পিজিতে পড়ার সময় প্রফেসর তাহের স্যারের ক্লাস করেছিলাম কিছুদিন। এক দিনের ক্লিনিক্যাল ক্লাসে তিনজন রোগীর কেস প্রেসেন্টেশান শেষ হলে স্যার হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন ডিমের দাম কত? ডিমের সাথে রোগীর কি সম্পর্ক তা আমরা কেউ বুঝতে না পেরেও উত্তর দিলাম তখনকার ডিমের বাজারের দাম যা ছিল – দুই টাকা। যদি তুমি সদরঘাটের ফুটপাথের হোটেলে ডিম খাও দাম কত হবে জিজ্ঞেস করলেন স্যার, উত্তর দিলাম চার টাকা। যদি তুমি শেরাটনে ডিম খাও তাহলে দাম কত হবে ডিমের? তখন পাঁচতারা হোটেলে ডিম খাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয় নি। স্যার নিজেই বলে দিলেন- ৫৫ টাকা। এবার স্যার বললেন তোমাদের কেউ হল বাজারের ডিম, কেউ সদরঘাটের ডিম এবং অন্যজন শেরাটনের। জিনিস একই কিন্তু কোথায় কিভাবে পরিবেশন করা হল তার উপর ভিত্তি করেই দামের পার্থক্য।কিছুদিন আগে পঙ্গু হাসপাতালের প্রফেসর কৈরী স্যারের কিছু ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছিলাম । ছোট ভাই মানস মন্তব্যে লিখেছিল এমন অনেক ঘটনা আমাদের জীবনেও আছে কিন্তু লিখতে পারি না। আমিও যে খুব বেশী লিখতে পারি তা নয় । জীবনের সাধারন অভিজ্ঞতা গুলোকে অসাধারন করে,পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপেয়ার, টলস্টয়ের নাম,যশ, খ্যাতি। এবার দেশে গেলে মোহসীন ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন কি করিস সারাদিন টোরোন্টোতে বসে। উত্তর দিলাম ফেসবুকে গল্প লিখি। তাই নাকি? ঠিক আছে পড়ে দেখব কি লিখিস তুই। পরদিন মোহসীন ভাই “পূর্ব কানাডা ভ্রমন” পড়ে এসে বললেন “ ভাল লিখেছিস, লিখে যা। বিয়ে বাড়ীতে “ মিস্টান্ন মিতরে জনা” অর্থাৎ কেমন খাওয়ালো সেটাই যেমন সাধারনের বিচারের বিষয়, আমার লেখা “আবোল তাবোল” এর মধ্যে কতটুকু মিস্টান্ন পাচ্ছেন সাধারন পাঠক সে ভার তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফিরে চলি ইস্তাম্বুলে।
ইস্তাম্বুল নগরী বসফরাস প্রনালী থেকে ইউরোপীয় অংশ।
ইস্তাম্বুল নগরী বিভিন্ন দিক দিয়ে অনন্য। প্রাচ্য( Orient )এবং পাশ্চাত্য(Occident ) এসে মিশেছে এখানে। কৃষ্ণ সাগরের জল বসফরাস প্রনালী দিয়ে পড়েছে মারমারা সাগরে । আর মারমারা থেকে দার্দানালিস প্রনালী গিয়ে মিশেছে ভূমধ্যসাগরে। পশ্চিমের ইউরোপ এবং পূর্বের এশিয়া মহাদেশকে ভাগ করা এই জলপথের দুই তীরে দু’হাজারেরও বেশী বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে ইস্তাম্বুল।
ইস্তাম্বুল নগরী- বসফরাস প্রনালী থেকে ইউরোপীয় অংশ।
কখনও এ নগরী ছিল সম্বৃদ্ধির শীর্ষে আবার কখনও ছিল হত দরিদ্র। দুই মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা পৃথিবীর একমাত্র নগরী ইস্তাম্বুল। দেড় হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে বাইজেন্টাইন, রোমান এবং অটোম্যান , ইতিহাসের এই তিন বৃহৎ সাম্রজ্যের রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। প্রাচ্যের ইসলাম এবং পাশ্চাত্যের খৃস্টান ধর্মের হাজারো নিদর্শনের দেখা মেলে সারা নগরী জুড়ে। আধুনিকতম স্থাপনা যেমন আছে তেমনি আছে হাজার বছরের পুরোনো স্থাপনাও।
ইস্তাম্বুল নগরীর পুরনো অংশ।
ইস্তাম্বুল এবং গ্রীক পৌরানিক উপাখ্যানঃ- দেবরাজ জিউস প্রেমে পড়লেন আরগোস শহরে বসবাসকারী নদীর দেবতা ইনাকুস কন্যা আইও(IO) এর। রানী হেরার রোষানল থেকে আইওকে রক্ষা করতে তাকে সাময়িক ভাবে পাথরে পরিনত করে রাখলেন জিউস।স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেয়ে আইও পেরিয়ে গেলেন অল্প গভীরতার নদী,যা গ্রীক ভাষায় হল বুসফোরোস ( Boos-phoros ) বা আজকের বসফরাস প্রনালী। এরপর আইও জন্ম দিলেন এক কন্যা সন্তান ,নাম কেরোএসা। সমস্ত জলভাগের দেবতা পোসাইডনের ঔরসে কেরোএসার গর্ভে জন্ম নিল পুত্র সন্তান বাইজাস। বাইজাসই হলেন ইস্তাম্বুল নগরীর প্রতিষ্ঠাতা এবং মা কেরোএসার নাম অনুসারে নাম রাখলেন ক্রাইসোকেরাস যা আজ গোল্ডেন হর্ন হিসেবে পরিচিত।
আধুনিক ইস্তাম্বুল নগরী। উচু বিল্ডিং এম্বাসাডার হোটেলের পাশেই নরগ্রীর প্রান কেন্দ্র তাক্সিম স্কোয়ার।
খৃস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো নতুন প্রস্তর যুগ বা নিওলিথিক পিরিয়ড থেকে এশীয় অংশে মানুষের বসবাসের নিদর্শন মিলল ২০০৮ সাল বসফরাস প্রনালীর নীচে দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরী করতে গিয়ে । ৬৫০ খৃস্টপূর্বাব্দে এজিয়ান সাগর তীরের মেগারা থেকে গ্রীক নাবিকেরা জাহাজে করে বেরুচ্ছিলেন নতুন দেশের সন্ধানে। সেই সময়ের প্রথা অনুসারে তারা ডেলফির এপোলো মন্দিরে পুরোহিতের আশীর্বাদ নিতে গিয়ে ভবিষ্যতবানী(Oracle) পেলেন অন্ধদের দেশের উল্টোদিকে বসতি গড়ে তুলতে।
বসফরাস প্রনালীর উপর সেতু। দুই মহাদেশ( ডাইনে ইউরোপ, বামে এশিয়া) এর মধ্যে এ সেতু
এখনকার ইস্তাম্বুলে নোঙ্গর ফেলে নাবিকেরা দেখলেন তিনদিকে সমুদ্র বেস্টিত উচু পাহাড় এবং উর্বর জমি। এর কিছুদিন আগে আরেকদল গ্রীক নাবিক এসে বসবাস করা শুরু করেছিলেন এশীয় অংশে। যারা এ রকম সুন্দর যায়গা ছেড়ে অন্যদিকে বসতি গড়ে তারা তো অন্ধই। সুতরাং ভবিষ্যতবানীতে উল্লেখিত যায়গা বিবেচনা করে বসবাস শুরু করলেন বর্তমানের ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে এবং দলপতি Byzantius এর নাম অনুসারে এ যায়গার নাম রাখলেন বাইজেন্টিয়াম( Byzantium )। খৃস্টপুর্ব প্রথম শতাব্দীতে বাইজান্টিয়াম দখল করে নেয় রোমানরা। রোম সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন ৩২৪ খৃস্টাব্দে এখানে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করে নাম রাখেন নোভা রোমা বা নতুন রোম। কিন্তু সে নাম টেকেনি বেশীদিন। কিছুদিনের মধ্যেই কনস্ট্যান্টিনোপল বা কনস্ট্যানটাইনের নগরী হিসেবেই পরিচিত লাভ করল নগরী।
আধুনিক ইস্তাম্বুল।
উচু সাত পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত এবং তিনদিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা হওয়ায় এ নগরী ছিল শত্রুর হাত থেকে অনেক বেশী সুরক্ষিত। প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় হওয়ার কারনে জলপথ দিয়ে ব্যাবসা বানিজ্য এবং যোগাযোগ ছিল সহজ। তিনদিকে সমুদ্র ঘেরা এ এলাকা হল গোল্ডেন হর্ন। ৩৬১ খৃস্টাব্দে তিন লক্ষ অধিবাসী নিয়ে ইস্তাম্বুল ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম নগরী । মধ্যযুগে ইস্তাম্বুল ছিল ইউরোপের বৃহত্তম এবং সবচে’ সম্পদশালী নগরী।
বসফরাস প্রনালী থেকে তোলা ইস্তাম্বুল নগরীর পুরোনো অংশ গোল্ডেন হর্ন। অন্যতম দরসশনীয় স্থান, নীল বসজিদ বা ব্লু মস্ক, হাজিয়া সোফিয়া, সুলতান মেহমেত স্কোয়ার এখানে অবস্থিত।
৩৯৫ খৃস্টাব্দে রোম সাম্রাজ্য পূর্ব এবং পশ্চিম অংশে ভাগ হয়ে গেলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় ইস্তাম্বুল। নগরীর সুরক্ষায় চারদিকে ঘিরে কনস্ট্যান্টাইন নির্মান করেছিলেন উচু দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টনিয়ানের শাসনকাল ছিল স্বর্নযুগ। তিনি ইস্তাম্বুলে নির্মান করেন সে সময়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গীর্জা হাগিয়া সোফিয়া। তার সময়ে প্রজা বিদ্রোহে এ নগরী ব্যাপকভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয়। নগরীর দেওয়াল ইস্তাম্বুলকে রক্ষা করে এসেছে পার্সিয়ান, গ্রীক এবং আর্মেনিয়ান্ আক্রমন থেকে। মাত্র দুই বার এ দেওয়াল ভেদ করে ইস্তাম্বুলে ঢুকতে পেরেছিল শত্রুরা। ১২০৪ খৃস্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডারেরা লুটতরাজ করে এ নগরী। এরপর ১৪৫৩ সালে অটোম্যান তুর্কীরা দখল করে নেয় এ নগরী।
নগরীর আধুনিক অংশ। প্রায় দুইশ ফুট উচু স্তম্ভ ১৩৪৮ সালে নির্মিত গালাটা টাওয়ার।
তখন কনস্টিন্ট্যান্টিনোপল নাম পালটে নতুন নাম রাখা হয় ইস্তাম্বুল। প্রায় পাচঁশ বছর ধরে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে থাকে ইস্তাম্বুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে অটোম্যান তুর্কীদের । ১৯২৩ সালে মোস্তফা কামাল আতা তুর্কের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠীত হওয়ার পর রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে স্থানান্তরিত হয় আঙ্কারায়। ১ কোটি ৩৬ লক্ষ অধিবাসী এবং প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের আজকের ইস্তাম্বুল তুরস্কের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর পঁচিশতম বৃহত্তম নগরী। (চলবে)।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৫৪