somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সক্রেটিসের দেশে ( সপ্তম পর্ব) ।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রোপাইলিয়ন থেকে আরো কয়েকটা সিড়ি বেয়ে গিয়ে উঠলাম এক্রোপলিসের চুড়ায়। চুড়া এলাকা প্রায় সমতল অর্থাৎ এটি একটি ক্ষুদ্র মালভূমি। মাত্র সাত একর আয়তনের এই জায়গাতেই গড়ে উঠেছিলো এক্রোপলিসের মূল স্থাপনাগুলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধবিগ্রহে সবগুলোই এখন আংশিক অথবা পুরোপূরি ধ্বংশপ্রাপ্ত। প্রোপাইলিয়ন থেকে পার্থেননের মাঝখানের পথের ডান দিকে ছিল এথেনা নাইকির মন্দির।এখন মন্দিরটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি পাথরখন্ড। গ্রীক মিনিস্ট্রি অফ কালচারের সাইনবোর্ড থেকে অতীতে এখানে মন্দিরের অবস্থান বোঝা যায়। কিছুটা এগিয়ে এথেনা নাইকির মন্দিরের উলটো দিকে অর্থাৎ চলার পথের বামদিকে বেদীর উপর স্থাপিত ছিল এথেনা প্রোমাকসের ৯ মিটার উচু মূর্তি। এথেন্স বাসীরা বিশ্বাস করত যে ৪৮০ খৃস্টপূর্বাব্দের পারসিয়ান যুদ্ধে দেবী এথেনা তাদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। শোনা যায় যে দ্বিতীয় পারসীয়ান যুদ্ধের একদিন আগে এথেন্সবাসীরা এথেনার প্রতীক পেঁচাকে যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখেন। দেবী এথেনা তাদের সাথে যুদ্ধ করছেন, এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তারা নতুন উদ্দমে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে। মাত্র ৪০টি জাহাজ হারিয়ে পার্সিয়ানদের দুইশত জাহাজকে ধংস করতে সক্ষম হয় তারা। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় পারসীয়ানরা। পারসিয়ান যুদ্ধের পর প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল এথেন্সে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছিল। এই সময়ে এথেন্স শাসন করেন সে যুগের সর্বস্রেষ্ঠ রাস্ট্রনায়ক সম্রাট পেরিক্লিস। দেবী এথেনাকে সম্মান জানাতে পেরিক্লিস এথেন্সের এক্রোপলিসে দেবদেবীর মন্দির এবং অনান্য স্থাপনা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন। পেরিক্লিসের সময়ে এথেন্সে গনতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা চালু ছিল এবং সমস্ত গুরত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত ভোটের মাধ্যমে নেওয়া হত। ভোট দেওয়ার অধিকারী ছিল প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন পুরুষ নাগরিকেরা। মহিলা এবং দাসদের ভো্টাধিকার ছিলো না। সে সময়ের এথেন্সের পাঁচ লাখ অধিবাসীর মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার ব্যাক্তি ভোট দিতে পারতেন। ভোটাভুটির পদ্ধতি ছিল যে ভোটাররা একটা পাত্রে সাদা অথবা কালো পাথর রাখতেন। সাদা পাথর ছিল "হ্যাঁ" এবং কালো পাথর ছিল "না" ভোট। ভোটাভুটিতে হেরে যান পেরিক্লিস।সম্ভবতঃ এথেন্সের নাগরিকেরা এ স্থাপনা গুলোর বিপূল ব্যায়ের কথা চিন্তা করে না ভোট দেন।সম্রাট পেরিক্লিস নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলে পুনরায় ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়। এবার পেরিক্লিস জয়লাভ করেন। কি পরিমান ব্যয় হয়েছিল এ নির্মানযজ্ঞে তার একটা ধারনা মেলে সে সময়ের লেখা থেকে। শুধুমাত্র পার্থেনন বা দেবী এথেনা পার্থেনোসের মন্দির নির্মান করতে খরচ হয়েছিল ৪৪ "ট্যালেন্ট"। এক ট্যালেন্ট ছিল ৫৭ পাউন্ড সোনার সমান এবং সে সময়ে এক "ট্যালেন্ট" দিয়ে একটি যুদ্ধজাহাজ নির্মান করা সম্ভব ছিল।
পেরিক্লিসের নির্দেশে সে সময়ের খ্যাতনামা ভাস্কর ফিডিয়াস নির্মান করেন এথেনা প্রোমাকোসের ব্রোঞ্জ মূর্তি। মূর্তির ডান হাতে ছিল বর্ষা এবং তার ঢালের উপর সেন্টরোম্যাকি(সেন্টর এবং লাপিথের যুদ্ধ) 'র দৃশ্য খোদাই করা ছিল।তার বর্ষার ফলক এবং মাথার মুকুট ৪৩ মাইল দুরের সোইউনিয়ন অন্তরীপ থেকে নাবিকদের চোখে পড়তো। ৫ম খৃস্টাব্দে রোমান আমলে এ মূর্তি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে স্থাপন করা হয় কন্সট্যান্টিনোপলের হিপ্পোড্রোমে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডাররা লূট করে নিয়ে যায় মূর্তিটি।
এগিয়ে চললাম পারথেননের দিকে।এক্রোপলিসের ছোট্ট যায়গায় তখন প্রচুর ট্যুরিস্ট যাদের অধিকাংশই সাদা বা ককেশীয়ান। উপমহাদেশীয় চেহারার লোকজনের দেখা পাওয়া দুস্কর। হঠাৎ চোখে পড়ল শাঁখা সিন্দুর পরা তরুনী বৌ এবং পাশে তার স্বামী দাঁড়িয়ে। স্বামী স্ত্রী অদলবদল করে হাত পালটে একজন আরেকজনের ছবি তুলছে। মনে মনে ধরে নিলাম যে এরা হল নতুন বিয়ে করা বাংগালী দম্পতি, হানিমুনে এসেছে এবং পাশাপাশি দুজনের ছবি তুললে ভালো মানাবে। জিজ্ঞেস করলাম আমি তাদের কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা। সানন্দে আমার হাতে ক্যামেরা দিয়ে দুজনে দাঁড়িয়ে গেল পার্থেনন এবং অন্যান্য পূরাকীর্তির সামনে। টপাটপ গোটা দশ বারো ছবি তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "পশ্চিমবঙ্গ না বাঙ্গলাদেশ?" উত্তর দিল ওরা কোলকাতার কিন্তু থাকে ইংল্যান্ডে। পশ্চিমবঙ্গের হলেও বাংগালী তো বটে।এবার বাঙ্গলায় বললাম " আমার খান কতক ছবি তুলে দেয়ন যায় কিনা? এবার আর তাদের না বলার উপায় ছিলো না। নিজের ছবি তোলার এ বুদ্ধি ভালই কাজে লাগে। কোরিয়া, চীন এবং মালয়েশিয়া ভ্রমনে সেলফী দন্ড ব্যাবহার করেছিলাম নিজের ছবি তুলতে কিন্তু ছবি গুলো আশানুরুপ না হওয়ায় একান্ত বাধ্য না হলে সেলফী দন্ড এখন আর ব্যবহার করি না। অনেকটা ধংশ হয়ে গেলেও এক্রোপলিসে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বড় স্থাপনা হল ইরেকথিয়ন এবং পার্থেনন।এক্রোপলিসের সমস্ত স্থাপনা গুলোই নির্মিত হয়েছিল প্যান্টেলিক শ্বেতপাথর দিয়ে। এথেন্স থেকে ১৪ মাইল দুরের প্যান্টেলিয়া থেকে আনা হত সে পাথরগুলো। শ্বেত পাথর ব্যবহার কারন হল যে সাদা হল শান্তির প্রতীক।
ইরেকথিয়নঃ- প্রোপাইলিয়নের ভেতর দিয়ে উঠে আসা রাস্তা বেয়ে এগিয়ে গেলে বা দিকে পড়ল ইরেকথিয়ন। ইরেকথিয়নের অর্থ হল ইরেকথিয়াসের স্থান। এটি এক্রোপোলিসের উত্তর দিকের অংশে। রাজা ইরেকথিয়াস ছিলেন এথেনার পালিত পুত্র। দেবরাজ জিউস ক্রোধান্বিত হয়ে বজ্রনিক্ষেপ করে রাজা ইরেকথিয়াসকে হত্যা করেন। তার নিক্ষিপ্ত বজ্রের ফলে সৃস্ট গর্ত আজও দেখা যায় ইরেকথিয়নের মেঝেতে। উত্তর থেকে দক্ষিনে চল্লিশফুট লম্বা এ মন্দিরের তিনটি অংশ এবং এর সামনের দিক পূর্ব দিকে। প্রবেশপথ ছিলো উত্তর দিকের ঘর দিয়ে। মাঝখানের বড় হলঘরের এক অংশ সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের। কে হবেন নগরীর রক্ষাকর্তা সে প্রশ্নে এথেনা এবং পোসাইডনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। ত্রিশুল দিয়ে পাহাড়ে আঘাত করে এথেন্সবাসীদের লবনাক্ত জলের ফোয়ারা উপহার দেন পোসাইডন। এ ফোয়ারা এবং পোসাইডনের বেদীর অবস্থান মন্দিরের এক অংশে। অন্য অংশ এথেনা পোলিয়াসের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এথেন্সবাসীর জন্য এথেনার উপহার জলপাই গাছটি ছিল এথেনার অংশে। প্রাচীন গাছটি মরে যাওয়ার পর একটি নতুন জলপাই গাছ লাগানো হয়েছে এখানে।এ মন্দিরের সবচে' উল্লেখযোগ্য অংশ হল দক্ষিনের ছোট ঘরটি। এর বারান্দায় রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভ একজন কুমারীর মূর্তি। এ বারান্দার নাম "Porch of the caryatids"। গ্রীক শব্দ ক্যারিয়াটিডের অর্থ হল ক্যারিয়ার কূমারী।এথেন্স থেকে চল্লিশ মাইল দূরে পেলিপনেসিয়ার এক গ্রামের নাম ক্যারিয়া।প্রতিটা মূর্তিই হল এক একটা ক্যারিয়াটিড । বাৎসরিক প্যানএথেনিয়ান উৎসবের মিছিল এসে শেষ হত ইরে্কথিয়নে। দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু বলি দেওয়া হত বেদীগুলোতে। উৎসব শেষে ভোজের আয়োজন করা হত এবং বিবাহযোগ্যা কুমারী মেয়েরা বেছে নিত তাদের জীবনসঙ্গীকে।(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×