somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - চতুর্থ পর্ব

০৬ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - তৃতীয় পর্ব

ইস্তান্বুলের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার কম্বাইন্ড টিকেট করাই ছিল, কিন্তু ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন দেখতে গিয়ে শুনলাম সেটা এখানে কার্যকর হবে না। এটা দেখার জন্য আলাদা টিকেট করতে হবে! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল! এখানে আসার আগেই এক সিরিয়ান শরনার্থীকে কিছু লীরা দিয়েছি। পকেটে যা আছে তার চেয়ে টিকেটের দাম বেশী। কি আর করবো, আবার বেশকিছু হেটে গিয়ে পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে আনলাম। খসে গেল ১৫ টা মুল্যবান মিনিট! টিকেট কাটতে কাটতে আপন মনেই রাগে গজরাচ্ছিলাম। কাউন্টারের সুন্দরী তরুণী বললো, 'তুমি কি কিছু বলছো?' আমি বললাম, 'হ্যা, বলছিলাম যে তোমাদের দেশটা খুব সুন্দর।' ওর বিরক্ত মুখটা খুশী খুশী হয়ে উঠলো দেখে বললাম,'তুমিও খুব সুন্দর'। এবারে সবগুলো দাত বের করে ফেললো। টিকেট নিয়ে হাত নেড়ে ভিতরে ঢুকে পরলাম।

বাইরের প্রখর ঝলমলে আলো থেকে ভিতরের অন্ধকারে ঢুকে প্রথমে চোখে কিছুই দেখছিলাম না। একটু পরেই অবশ্য চোখ সয়ে এলো। ভিতরটা এক অন্য জগত। মাটির উপরের পরিবেশ থেকে একেবারেই ভিন্নতর। এখানেও প্রচুর মানুষ, কিন্তু কোন কোলাহল নাই। শীতল এবং শান্ত একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। পরিবেশ মানুষকে মুহুর্তের মধ্যে কিভাবেই না বদলে দেয়, আশ্চর্য!

এবার ব্যাসিলিকা সিস্টার্নের ইতিহাসটা আপনাদেরকে একটু সংক্ষেপে বলি। ’সিস্টার্ন’ মানে হচ্ছে জলাধার। নগরবাসীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ৫৩২ খৃষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানাস - ১ এটি তৈরী করান। এটা জনগনের কাছে 'ইয়েরেবাতান সিস্টার্ন' নামে পরিচিত ছিল। ইস্তান্বুলের সবগুলো সিস্টার্নের মধ্যে এটি ছিল বৃহত্তম। প্রায় ৮০,০০০ কিউবিক মিটার (১,০০,০০০ টন) পানি ধারন-ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিশাল সিস্টার্নে ৯ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ৩৩৬ টা মার্বেল পাথরের কলাম রয়েছে। প্রায় ২০ কি.মি দুরে ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণ সাগর) এর কাছে অবস্থিত আরেকটি জলাধার থেকে খাল এবং টানেলের মাধ্যমে এখানে পানির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হতো। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে প্রকৌশল বিদ্যার কি অনুপম প্রয়োগ, চর্মচক্ষু দিয়ে না দেখলে মাটির নীচের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অনুধাবন করা মুশকিল!



ঘুরে ঘুরে দেখছি, কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরছিল একটা প্রশ্ন। সিস্টার্ন তো বুঝলাম, কিন্তু 'ব্যাসিলিকা' কেন? ব্যাসিলিকা তো খৃষ্টান ধর্মে উপাসনালয়গুলোর একটা রুপ (এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার ইটালীর পর্বে লিখেছি)। শেষমেষ এক গাইডের ধারা বর্ণনা আড়িপেতে শুনে এর উত্তর পেলাম। সেটা হলো, এই স্থাপনার উপরে একটা ব্যাসিলিকা ছিল একসময়। তাছাড়া এর কলামগুলো বিভিন্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা থেকে সংগ্রহ করে আনা হয় যার একটা বড় অংশই ছিল বিভিন্ন ব্যাসিলিকার। তাই লোকজন এটাকে ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন নামেও জানতো, বর্তমানে এই নামটাই বেশী প্রচলিত।

এখন আর সিস্টার্ন ভর্তি পানি থাকে না, তবে একেবারেই যে নেই তা কিন্তু নয়। বর্তমান পানির লেভেল হাটু পানির চেয়েও কম। অন্ধকারে একটু খেয়াল করে তাকালে পানিতে মাছের খেলা দেখা যায়। একসময় এখানে নৌকা দিয়ে ঘুরতে হতো। ১৯৮৫ সালে পর্যটকদের সুবিধার্থে পুরোটা সিস্টার্ন জুড়েই বিভিন্ন অংশে ফুটপাথের মতো কাঠের পাটাতন বিছানো হয়।

সিস্টার্নে সময় সময় সিনেমার শ্যুটিং, কনসার্ট ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের কালচারাল ইভেন্ট হয়। যেমন, বিখ্যাত জেমস বন্ড মুভি, ’ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ এর কিছু গুরুত্বপূর্ন শ্যুটিং এখানে হয়েছিল।

এই সিস্টার্নটি পুনরুদ্ধারের কাহিনীটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। বাইজেন্টাইন সম্রাটরা গ্র্যান্ড প্যালেস ছাড়ার পর এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন, এমনকি নগর কর্তৃপক্ষও আস্তে আস্তে এটার কথা ভুলে যায়। ১৫৪৫ সালে পেট্রাস গিলিয়াস নামের এক গবেষক বাইজেন্টাইন আমল নিয়ে একটি গবেষণা করছিলেন। এ সময় কিছু স্থানীয় বাসিন্দা জানায় যে, তারা তাদের বেজমেন্টের মেঝের নীচে এক অন্ধকার জায়গা থেকে বালতি দিয়ে পানি তোলে, এমনকি সেখান থেকে মাঝে-মধ্যে মাছও ধরে। তো গিলিয়াস ভাই কৌতুহলী হয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে অবশেষে এই সিস্টার্ন পুনরাবিষ্কার করেন।

৩৩৬ টা কলামের মধ্যে কয়েকটা কলাম খুবই বিখ্যাত কিছু মিথের কারনে।

ময়ুর-চোখ কলামঃ ইতিহাসবিদদের ভাষ্যমতে, প্রায় ৭,০০০ ক্রীতদাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি তৈরী হয়, অনেকে মারাও যায়। এই কলামটা বেয়ে সবসময় পানি পড়তে থাকে। বলা হয়ে থাকে, মৃত ক্রীতদাসদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এটি সবসময় কাদতে থাকে।



মেডুসা’র মাথা কলামঃ এ সম্পর্কে দুইটা গ্রীক মিথ প্রচলিত আছে। প্রথমটা হলো, মেডুসারা তিন বোন। এরা মাটির নীচের জগতের নারী-দৈত্য বিশেষ, যাদের কাজ হচ্ছে কোন বিশেষ স্থাপনাকে নিরাপত্তা দেয়া। তাই এদের ছবি বা মূর্তি স্থাপনার মধ্যে রেখে দেয়া হতো। ছবির এই স্নেক-হেড মেডুসা সেই তিনজনের অন্যতম।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, মেডুসা একটা অসম্ভব রুপবতী মেয়ে যে কিনা ভালোবাসতো দেবতা জিউসের ছেলে পারসিয়াসকে। এদিকে, এথেনাও (জিউসের মেয়ে) পারসিয়াসকে ভালোবাসতো। এই ত্রিভূজ প্রেমের চক্করের কারনে এথেনা ক্ষেপে গিয়ে শাস্তিস্বরুপ মেডুসার চুলগুলোকে সাপে রুপান্তর করে দেয়। ঘটনা যাই হোক, ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন দেখতে গেলে ট্যুরিষ্টদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এই মেডুসা-হেড কলাম দু’টো।




অন্ধকারের কারনে পুরো কলামের ছবিটা আমার ভালো আসেনি, তাই নেট থেকে একটা দিয়ে দিলাম,



এই শিরোস্ত্রানের ঘটনা কি জানিনা। আশেপাশে কিছু লেখাও নাই। সবাই দেখি চিৎ-কাৎ হয়ে বিভিন্ন ঢঙ্গে ছবি তুলছে, তাই আমিও একটা তুললাম,



বেসিক্যালী সিস্টার্ন হলো একটা বৃহদাকার পানির ট্যাংকি! সেক্ষেত্রে এর মেঝেতেও কেন নকশা করতে হবে? একটা কথা আছে না, 'নাই কাজ, তো খই ভাজ।' আসলেই নকশার কোন শেষ নাই (দু-অর্থেই!!),



সব ঘুরে ঘুরে দেখে যখন মনে হলো পয়সা উসুল হয়েছে, তখন মাটির নীচের অন্ধকার থেকে উপরের আলোর জগতে উঠে এলাম। আমার পরবর্তী গন্তব্য হলো গুলহানে পার্ক। পার্কটি ইস্তান্বুল নগরীর সবচেয়ে বড় এবং একইসঙ্গে ইতিহাস-খ্যাতও বটে।

হেটে গেলে মিনিট পনেরোর মতো সময় লাগে। সময় এবং শ্রম বাচানোর জন্য উঠে পড়লাম ট্রামে। ইস্তান্বুলের ট্রাম কিন্তু সেই মান্ধাতার আমলের ট্রাম না, অত্যন্ত আধুনিক আর নান্দনিক। ৫ মিনিটের মধ্যে জায়গামতো পৌছে গেলাম।

পার্কের কয়েকটা ছবি দিলাম,







আতাতুর্কের এই ভাস্কর্যটি পার্কের শোভা বাড়িয়েছে,



ওসমান হামদী বে, একজন মশহুর তুর্কী চিত্রকর। 'কচ্ছপ প্রশিক্ষক' (The Tortoise Trainer) নামে তেলরঙ্গের একটি বিখ্যাত ছবি আকেন ১৯০৬ সালে। ২০০৪ সালে ছবিটি ৩.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় হয়। ছবিটির একটা কপি নেট থেকে দিলাম।



এই ছবিটার একটা বাস্তব প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে গুলহানে পার্কে। আমার ক্যামেরায় তোলা ছবিটা দেখুন। ছবিতে কচ্ছপগুলো অবশ্য পরিস্কার দেখা যায় না, ফুলগাছের বেডের কারনে! তবে কাছ থেকে দেখলে তাদের দেখা পাওয়া যায়।



পার্ক থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে চলে এলাম এমিনন্যুর স্পাইস বাজারে, কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম। কিছু টার্কিশ ডেলাইট কিনলাম, তারপর ক্লান্ত শরীরে ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।


ছবিঃ তিনটা নেট থেকে, বাকিসব আমার ক্যামেরা ও ফোন থেকে।
তথ্যঃ বিবিধ।

ইস্তান্বুলের অলি-গলিতে কয়েকটা দিন - পন্চম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৪৪
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×