এ্যাই.. .. .. শুনছো? আমার বউ এর সুরেলা গলা।
সামুতে লেখার জন্য একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম শুয়ে শুয়ে। আনমনে বললাম, হু।
’হু’ কেমন উত্তর?
চিন্তায় বাধা পরাতে একটু বিরক্ত লাগলো, কিন্তু তা প্রকাশ করলেই কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। তাই সেদিকে না গিয়ে বললাম, জ্বী, শুনছি।
চা খাবে?
বলে কি! এইবার আসন্ন বিপদের আশংকায় লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। সুরেলা গলা শুনেই আমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। আনমনা থাকায় ঠিক বুঝে উঠতে পারি নাই। এক কাপ চায়ের জন্য যেই মানুষটাকে সারাক্ষন তোয়াজ করতে হয়, পায়ে না ধরলেও হাতে ধরতে হয়, সে নিজে থেকে কেন চায়ের কথা বলবে? 'মেঘ না চাইতেই জল' বলে যে বাগধারা বা প্রবাদবাক্য কি জানি একটা প্রচলিত আছে, সেটা আসলে প্রাচীনকালের কথা। এই যুগে অচল। এই যুগে কোন কিছু চাওয়ার অনেক আগে থেকেই পাওয়ার জন্য সাধনা শুরু করতে হয়। তারপরেও যতোটুকু চাওয়া হয়, তা পাওয়ারই কোন নিশ্চয়তা নাই। বেশী পাওয়া তো বহুত দুর কা বাত। চায়ের কথা শুনে উৎফুল্ল হলেও কৌশলগত কারনে সেটা এক্সপোজ করা যাবে না, মনের ভিতরেই রাখতে হবে। তাই সন্নাসীদের মতো নিরাসক্ত গলায় বললাম, দিতে চাচ্ছ যখন, দাও!
গিন্নী সাথে সাথে উঠে গিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এলো। ভুল বুঝবেন না, প্রথমে আামিও অবশ্য মনে করেছিলাম আমার জন্যই বোধকরি দুই কাপ! একটু আশ্চর্য হলেও পরমূহুর্তে বুঝলাম যে আসলে উনিও আমার সাথে চা পান করবেন। ভাবগতিক দেখে আমি পুরাপুরি বিভ্রান্ত! ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিপদের ঘন্টা টা আমার মাথার মধ্যে বেশ জোড়েসোড়ে বাজা শুরু করলো। আমাকে বলার আগেই সে আমার জন্য চা বানিয়ে রেখেছে, নিজের জন্যও বানিয়েছে। আর কোন এক অজানা প্ল্যানের অংশ হিসাবেই আমার সাথে চা-চক্রে যোগ দিয়েছে।
কিছু না বলে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলাম। দেখি সে পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকানোর স্টাইল অনেকটা বিড়াল যেভাবে মাছের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে; সেইরকম। বললো, চা কেমন হয়েছে?
এবার আমি পুরাই সন্দেহমুক্ত। আমাকে ফাসানোর কিছু একটা প্ল্যান তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দু’দিন আগের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর এক কাপ চা বানিয়ে দিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিলাম, চিনি একটু বেশী হয়ে গিয়েছে। আমি তো ডাইলখোর না, এতো চিনি দাও কেন?
বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল, নিজেও তো বানাতে পারো। এতোই যখন খুতখুতানী, তখন নিজেই বানিয়ে খাও। আমাকে ডিষ্টার্ব কর কেন?
তো সেই বউ, আর এই বউ; একই। কোন অদল-বদলও হয় নাই। তাহলে ঘটনাটা কি? বললাম, চা একদম পারফেক্টো হয়েছে। এবার বলো তোমার মতলবটা কি?
তোমার কথার যা ছিরি! আমি কি মতলববাজ নাকি? কোন মতলব নাই। ভাবলাম দু’জনে একসাথে বসে চা খাই।
চা খেতে খেতে এই কথা সেই কথা বলতে বলতে আমার টান টান ভাব কেটে গিয়ে যখন মাত্র স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছি, ঠিক এমন সময় বউ কোপটা দিল।
চলো না, এবারের ঈদটা সুমনাদের ওখানে গিয়ে করি! বউ টেনে টেনে আহ্লাদী গলায় বললো।
কোন সুমনা? কোথায় থাকে?
আহা, ঢং কোরো না। তুমি যেন জানো না। আমার বড়খালার ছেলের ছোট শালার বউ, সুমনা! প্যারিসে থাকে। কতোদিন ধরে যেতে বলছে। তুমি খালি টাল-বাহানা করো।
শুনে আমার মাথায় কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠলো। আমার আবার সম্পর্ক-ফোবিয়া আছে। বাবা-মা, ভাই-বোন, কাকা-ফুফু, মামা-খালা পর্যন্তই আমার মাথায় ভালো ভাবে ঢোকে। খুব বেশী হলে ফার্স্ট কাজিন। এরপরের সম্পর্কের কথা ভাবতে গেলেই মাথায় এলোমেলো প্যাচ লেগে যায়, চক্কর দেয়। ঠিক বুঝে উঠতে পারি না সম্পর্কের এন্ড রেজাল্ট টা কি হবে। অর্থাৎ আমার এবং আমার কাউন্টার পার্টের মধ্যে সম্বোধন কি হবে।
সে যাই হোক, বললাম, কিন্তু তুমিতো জানো এই ঈদের ছুটিতে আমার কত্তো কাজ। তাছাড়া, সামু'র জন্যও লিখতে হবে। টাইট অবস্থা। বরং তুমি গিয়ে ঘুরে আসো।
সামু’র কথা বলতেই বউ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। বললো, দুই দিন পর পর একা একা এদিক-ওদিক ড্যাং ড্যাং করে ঘুরতে যাও। তারপর এসে দিনের পর দিন সামুর জন্য লেখো। আমি কিছু বলি? কতোদিন থেকে বলছি, চলো সুমনাদের ওখান থেকে ঘুরে আসি! আমি কিছু বললেই যতো রকমের বাহানা।
ঝটকা দিয়ে আমার সামনে থেকে আমার আধা খাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে কিচেনে চলে গেল, বাকীটুকু খাওয়ার চান্সই পেলাম না। শুনলাম কিচেনে হাড়িকুড়ির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমি দেখলাম পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বসে বসে ভাবছি কি করা যায়। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে দিনে দিনে বেড়ানো তাও ঠিক আছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে রাতে থাকাটা আমার একদমই পছন্দ না।
একটু পরই রণ-রঙ্গিনী মুর্তি একটা ফ্রুটনাইফ নিয়ে আবার আমার সামনে এসে হাজির। চাকু আমার নাকের সামনে দোলাতে দোলাতে বললো, আমি ঈদ করতে ঢাকায় চলে যাচ্ছি। টিকেট দ্যাখো। তুমি তোমার সামুকে নিয়েই থাকো। ঘর-সংসার করো। ওর ভাবসাব দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। হাসি চাপতে চাপতে বললাম, ঠিক আছে, তুমি যখন এতো করে বলছো। চলো, প্যারিসেই যাই। তবে চাকু দিয়ে ভয় না দেখালেই পারতা! যদি নাকে লেগে যেতো?
ও ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ভয় দেখাচ্ছি না তো। জানি ঢাকায় যাওয়ার কথা বললে তুমি রাজী হবা, তাই তোমার জন্য আপেল কাটছিলাম!
মনে মনে বললাম, কতো অভিনয়ই না জানো'রে বন্ধু। একবার বলিউডে গিয়ে লাক ট্রাই করলেও তো পারো, কপাল খুলেও যেতে পারে!
(লেখাটা প্যারিস থেকে ফিরেই লিখেছিলাম। ভাবলাম ইস্তান্বুল ভ্রমনের সমাপ্তি না টেনে আরেকটা পোষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। ব্যস্ততার জন্য ওটা শেষ করতে দেরী হলো, তাই এটা পোষ্ট করতেও দেরী হলো।)
ছবিটা নেট থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৪