চে গুয়েভারা স্মৃতিসৌধঃ- চে কে হত্যার পর কংক্রিটের পাটাতনের উপর শোয়ানো অবস্থায় তার মৃতদেহ দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের দেখানো হয় এবং ছবি তোলা হয়।সে সাংবাদিক দলে বৃটিশ সাংবাদিক Richard Gott,ই ছিলেন একমাত্র ব্যাক্তি যিনি জীবিত অবস্থায় চে’র সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। একজন সামরিক ডাক্তার তার মৃতদেহের হাত কবজি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফরমালডিহাইডে সংরক্ষিত করেন।সে হাত আরজেন্টিনায় পাঠানো হয় হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখার জন্য।
১৯৯৫ সালের বলিভিয়ান সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল Mario Vargas চে’র জীবনী লেখক Jon Lee Anderson, কে জানান যে হত্যা করার পর চে’র মৃতদেহ Vallegrande শহরের বিমানবন্দরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।প্রায় দুই বছর ধরে কয়েক দেশের বিশেষজ্ঞেরা বিমান বন্দরের পাশে অনুসন্ধান চালান। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে কিউবার ভুতত্ববিদ এবং আরজ্জেন্টিনার নৃতত্ববিদদের দল দুটো গনকবরে সাতটি মৃত দেহের কঙ্কাল খুজে পান।এই সাতটি কঙ্কালের মধ্যে একটির হাত না থাকায় সেটিকে চে’র মৃতদেহ হিসেবে ধারনা করা হয়। এই কঙ্কালের দাতের সাথে চে’র দাতের ছাচের মিল পাওয়ার পরই বলিভিয়ার স্বরাস্ট্র মন্ত্রী নিশ্চিতভাবে জানান যে সেটি চে’র কঙ্কাল। চে’র কংকালের পাশে খুড়ে পাওয়া যায় একটি জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে এক প্যাকেট তামাক। চে’ ধরা পড়ার পর তাকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসার সময় হেলিকপ্টার চালক Nino de Guzman, এই তামাক চে’কে দিয়েছিলেন।চে’ এবং অপর ছয়জন কমরেডের কংকালের অবশিষ্ট কিউবায় নিয়ে আসা হয়। যে সান্তা ক্লারা শহরের যুদ্ধে চে’র নেতৃত্বে চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় সেই শহরেই পূর্ন সামরিক মর্য্যাদায় চে’ এবং অপর ছয়জনকে পূনরায় সমাধিস্থ করা হয় ১৯৯৭ সালের ১৭ই অক্টোবর।
স্মৃতিসৌধের কাজ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮৮ সালে রাউল ক্যাস্ট্রো এটি উদ্বোধন করেন। ন্সান্তা ক্লারা শহরের বাইরে ছোট টিলার উপরের এই স্মৃতিসৌধকে স্পায়নিশ ভাষায় বলা হয় Mausoleo Che Guevara েবং ইংরেজীতে Ernesto Guevara Sculptural Complex। এখানে চে’র সাথে তার আরো ২৯ত্রিশ জন্য সঙ্গী বিপ্লবীর সমাধি আছে।চতুস্কোন বিশাল শ্বেত পাথরের বেদীর উপর রয়েছে শ্বেত পাথরের স্তম্ভ এবং দেওয়াল। বাম দিকের দেওয়ালে চে’র জীবনের বিভিন্ন সময়ের ভাস্কর্য্য, যেমন ঘোড়ার চড়া অবস্থায় চে’ ফিদেলের সাথে আলোচনারত চে’ , শিল্প মন্ত্রী হিসেবে কর্মরত চে’ গুয়াতেমালা এবং জাতিসংঘে চে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথের ভাস্কর্য্য ইত্যাদি।
মাঝখানের উচু পাথরের স্তম্ভের উপর চে’র ২২ ফুট উচু ব্রোঞ্জের মুর্তি। মুর্তির দৃস্টি দক্ষিন আমেরিকার দিকে ফেরানো,সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার শ্রমজীবি মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি, তার এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনকে বোঝাতেই এই ব্যাবস্থা। মূর্তির ডান হাতে রাইফেল এবং বাম হাত স্লিং এ ঝোলানো। যুদ্ধের সময় এই ডাক্তার বিপ্লবী যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করতেন। যুদ্ধের সময় যখন তার বাম বাহুতে গুলি লাগে তখন কাছে থাকা ফার্স্ট এইড বক্স এবং রাইফেল এই দুটোকে বহন করা সম্ভব ছিলো না। তিনি রাইফেলকেই বেছে নেন এবং ফার্স্ট এইড বক্স ফেলে রেখে পালান।পাথরের বেদীমূলে লেখা আছে চে’র বিখ্যাত উক্তি” “ "Hasta La Victoria siempre” যার অর্থ হল চুড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত। তিনি তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চাইতেন তার আদর্শের চুড়ান্ত বিজয়। বেদীর উপরের একদম ডাইনের চারকোনা বড় স্তম্ভের উপর খোদাই করা আছে ফিদেলকে লেখা চে’র বিদায়ের চিঠিটি। মূল বেদীর পিছনে রয়েছে উনত্রিশ জন বিপ্লবীর সমাধি এবং শিখা অনির্বান। এই শিখা জ্বালিয়ে সমাধিসৌধ উদ্বোধন করার সময় ফিদেল বলেন “ তারা চে’কে হত্যা করে ভেবেছিল বিপ্লবী হিসেবে চে’র পরিসমাপ্তি ঘটালো। কিন্তু তারা জানত না যে সমস্ত বিপ্লবের মধ্যেই খুজে পাওয়া যাবে চে’কে। ইতিহাসে তার স্থান অলেপনীয়, তার উজ্জ্বল চাহুনি বিশ্বের দরিদ্র মানুষের আশার প্রতীক হয়েই রইবে অনন্তকাল ধরে"। মূল স্থপতি ছাড়াও পাঁচ লক্ষ মানুষ স্বেচ্ছা্য চার লক্ষ ঘন্টা কাজ করেন এ স্মৃতি সৌধ গড়ে তুলতে।এ সৌধ উদ্বোধনের সময় সান্তা ক্লারা এবং হাভানায় একুশবার তোপধ্বনি করা হয়।
চে’ যাদুঘর রয়েছে বেদীর ঠিক নীচে যার প্রবেশমুখ ম্যুজোলিয়ামের পেছন দিক থেকে।এ যাদুঘরে কোন প্রবেশমূল্য নেই কিন্তু ছবি তোলার অনুমতি নেই। এখানে চে’র ব্যবহৃত সামগ্রী যেমন কাপড় চোপড় ,পাইপ, তার রচনার পান্ডুলিপি, অসংখ্য ছবি, এমনকি গেরিলা যুদ্ধ থাকা কালীন সময়ে ছদ্মবেশে ব্যাবহৃত নকল দাড়ি পর্যন্ত রয়েছে। ইতিহাসের অমর বিল্পবীর মূর্তির সামনে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বেরিয়ে এলাম সমাধিসৌধ থেকে।(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৮