পর্যটন শহরের কারনে কিনা জানিনা ভারাডেরোতে জামা কাপড়ের দাম আকাশচুম্বী।গিন্নীর আবদারে কিউবার স্যুভেনির হিসেবে একটা জামা কিনতে গিয়ে মাফ চেয়ে ফিরে এসেছিলাম। জামার দাম চাওয়া হচ্ছিল আশি ডলার, যা টোরোন্টোতে হবে খুব বেশী হলে ২০ ডলার। অধিকাংশ বড় বড় দোকান সরকারী এবং দোকানগুলোর মধ্যে দামের কোন পার্থক্য নেই।সরকারী দোকান কর্মচারীদের দেখেছি কেমন যেন গাছাড়া ভাব; অর্থাৎ কিনলে কিনুন না কিনলেও কোনো সমস্যা নেই। ব্যাক্তি মালিকানায় ছোট ছোট দোকান চালু হয়েছে কয়েক বছর।এ দোকানগুলো সস্তা এবং এখানে দরাদরির সুযোগ আছে।পর্য্যটন শহর হওয়াতে ব্যাক্তি মালিকানায় গড়ে উঠেছে গিফট শপের মার্কেট। হাতে তৈরী চামড়া, কাঠ বা পাথরের গিফট সামগ্রীর দাম কানাডার তুলনায় বেশ সস্তা।
ডাউনটাউন থেকে বাসে কিছুদুর এগোনোর পর চোখে পড়ল ডানদিকে অল্প উচু পাহাড়ের উপর পুরোনো পাথরের গোলাকার উচু টাওয়ার। বাস থেকে নেমে পড়লাম। মনে মনে ধারনা করলাম এটি একটি অতি পূরাতন পর্যবেক্ষন টাওয়ার যার মাথায় কামান বসিয়ে উপনিবেশের যুগে সশস্ত্র প্রহরীরা নজর রাখত সমুদ্রের উপর, যেমনটি দেখেছি, টোবাগো, সেন্ট জনস বা কুইবেকে। চারপপাশ ঘুরে সে রকম কো্ন ইতিহাসের চিহ্ন পেলাম না, এমনকি কোন কিছু লেখাও নেই টাওয়ারের গায়ে। পাশের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পথে পড়ল লোহা দিয়ে তৈরী দুজন অশ্বারোহীর মূর্তি।টপাটপ বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। এখনকার যুগে ছবি তোলা সহজ এবং সস্তা হওয়ায় ছবি তুলতে কার্পন্য করি না কখনো। ফোকাস, এপারচার ঠিক কররার বালাই নেই, দেখে নিয়ে সাটার টিপলেই হল। এতে শিল্পীর ছবি হয়ত হয় না কিন্তু আমার মত আমজনতার জন্য তা যথেস্ট। পাশের হোটেলে গিয়ে পাথরের স্তম্ভের রহস্য উদ্ঘাটন করলাম। জনৈক ধনাঢ্য ব্যাক্তি স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের যুগে এ স্তম্ভ বানিয়েছিলেন জলাধার হিসেবে, এখন আর তা ব্যবহার হয় না।
ঐতিহাসিক রহস্য সন্ধানে নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম ট্যুরিস্ট বাসে। বাস ধরে এগিয়ে চললাম সমুদ্রের কিনার ঘেষে। ডানদিকে তাকালে যতদুর চোখ পড়ে ততদুর পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগর আর বামে ভারাডেরো। পাম,নারকেল,কেয়া,আম,সমস্ত গ্রীস্মমন্ডলীয় গাছই চোখে পড়ে এখানে ;মনে হয় বাংলাদেশ। অসংখ্য পাম গাছে পুরোনো শুকনো পাতা লেপ্টে আছে গাছের সাথে; বছরের পর বছরের পুরোনো পাতা মরে শুকিয়ে গেলেও তা ঝরে পড়েনি।একে একে রিজার্ভ ফরেস্ট, গলফ কোর্স, মার্কেট প্লাজা পেরিয়ে পৌছলাম উপদ্বীপের শেষ মাথায়। ভারাডেরোর ট্যুরিস্ট বাসে কোনো গাইড থাকেন না ।মাঝে মাঝে বাসের মাইকে স্প্যানিশ এবং ইংরেজীতে অল্প কিছু বর্ননা দেওয়া হয় আশেপাশের এলাকা সম্পর্কে। বাসের কন্ডাক্টর নীজের সীটে বসে ভাড়া, এবং টিকেট নিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করেন।কিন্তু একজন ট্যুরিস্ট গাইড নিজের শহর সম্পর্কে বা দেশ সম্পর্কে যেভাবে পর্য্যটকদের তথ্য দেন তেমনি কাউকে দেখিনি এ বাসগুলোতে। নিশ্চিত সরকারী বেতন, কিংবা অন্য কোনো কারনে কিনা জানিনা কন্ডাক্টরদেরকে তাদের চাকুরীতে যথেস্ট আন্তরিক মনে হয় নি। প্রকৃতপক্ষে শাস্তি এবং পুরস্কারের সুযোগ না থাকলে সেবার মান উন্নয়নের সুযোগ থাকে না।
দুপুরের খাবারের আগে হোটেলে ফিরে এ্সে সানউইং এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধির সাথে কথাবার্তা বলে কিউবার বাকী দিনগুলোর প্রোগ্রাম ঠিক করলাম।বিভিন্ন যায়গা ঘুরেফিরে দেখার অনেক ট্যুর কোম্পানী থাকলেও সবগুলোই সরকারী ফলে মান এবং দাম একই। সানউইং এয়ারলাইন্স বিভিন্ন ট্যুর প্রোগ্রামে কিছুটা ছাড় দিয়ে থাকে মঙ্গল এবং শনিবারে।একদিনের জন্য হাভানা ঘুরে দেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম কানাডা থেকেই। সানউইং’এর ট্যুর প্যাকেজ নেওয়াতে হাভানা ঘুরে দেখার প্রতি টিকেটে আঠারো ডলার সাশ্রয় হল।সাফারী ট্যুর, ডলফিনের সাথে সাতার কাটা, স্কুবা ডাইভি্ং, ইত্যাদি বেশ অনেকগুলো প্যাকেজ ছিল ভারাডেরো থেকে। দ্বীপ দেশ হওয়াতে এদের বনজঙ্গল হিংস্র জন্তু জানোয়ারবিহীন। সেই কারনে সাফারী ট্যুর প্যাকেজে কোন আকর্ষন বোধ করিনি, কিন্তু পরে কানাডা থেকে আসা আমাদের সহযাত্রী মার্ক এর কাছে শুনেছি প্রাগঐতিহাসিক যুগের গুহা , হ্রদ, পাহাড়, বন ইত্যাদি মিলিয়ে এ প্যাকেজ যথেস্ট সুন্দর। তিন প্রদেশের তিন শহর ঘুরে দেখতে নিজেরাই প্রাইভেট ট্যাক্সি ভাড়া করলাম পরের দিনের জন্য। পর্য্যটকদের জন্য ট্যুর কোম্পানীর গাইডেড ট্যুর সবচে’সুবিধার। এর কারন হল কোম্পানীর বাস আকর্ষনীয় স্থান বা স্থাপনাগুলো নিজেরাই ঘুরিয়ে দেখায় এবং কোম্পানীর গাইড জানিয়ে দেন সে দেশ বা স্থান সম্পর্কে।কিন্তু প্রাইভেট ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায় না।
কিউবা বিষুব রেখা অঞ্চলীয় দেশ হওয়ায় অনান্য ক্যরিবিয়ান দেশের মতই সারা বছরের তাপমাত্রা একই রকম; বিশ থেকে তিরিশের মধ্যে ওঠানামা করে।মার্চ এপ্রিল মাসে তাপ কিছুটা কমে এবং এই সময় বাতাসে আর্দ্রতাও কম থাকে, ফলে মার্চ এপ্রিলই কিউবাতে বেড়ানোর সবচে’ ভাল সময়।বছরের সব সময়ই বৃস্টি হলেও জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এর পরিমান বেশী।জুলাই-নভেম্বর মাস এখানকার সামুদ্রিক ঝড়ের সময়ও বটে।কোনো কোনো বছর প্রচন্ড ক্যারিবীয় সাইক্লোন আঘাত হানে কিউবায়। দু’তিন বছর আগে এমনই এক সামুদ্রিক ঝড় ব্যাপক ক্ষতি করেছিলো কিউবাতে, প্রান হারিয়েছিল কয়েকশ’ মানুষ।হোটেলের এক কর্মচারীর কাছে শুনেছি আমাদের হোটেলের সাথে লাগোয়া সমুদ্র সৈকত আগে ছিলো পঞ্চাশ ষাট ফুট অবধি চওড়া। তার অনেকটাই ধুয়েমুছে নিয়ে গিয়েছে সামুদ্রিক ঝড়ে।তাপমাত্রা খুব বেশী না হলেও অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারনে কানাডার মত শীতের দেশ থেকে গিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয় কিউবায়।সাথে করে বেশ কয়েকটা ফুলপ্যান্ট এবং ফুল শার্ট নিয়ে গেলেও সে গুলো পরা নি।
দুপুরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম শহরে। হিকাকোস মার্কেট প্লাজা এখানকার বড় শপিং মল।সুন্দর সাজানোগোছানো আধুনিক প্লাজা।হাভানা সিগারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া বিধায় ঢুকলাম সিগার এবং পানীয়ের দোকানে।সরকারী দোকান হওয়ার কারনে দরাদরী করার সুযোগ নেই। জিনিসপত্রের দাম বেশীই মনে হল।এক ইলেক্ট্রিকের দোকানে গ্রাইন্ডার মিক্সার এবং টোস্টার এর দাম দেখেছিলাম ১০০ ডলারের কাছাকাছি যা টোরোন্টতে ৩০/৪০ ডলারে মেলে। কিউবার যেখানেই গেছি পর্যটক বুঝতে পেরে অনেকে এগিয়ে এসেছে সিগার বিক্রি করতে। বিভিন্ন নাম এবং দামের সিগার মেলে এখানে। কয়েকটা বিখ্যাত সিগারের মার্কা হল কোহিবা,স্পার্টাগাস, রোমিও জুলিয়েট, বেলিন্ডা ইত্যাদি। এর মধ্যে কোহিবা স্প্লেনডিডো সিগার নামকরা কারন কয়েক বছর আগ পর্যন্ত তা শোভা পেত ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ঠোটে।(চলবে)
কিউবার জাতীয় বীর হোসে মার্টির আবক্ষ মূর্তি
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৪৫