প্রাতঃভ্রমন শেষ করে হোটেলে ফিরে সারাদিনের ঘোরাঘুরির প্রস্তুতি সেরে নিলাম। এ হোটেলের রেস্তোঁরা ছিল ছাদের উপর। আশে পাশের হোটেলগুলোতেও একই ব্যাবস্থা। এটা এখানকার রীতি কিনা কে জানে। ঠিক সময়েই ট্যুর কোম্পানীর গাড়ী হোটেল লবী থেকে তুলে নিল। আরো দু চারটে হোটেল থেকে ট্যুরিস্টদের তুলে নিয়ে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমাদের জড়ো করল সুলতান আহমেত স্কোয়ারের এক কোনে।
আমাদের ট্যুর গাইড শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা জানালেন এখান থেকে পূরাকীর্তিগুলো আমাদের দেখতে হবে পায়ে হেটে। পায়ে হেটে দেখার অনেকগুলো কারন ছিল, তার মধ্যে একটা হল- ট্রাফিক জ্যামের কারনে পায়ে হাটলে তাড়াতাড়ি হবে। পায়ে হাটা গাড়ীর চেয়ে তাড়াতাড়ি? মনে পড়ল মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রজীবনের কথা। তখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমরা। আবুসিনা হোস্টেল থেকে শিক্ষক কর্ম চারীদের কোয়ার্টার গুলোর সামনে দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসা করি।নাক কান গলার অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন স্যার তখন নতুন লাল রংয়ের টয়োটা গাড়ি কিনলেন। স্যার নিজেই গাড়ী চালাতেন কিন্তু গাড়ীর গতি থাকত শম্বুকগতির মতই। কলেজে যাওয়া আসার পথে আমাদের বাস সব সময়েই স্যারের গাড়ী অতিক্রম করে চলে আসত। একদিন নজরে পড়ল স্যার গাড়ীর পরিবর্তে রিকশায় করে কলেজে যাচ্ছেন। কি ব্যাপার? বাবলু ব্যাখ্যা দিল “ বুঝলি না তোরা, আজ স্যারের তাড়া আছে, তাই গাড়ীর পরিবর্তে রিকশা”
এখানকার প্রচলিত নাম সুলতান আহমেত স্কোয়ার যা ইউনেস্কোর(UNESCO) ভাষায় সুলতান আহমেত আর্কিওলজিক্যাল পার্ক এবং তুর্কী ভাষায় সুলতান আহমেত মেয়দানী। এখানকে ভাল ভাবে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে রোমান যুগে। রোমান আমলের হাজার বছর জুড়ে
হিপ্পোড্রোম(Hippodrome) ছিল এ যায়গা। হিপ্পোড্রোমের অর্থ হল ঘোড়দৌড়ের পথ যার উৎপত্তি গ্রীক শব্দ Hippos (ঘোড়া) এবং Dromos (কোর্স বা পথ) থেকে। প্রধানতঃ ঘোড়ায় টানা রথ দৌড়ের মাঠ হলেও খেলাধুলা, সামাজিক , রাজকীয় অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হত হিপ্পোড্রোমে। রোমান, গ্রীক্এবং হেলেনীয় যুগে সম্রাটদের বিকেলের চিত্ত বিনোদন ছিল রথের দৌড় প্রতিযোগিতা। রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নগরীতে গড়ে উঠেছিল হিপ্পোড্রোম। সম্রাট কনস্ট্যানটাইন ইস্তাম্বুলে রাজধানী স্থানান্তর করার পর থেকে এখানকার হিপ্পোড্রোম প্রসার লাভ করলেও , তারও দুইশ বছর আগে সম্রাট সেপ্টিমিয়াসের সময় এ হিপ্পোড্রোম প্রথম চালু হয়।
প্রায় ১৫০০ ফুট লম্বা এবং ৫০০ ফুট চওড়া চারকোনা মুল পথের এই স্টেডিয়ামের চার দিকে ছিল দুই স্তরের গ্যালারী এবং এক লক্ষ দর্শকের ধারন ক্ষমতা ছিল এ স্টেডিয়ামের। । সম্রাটের আসন ছিল পূর্ব কোনে যাকে বলা হত কাথিসমা(Kathisma) ।রাজপ্রাসাদ বা Great Palace থেকে কাথিসমাতে আসার পথ ছিল শুধুমাত্র সম্রাট বা তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য। দৌড়ের পথের আকৃতি ছিল ইংরাজী U অক্ষরের মত। রথ টেনে নিয়ে যেত চারটে করে ঘোড়া। রথ দৌড়ের দল গুলোর নাম থাকত বিভিন্ন রঙ অনুযায়ী লাল, নীল, সবুজ এবং সাদা। প্রতি দল থেকে দুটো করে রথ অর্থাৎ মোট ৮ টি রথ প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। U এর এক প্রান্ত থেকে দৌড় শুরু করে রথ গুলো ঘুরে ফিরে আসত U এর অন্য প্রান্তে। যেখান থেকে রথ গুলো ঘুরে আসত দক্ষিন দিকের সে বৃত্তাংশকে বলা হত Sphendone যার নীচের দিক আজও টিকে আছে। উত্তর দিকে ছিল হিপ্পোড্রোম বক্স যা সাজানো ছিল তামার তৈরী ঘোড়ার চারটি মুর্তি দিয়ে । ১২০৪ খৃস্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় সেগুলো লুট করে নিয়ে যায় ক্রুসেডাররা। ঘোড়ার মুর্তিগুলো এখন ভেনিসের সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকায় রাখা আছে। U এর দুই বাহুর মাঝখানের সরল রেখা হল spine। মিশর থেকে আনা স্তম্ভ ওবেলিস্ক, এবং ডেলফির এপোলো মন্দির থেকে সর্প স্তম্ভ বা Serpent column এনে স্থাপন করা হয় U এর দুই বাহুর মাঝখানে। ব্রোঞ্জ, পিতল এবং পাথরের তৈরী বিভিন্ন দেব দেবতা, রোমান বীর এবং চ্যাম্পিয়ন রথচালকদের মুর্তি দিয়ে সাজানো ছিল হিপ্পোড্রোম। ৫৩২ খৃস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে রথ দৌড়কে কেন্দ্র করে প্রজারা বিদ্রোহ করে যার নাম নিকা বিদ্রোহ। নিকা শব্দের অর্থ হল বিজয়। সম্রাট সে বিদ্রোহ নির্মমতার সাথে দমন করেন। হিপ্পোড্রোমে ৩০,০০০ মানুষকে জবাই করা হয় তখন । বিদ্রোহীরা ব্যাপক ক্ষতি করে হিপ্পোড্রামের। অটোমান তুর্কীরা ইস্তাম্বুল দখল করার পর থেকে গুরুত্ব হারাতে থাকে হিপ্পোড্রোম। কিছুদিন ঘোড়া কেনা বেচার হাট ছিল এখানে। হিপ্পোড্রোমের পাশে নীল মসজিদ তৈরীর সময়ে রোমান সম্রাটের প্রাসাদ এবং হিপ্পোড্রোমের বেশ কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে দশম অটোম্যান তুর্কী সম্রাট সুলাইমানের আমলে হিপ্পোড্রোমের অংশ ব্যবহার করা হয় সুলাইমানিয়া মসজিদ নির্মানে। তুর্কী সম্রাট আব্দুল মজিদের শাসন কালে ১৯০১ সালে জার্মান সম্রাট কাইজার ভিলহেলম ইস্তাম্বুল সফর করেন। কাইজার তুর্কী জনগনকে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ এক ঝর্না উপহার দেন যা হিপ্পোড্রোমের ঠিক উত্তর দিকে স্থাপন করা হয়। সে ঝর্না কাইজার ভিলহেলম ঝর্না হিসেবে পরিচিত।
Sphendone.
রথ দৌড়ের পথ এখন বিলুপ্ত, দেবদেবীর মুর্তিগুলো উধাও অনেক আগে থেকে, সে গ্যালারীও এখন আর নেই। এখন যা টিকে আছে তা হল ১) দেওয়াল ঘেরা ওবেলিস্ক বা কনস্ট্যান্টাইন পোরফাইরোজেনেটাস এর স্তম্ভ ২) মিশরীয় ওবেলিস্ক এবং ৩) সর্প স্তম্ভ বা The Serpent column।
ওবেলিস্কঃ- পিরামিড যুগের মিশরে দেবতাদের মন্দির দুয়ারের সামনে এক জোড়া উচু স্তম্ভ বা ওবেলিস্ক নির্মান করার রেওয়াজ ছিল। ওবেলিস্কগুলো চারকোনা বিশিষ্ঠ পাথরের স্তম্ভ এবং এর চুড়া থাকত পিরামিডের মত ত্রিকোনাকৃতির। ইস্তাম্বুলের হিপ্পোড্রোমের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ওবেলিস্ক । দক্ষিন দিকের স্তম্ভ মিশরীয় ফারাও তৃতীয় থুতমোসিসের সময় কাল খৃস্টপূর্ব ১৪৫০ সালে নির্মিত। কারনাকের মন্দিরের সামনের এই ওবেলিস্ক মিশর থেকে এনে হিপ্পোড্রামে স্থাপন করা হয় সম্রাট থিওডোসিয়াস দি গ্রেট এর আমলে ৩৯০ খৃস্টাব্দে। গ্রানাইট পাথরের তৈরী এই ওবেলিস্কের গায়ে প্রাচীন মিশরীয় সমাধি দেওয়ালের রীতিতে চিত্রলিপি বা Hieroglyphics উৎকীর্ন আছে। সম্রাট থিওডোসিয়াসের কাছ থেকে রথ দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার নেওয়ার দৃশ্য খোদাই করা আছে ওবেলিস্কের পাথরের বেদীতে।
Egyptian Obelisk of Thutmosis (1450 BC)
অন্যটি হল দেওয়াল ঘেরা ওবেলিস্ক বা কনস্ট্যান্টাইন পোরফাইরোজেনেটাসের স্তম্ভ। সুউচ্চ পিতলের পাত দিয়ে মোড়া পাথরের এই স্তম্ভের উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া ছিল। দশম শতাব্দীতে সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন পোরফাইরোজেনেটাসের আমলে হিপ্পোড্রোমে স্থাপন করা হয় এই ওবেলিক্স । এ ওবেলিক্স এর উৎস জানা যায় নি। চতুর্থ ক্রুসেডাররা সোনা ভেবে এর গা থেকে খুঁচে নিয়ে যায় পিতলের পাতগুলো। খুঁচে তুলে নেওয়ার ফলে সৃস্ট গর্তগুলো এই ওবেলিস্কের গায়ে স্পস্টভাবে চোখে পড়ে।
Walled Obelisk or Obelisk of Constantine porphyrigenetus
সর্প স্তম্ভঃ- বাইজেন্টিয়ামকে রাজধানী করার পর তাকে সাজানোর উদ্যোগ নেন কনস্ট্যান্টাইন। তারই অংশ হিসেবে ডেলফির এপোলো মন্দির থেকে এ সর্প স্তম্ভ এনে হিপ্পোড্রোমে স্থাপন করেন সম্রাট। প্যালাসিয়ার যুদ্ধে পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের স্মৃতি স্তম্ভ হিসেবে এটিকে ডেলফির এপোলো মন্দিরের সামনে স্থাপন করা হয় খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। ব্রোঞ্জের নির্মিত এ স্তম্ভ হল পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে উপরে উঠে যাওয়া তিনটে সাপ। স্তম্ভের চুড়া ছিল সাপের মাথার আর তার উপর বসানো পিতলের পাত্র। অস্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সাপের মাথা গুলো এবং পিতলের পাত্র টিকে ছিল। সাপের মাথা গুলো এবং পিতলের পাত্র অজ্ঞাত কেউ কেটে নিয়ে যায়। মাটি থেকে পাঁচ ছয় ফুট গভীর গর্তে বসানো এ স্থম্ভের গোড়ার দিকটা এখন টিকে আছে। খোওয়া যাওয়া সাপের মাথা গুলোর একটি পরে খুজে পাওয়া যায় যা এখন ইস্তাম্বুলের আরকিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
The serpent column.
১৯৮৫ সালে এই যায়গাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বা World Heritage site হিসেবে ঘোষনা করে ইউনেস্কো (UNESCO) (চলবে)