গার সন্তান কি কোন মা কামনা করেন?
কবি-সাহিত্যিকদের ভাষায়, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার দেশ - বাংলাদেশ। একসময় হয়তোবা ছিল, নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু আমরা সেই দেশ ক’জন দেখেছি? পাহাড় কেটে সমান করে, নদী-নালা খাল-বিল ভরাট করে, গাছ-পালা উজাড় করে, বন-জঙ্গল ধ্বংস করে আমরা বাংলা মায়ের বুক ক্ষত-বিক্ষত করেছি, এখনও প্রতি-নিয়তই করছি। আমরা থামছি না, থামার কোন লক্ষণও নেই। ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে আমরা কি দেশ রেখে যাচ্ছি? কি দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি যা দেখে তারা দেশপ্রেমে আপ্লুত হবে? মায়ের বুকে কুড়াল কিংবা কোদাল মারা এমন সর্বনাশা সন্তান পৃথিবীর আর কোন দেশমাতা দেখেছে? মনে হয় না!
দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে, আর এটা ২০১৮। দেখতে দেখতে ৪৭টা বছর পার হয়েছে। দেশ শিশুকাল পার হয়ে এসেছে কিন্তু এখনও কি সত্যিকার অর্থে নিজের পায়ে শক্ত করে দাড়াতে শিখেছে? উন্নত দেশের কথা বাদ। শুধু চিন্তা করেন তো ১৯৭১ সালে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিন কোরিয়া কোথায় ছিল? এমন কি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো? বাংলা মায়ের বেদনার্ত মুখ কি আমাদের চোখে পড়ে না? বিশ্ব-সমাজে মায়ের এই অবনমিত দৃষ্টি কি আমাদেরকে একটুও কষ্ট দেয় না? দুঃখের সাথে বলতে হয়, না দেয় না। দিলে হুমায়ুন আহমেদকে, আমাকে কিংবা আমাদেরকে এই কথাগুলো বলতে হতো না। বিশ্ব-বেহায়া আমাদের দেশে একটা না - অনেক, অসংখ্য!
বিদেশে দেখেছি, এরা নারী-পুরুষের অন্তর্বাস, জুতা-স্যান্ডেল থেকে শুরু করে সবকিছুতেই দেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে প্রচুর পরিমানে। আমরা তা স্বপ্নেও চিন্তা করি না। সর্বনাশ, এতে দেশের অসন্মান হবে না! এরা দেশের প্রতি ভালোবাসা ধারন করে বুকে। আমরা করি মুখে। একবারের জন্যও চিন্তা করি না আমাদের এই লোকদেখানো ভালোবাসা আমাদের এই মাতৃভূমিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
দেশের প্রশ্নে আমরা শতধা বিভক্ত, আর ওরা এক। একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। সেদিন আমার এদেশী এক সহকর্মী আরেক পোলিশ সহকর্মীর কাছে শুনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চরম প্রশংসা করছে। আমি হতবাক। ও হচ্ছে লেবার পার্টির কট্টর সমর্থক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সকালে একবার, বিকালে একবার গালাগালি করে! জিজ্ঞেস করাতে বললো, ও বাইরের লোক! ওর কাছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূর্ণাম কেন করবো? এই হলো দেশপ্রেম। আর আমাদের দেশপ্রেম হলো ভিন্ন দেশের স্বার্থে নিজের দেশকে, মাকে ক্ষত-বিক্ষত করা - রামপালের মতো!
বড় না, একটা ছোট্ট উদাহরন দেই। প্রতি শীতে আমি দেশে আসি। শীতে মানুষের সর্দি-কাশি বেশী হয়। প্রতিবারই রাস্তায়, ফুটপাতে আমি প্রচুর সবুজ-হলুদ-সাদা-কালো কফ দেখি। যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে। পাবলিক প্লেস কি কফ-থুতু ফেলার জায়গা? আমরা ক’জন আমাদের ঘরে যত্রতত্র কফ-থুতু ফেলি? ওহ, ওটাতো আমার বাড়ী, কিন্তু রাস্তাটা তো আমার না! আমরা উচু বিল্ডিং থেকে নীচে ময়লা ফেলি। চিপস, বাদাম, সিগারেট খেয়ে প্যাকেট, খোসা, বাড রাস্তায় ফেলি। রাস্তা হলো আমাদের ময়লার ডাম্পিং স্টেশান। দেশের প্রতি ন্যূনতম কমিটমেন্ট-সম্পন্ন সুস্থ মানুষ এগুলো করে না। পৃথিবীর অনেক দেশ আমি ঘুরেছি, এমন মহামারী আকারে এসব আমি কোথাও দেখিনি। একজন দূর্বল মা সুস্থ্য-সবল সন্তান জন্ম দিতে পারেন না। আমাদের চারিদিকে আজ অসুস্থ, দূর্বল, বিকলাঙ্গ সন্তানের ছড়াছড়ি! তাই আমাদের মা-ও ভালো নেই। এই দুঃখ, এই কষ্ট আমি কোথায় রাখি?
আমাদের নেতা-নেত্রীরা বিদেশে আসেন ঘুরতে, কিছু শিখতে না। শেখার ইচ্ছাও নেই, শিখতে চানও না। শিখলে লাভ কি? দিনের শেষে ব্যাংক ব্যালেন্সটাই যে শেষ কথা! দেশের সেবা করলে নিজের সেবার কি হবে! অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা করে, বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু কি লাভ? সবই অরন্যে রোদন! মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, খুবই। রাগে-দুঃখে, ক্ষোভে চোখে পানি চলে আসে। ইচ্ছা করে চিৎকার করে কাদি।
আমরা এমন কেন???
পুনশ্চঃ কৃতজ্ঞতা সেইসব নিভৃতে, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলা মায়ের সন্তানদের প্রতি। যারা না থাকলে হয়তো বা এই দেশ থাকতো না, যাদের কারনে এই দেশটা এখনও টিকে আছে। যারা আড়ালে থেকেও দেশের মঙ্গলে সদা নিয়োজিত। সংখ্যালঘু হলেও এরাই দেশের প্রকৃত সন্তান, নাম পরিচয়হীন জারজ নয়।
ফটো ক্রেডিটঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৫