হোটেল থেকে বেরোনোর আগে রিসিপশান থেকে বিজিনেস কার্ড পকেটে পুরে নিলাম। বিজিনেস কার্ড যে কত জরুরী তা টের পেয়েছিলাম আমস্টারডামে। সেবার সেদিন সবেমাত্র আমস্টারডামে পৌছেছি, কিছুই চিনি না। আমস্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশান থেকে আমরা ১৫/১৬ জন ডাক্তার বেরিয়েছি পায়ে হেটে শহর দেখতে। স্টেশানের পাশেই হেনিকেন বিয়ার কোম্পানীর হেড অফিস। এখানে আমি আর রিদওয়ান অসতর্কতার কারনে অন্যদের হারিয়ে ফেলি ,ফলে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়- আমরা দুজন হারিয়ে গেলাম কিনা, হোটেলে ফিরতে পারব কিনা ইত্যাদি। আমাদের হোটেল ছিল আমস্টারডাম সেন্ট্রাল থেকে বেশ দূরে। আমরাদেরও ভয় হচ্ছিল। মানি ব্যাগে থাকা হোটেলের বিজিনেস কার্ডের সুবাদে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম।
সামান্য গলিপথ হেটে গিয়ে পড়লাম বড় রাস্তায়। এ এলাকার অধিকাংশ বাড়ী ঘর হল হোটেল, রেস্তোঁরা এবং দোকান। ম্যাকডোনাল্ডসে রাতের খাবার সেরে নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে হাটতে কৌতুহলবশতঃ ঢুকে পড়লাম এক ট্রাভেল এজেন্সীতে । এখানেই আবিস্কার করলাম হোটেলের রেফারেন্স ফি এর জোচ্চুরী।তৃতীয় এবং চতুর্থদিনের ভ্রমনসুচীর টিকেট কেটে ফেললাম ৮০ ডলার করে। কিন্তু এখানেও ঠকলাম কারন হল সরকারী পর্যটন সংস্থা বসফরাস ক্রুইজের ব্যাবস্থা করে থাকে মাত্র ২৫ ইউরোর বিনিময়ে।
তুর্কী ঠগের খপ্পরেঃ- তুর্কী ঠগের গল্প বলার আগে আরো একটা গল্প বলে নিই। এ গল্প তখন আমার মনে ছিলো না, থাকলে অন্তত একশ ডলার বাচত। গল্পটা হলঃ- এক রাজা অপরিচিত ঘোড়া ব্যাবসায়ী সওদাগরকে ঘোড়ার জন্যে বেশ কিছু টাকা আগাম দিলেন। নির্দিস্ট সময়ের মধ্যে ঘোড়া ব্যাবসায়ী আর এল না। এর কিছুদিন পর রাজা মন্ত্রীকে তার রাজ্যে বোকা লোকদের তালিকা তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। মন্ত্রীর তালিকা দেখে রাজা হতবাক, রাজার নাম তালিকার এক নম্বরে। খেপে গিয়ে রাজা ডেকে পাঠালেন মন্ত্রীকে । মন্ত্রীর সবিনয় উত্তর “ হুজুর যে লোক অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা দেয় তার নামই তো সবার আগে থাকা উচিত”
হাটছিলাম বড় রাস্তা ধরে। ফুটপাথের ফেরীওয়ালা তার ডালিতে খয়েরী কাল রঙের কিছু ফল বিক্রী করছিল ।সাতটা ফলের দাম পাঁচ তুর্কী লিরা। সে গুলোর ফেটে যাওয়া খোসার মধ্য দিয়ে ভেতরের সাদা শাঁস উকি দিচ্ছে। নতুন কোন তূর্কী ফল হবে মনে করে এগিয়ে গেলাম। ফেরী ওয়ালা আমার কথা বুঝতে পারছিল না কারন সে ইংরাজী জানে না আর আমি তুর্কী জানি না। এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক । একভাগ ফল কিনে আমাকে ইংরাজীতে জিজ্ঞেস করলেন “ ইস্তাম্বুলে বেড়াতে এসেছেন বুঝি? ভাল ফল, খেয়ে দেখুন। আমাকে দুটো ফল দিলেন। হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম সেগুলো হল রোস্ট করা চেস্টনাট। দু’জন পাশের পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। ভদ্রলোক জানালেন তার বাড়ী তুরস্কের ইজমীরে এবং কাজ করেন মস্কোর তুর্কী দুতাবাসে,ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুলের নগরীর প্রান কেন্দ্র বা সিটি সেন্টার হল তাকসিম স্কোয়ার এবং পাশের ইস্তিকলাল এভিনিউ। অল্প কিছুদিন আগে ইস্তাম্বুলের যে গনজাগরন হয়েছিল তাকসিম স্কোয়ারে সেই কারনে জায়গাটা দেখার ইচ্ছে ছিল। ভদ্রলোককে তা জানাতেই তিনি বললেন - চলুন ঘুরে আসি। ট্যাক্সি করে ইস্তিকলাল এভিনিউতে এসে নামার সময় ট্যাক্সি ভাড়াটা ভদ্রলোক জোর করে নিজে দিলেন। রাতের বেলাতেও বেশ জমজমাট ইস্তিকলাল এভিনিউ। দোকানপাট বন্ধ হলেও হোটেল,রেস্তোরাঁ, পাব, বার ইত্যাদি্ খদ্দেরে ভর্তি। তাকসিম স্কোয়ারে যাওয়ার আগে পাশের রেস্তোরায় ঢুকে চারটে বীয়ার খেলাম দুজনে। আগেভাগেই বলে রেখেছিলাম দুজনে ভাগ করে দেবো বিল। যখন বিল এল, চোখ ছানাবড়া। চারটে বিয়ারের দাম ৪০০ তুর্কী লিরা বা ২০০ ডলার, যার দাম টোরোন্টোতে ১০/১২ ডলার হবে। তুর্কী লিরা কাছে না থাকায় বাধ্য হয়ে আমার ভাগের ১০০ ডলারের নোট টেবিলে রাখলাম। ভদ্রলোক তুর্কী ভাষায় কি যেন বললেন ম্যানেজারকে।মেজাজ বিগড়ানো অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন চশমাটা ফেলে এসেছেন রেস্তোরায়। রেস্তোরায় ঢুকলেন সেটা আনতে। ১৫ মিনিটেও যখন ভদ্রলোক ফিরছেন না তখন বুঝলাম আমার ১০০ ডলারের ভাগ নিতে ঢুকেছেন রেঁস্তোরায়। সুযোগ বুঝে টাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম হোটেলে। যাক বাবা একশ ডলার দিয়ে বেচেছি, কাছে থাকা বাদ বাকী ডলারগুলো খোয়া যায় নি তাই রক্ষা।
দ্বিতীয় দিনঃ-
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল ভোর পাঁচটায়। হোটেলের নাস্তা শুরু হবে সকাল সাতটা থেকে আর ট্যুর কোম্পানীর গাড়ী হোটেল থেকে তুলে নেবে সকাল সাড়ে আটটায়। হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় থাকাতে ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখন সবেমাত্র নগরী জেগে উঠছে লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। ইস্তাম্বুল নগরীর এ অংশের আনাচ কানাচ পূরাকীর্তিতে ভরপুর। কোনটা কয়েকশ বছরের পুরোনো, কোনটা হাজার বছর বা খৃস্ট পুর্ব যুগের পুরোণো। বড় রাস্তায় পড়ে হাটতে থাকলাম। সেদিন ভোরে যে জিনিসগুলো দেখেছিলাম তা হলঃ-
১) চেম্বারলিতাজঃ- ৩৩০ খৃস্টাব্দে সম্রাট কন্ট্যান্টাইনের সম্মানে রোমের এপোলো মন্দির থেকে এনে এই সুউচ্চ পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করা হয় ইস্তাম্বুলের সাত পাহাড়ের চুড়ার একটিতে। এটিকে কনস্ট্যান্টাইনের স্তম্ভও বলা হয়ে থাকে। এই স্তম্ভের মোট আটটি অংশ। প্রতিটি অংশের ব্যাস ৩ মিটার এবং ওজন ৩ টন। একটার পর আরেকটা স্তম্ভ স্থাপন করে সংযোস্থলের চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয় ধাতুর চওড়া পাত দিয়ে। প্রথমে এর চুড়ায় সুর্যকে প্রনামরত দেবতা এপোলো’র মুর্তি থাকলেও তা সরিয়ে নিজের মুর্তি স্থাপন করেন সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন। বজ্রপাতে সে মুর্তি ভেঙ্গে পড়ে যায়। পরে এর চুড়ায় স্থাপন করা হয় ক্রুশ। অটোম্যানরা ইস্তাম্বুল দখল করার পর তা নামিয়ে ফেলা হয়। চেম্বারলিতাজকে বিশ্বাস করা হত এ নগরীর রক্ষাকবচ হিসেবে। জনপ্রবাদ আছে যে এই স্তম্ভের নীচে ধনসম্পদ লুকানো আছে।
২) নুরুদ্দিনওসমানিয়া মসজিদঃ- এটি তৈরী শুরু হয় ১৭৩০ সালে এবং শেষে হয় ১৭৫৫ সালে অটোম্যান সুলতান ওসমান -৩ এর আমলে । মসজিদের ভিতরের দেওয়ালে কুরান শরীফের সুরা এবং আয়াত হস্তলিপিবদ্ধ আছে।
৩) গাজী আতিক আলী পাশা মসজিদ
৪) সুলতান মেহমুত-২ এর সমাধি। ১৪৫৩ সালে সম্রাট মেহমুত -২ কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন এ নগরীকে। তখন থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুল ছিল অটোম্যান তুর্কী সাম্রাজ্যের রাজধানী।
৫)গ্রান্ড বাজারের প্রবেশ দ্বারঃ-