somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সক্রেটিসের দেশে ( অস্টম পর্ব) ।

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পারথেননঃ- এথেন্সের এক্রোপলিসে প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হল পারথেনন। এটি তৈরী করা হয়েছিল এথেন্সের রক্ষাকর্তা দেবী এথেনা পারথেনোসের মন্দির হিসেবে। পারথেননের আভিধানিক অর্থ হল পারথেনোস বা কুমারীর গৃহ। বর্তমানের পারথেননের স্থানে এথেনা পারথেনোসের আগের পুরানো পারথেনন বা প্রিপারথেনন মন্দিরকে ৪৮০ খৃস্টপূর্বাব্দে ধ্বংশ করে ফেলেছিল পারসীয়ানরা। সম্রাট পেরিক্লিস ৪৪৭ খৃস্টপূর্বাব্দে প্যানএথেনিয়ান উৎসবের দিনে এক্রোপলিসের দক্ষিন অংশে এ মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। নয় বছর ধরে স্থপতি ক্যালিক্রেটিস এবং ইকটেনাসের তত্বাবধানে গড়ে উঠেছিল এই সুবৃহৎ মন্দির। ৪৩৮ খৃস্টপূর্বাব্দে মূল ভবনের কাজ শেষ হলেও মূর্তি এবং অন্যান্য ভাস্কর্য্য স্থাপন এবং অলঙ্করনের কাজ চলেছিল ৪৩২ খৃস্টপূর্বাব্দ অবধি। সম্পূর্ন শ্বেত পাথরে তৈরী আয়তাকার এই মন্দির ভূমিতে ছিল দুইশ ফুট লম্বা এবং একশ' ফুট চওড়া। পাঁচ ছয় ফুট উচু পাথরের চারকোনা ভিত্তির উপরে চারপাশ ঘিরে তৈরী করা হয়েছিল উচু স্তম্ভের সারি। লম্বা দিকে ছিল সতেরটি এবং চওড়ার দিকে ছিল আটটি স্তম্ভ যা টিকে আছে অথবা পূননির্মান করা হয়েছে। স্তম্ভগুলো চল্লিশ ফুটেরও বেশী উচু। ভেতরের চওড়ার দিকে দুই সারিতে ছিলো আরো দুই সারি স্তম্ভ। স্থাপত্যের ভাষায় এ মন্দিরের বেশীর ভাগ ছিল ডোরিক স্টাইলের এবং কিছু অংশ তৈরী করা হয়েছিল আইওনিক স্টাইলে। স্তম্ভগুলোর উপর বসানো ছিল ত্রিভুজ আকৃতির উচু ছাদ। এই মন্দিরের কার্নিশের দেওয়ালে খোদাই করা ছিল বিভিন্ন গ্রীক পৌরানিক দৃশ্যাবলী যেমন অলিম্পিয়ান দেবতা এবং দানবদের যুদ্ধ, জিউসের মাথা থেকে দেবী এথেনার জন্ম, ট্রয়ের যুদ্ধ ইত্যাদি । কিছু ভাস্কর্য্য রাখা আছে পাশের নিউ এক্রোপলিস মিউজিয়ামে, কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে চোরেরা এবং কিছু অংশ আজও টিকে আছে পারথেননে। ভেতরের কক্ষে ছিল ডিলিয়ান লীগের কোষাগার এবং এথেনা পারথেনোসের মূর্তি। ফিডিয়াসের তত্ববধানে হাতীর দাঁত ও সোনা দিয়ে তৈরী এ মূর্তি ছিল পুরো পারথেনন মন্দিরের চেয়ে দামী। চল্লিশ ফুট উচু এ মূর্তিতে ব্যবহার করা হয়েছিল এগারোশ' কিলোগ্রাম সোনা।প্যান এথেনিয়ান উৎসবে কুমারী মেয়েরা স্নান করে পূত পবিত্র হয়ে দেবী এথেনার মূর্তিতে নতুন গাউন বা Peplos পরিয়ে দিত। এথেনার সে মূর্তি চুরি হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। পারথেননের ভেতরের ঘর গুলোতে এখন স্থপতিরা এবং ইঞ্জিনিয়ারেরা পূনঃনির্মান কাজে ব্যাস্ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মন্দিরে যেখানে পূজারীরা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেতেন সেখানে পারথেনন মন্দিরে পূজারীদের পূজো করতে হত বাইরে থেকে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়বৃস্টি , বজ্রপাত, ভূমিকম্প, অন্যদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, চুরি, লুটপাট ইত্যাদির কবলে পড়ে পার্থেনন এসে দাড়িয়েছিল ধংশের দ্বারপ্রান্তে। রোমানরা এথেন্স দখল করার পর দেবী এথেনার রোমান সংস্করন অনুসারে তারা নাম দিয়েছিল দেবী মিনার্ভার মন্দির। খৃস্ট ধর্ম প্রসারের পর পারথেননকে গীর্জা বানানো হয় এবং অটোম্যান তূর্কীরা এথেন্স দখল করার পর এটিকে মসজিদ বানায়। ১৬৭৮ সালের ভেনেসীয় যুদ্ধে কামানের গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পারথেনন, মন্দিরের ছাদ এবং উপরের দেওয়াল উড়ে যায়। অটোম্যান তূর্কীদের কাছ থেকে কিছু ভাস্কর্য্য কিনে(?) নিয়ে যান বৃটিশ রাস্ট্রদুত লর্ড এলগিন যা এখন বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
ভাবতে অবাক লাগে যে প্রাচীন গ্রীসে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীকরা কি পরিমান মেধা এবং শ্রম ব্যায় করেছিল এ মন্দির গড়তে। সম্পূর্ন শ্বেত পাথরে তৈরী এ মন্দিরের পাথর আনা হত ষোল কিলোমিটার দুরের প্যান্টেলিয়াম পাহাড় থেকে। পাঁচ থেকে বারো টন ওজনের পাথরের ব্লক কেটে এনে সে গুলোকে নির্দিস্ট আকারে তৈরী করা হত এক্রোপলিসে। একটার পর আরেকটা বসিয়ে তৈরী করা হয়েছিল ভিটে, দেওয়াল এবং স্তম্ভগুলো। মোট কুড়ি হাজার টন ওজনের, সত্তর হাজার ভিন্ন ভিন্ন আকারের পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছিল এ মন্দির। পারথেননের টিকে থাকা অংশগুলো এখন ঝুকির সম্মুখীন। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে সংরক্ষনের চেস্টা করা হয়েছিল তাতে এ মন্দিরটি আরো বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে পারথেনন এর টিকে থাকা অংশ গুলো সংরক্ষন করে পুনরায় নির্মান করার চেস্টা শুরু হয় যা আজও চলছে। যে মন্দির নির্মিত হয়েছিলো নয় বছরে তার পুনঃ নির্মান কাজ ত্রিশ বছরেও শেষ করা সম্ভব হয় নি। আমেরিকা, বৃটেন, গ্রীস প্রভৃতি দেশের বিশেষজ্ঞেরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন UNESCO ঘোষিত এই প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষনাবেক্ষন এবং পূনর্নির্মানে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারথেননের আকারে নির্মান করা হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ন ভবন যার মধ্যে ফরাসী পার্লামেন্ট,আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট, বৃটিশ মিউজিয়াম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নির্মান কাজ চলতে থাকায় এখন পারথেননের ভেতরে ঢোকা নিষিদ্ধ।
পারথেননের পূব দিকে রোমানরা নির্মান করেছিল সম্রাট অক্টাভিয়া অগাস্টাসের মন্দির। এক্রোপলিসে রোমানদের তৈরী এই মন্দিরে সম্রাটের উপাসনা করা হত। সম্পূর্ন ধ্বংশপ্রাপ্ত এ মন্দিরের সীমানার দু'তিন ফুট উচু কয়েকটি স্তম্ভ ছাড়া কিছুই আর অবশিস্ট নেই। পারথেননের পূব পাশে পাহাড়ের কিছুটা উচু অংশ থেকে দেখা যায় দূরে পাহাড়ের উপর রোমান আমলে নির্মিত গীর্জা। এ পাহাড়ের নাম লিকাবেটোস পাহাড়। পারথেননের দক্ষিনে পেছনের দিকে নীচে তাকালে চোখে পড়ে ডায়োনিসসের থিয়েটার এবং তার থেকে কিছুটা দূরে প্লাকা, এবং তার থেকেও দূরে অলিম্পিয়ান দেবরাজ জিউসের মন্দিরের ধংশাবশেষ। প্রোপাইলিয়নে যাওয়ার পথের উচু সিড়ির উপর থেকে পশ্চিমে তাকালে চোখে পড়ে প্রাচীন আগোরা এবং আরেকটু দূরে বিশ্বকর্মা দেবতা হেফেস্টাসের মন্দির। এক্রোপলিস দেখা শেষ করে সিড়ি বেয়ে প্রোপাইলিয়ন দিয়ে নেমে চললাম আগোরার দিকে (চলবে)।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×