এটি আমার জীবনের সর্বপ্রথম ছোটগল্প লেখার দুঃসাহস
স্নিগ্ধা ও শরীফ – প্রবাসে তাদের ছোট্ট একটি সাজানো সংসার। সাথে তাদের দুটি ছোট্ট ছানা পোনা। সব সংসারেই যেমন হাসি-কান্না, টানা-পোড়ন লেগে থাকে তাদেরও তা থেকে ব্যাতিক্রম নয়। স্নিগ্ধা অপরূপা সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি এবং কথাবার্তা আর চালচলনেও ব্যাপক মার্জিত। শরীফ আবার ঠিক তার উল্টোঃ বদমেজাজী, একরোখা আর দেখতেও তেমন সুবিধার নয়। তার উপর আবার আছে বেফাসে মুখ ফুটে সত্যি কথা বলে দেবার বদভ্যাস। কার তাতে আঁতে ঘা লাগলো আর কার তাতে না এটা বোঝার মতন বোধ শক্তি সম্ভবত কোখনোই তার হবে না। আবার যেকোনো সুন্দর একটি গান কিংবা কবিতাকে আশ্লীল প্যারোডি বানানোতেও সে ভীষণ ওস্তাদ। শরীফের এই বদভ্যাসের জন্য তার মাতুল কুল আর শশুর কুলের কেউই আর তাকে দু চোখে দেখতে পারে না। আর এ নিয়েও স্নিগ্ধা আর শরীফের মধ্যে প্রায়ই খটাখট লেগেই থাকে।
তারপরেও শরীফ পাগলের মতন স্নিগ্ধা আর তার দুই ছানা পোনাকে ভালোবাসে। কিন্তু তা সে ঠিক মতন এক্সপ্রেস করতে পারে না। শরীফের মধ্যে এমন কোনো আলগা রোমান্টিসিজম ও নাটকীয়তা নেই যে ভ্যালান্টাইন ডে তে বিশটি লাল গোলাপ নিয়ে হাটু গেড়ে প্রয়সীর সামনে বসে ভাঙ্গা রেকর্ডের মতন জপতে থাকবে, “ভালোবাসী, ভালোবাসী”। উল্টো হয়তবা ভালোবাসী এর বাসী জায়গায় অন্য কোনো একটি বাংলা শব্দ জুড়ে দেবে যা ভদ্র সমাজে হয়তোবা মুখ ফুটে বলা যাবে না। কিন্তু তার ভালোবাসা অন্যরকম, এই যেমন- সকালে নাস্তা বানানোর সময় হয়তোবা দুজনের জন্যই ডিম পোচ করলো। একটি হয়তোবা দেখতে একটু এবড়ো থেবড়ো হল কিংবা লবণ বেশী হলো। সে নেবে সেই খারাপ ডিম পোচটি। অথবা এই তো সেদিন, স্নিগ্ধা আর শরীফ যখন উইকেন্ডে দুপুরে খেতে বসলো, তখন দেখা গেলো কাজের চাপে তারা কেউই সেদিন রান্না করতে পারে নি, তাই আগের দিনের ভাবীর বাসায় দাওয়াত থেকে ফেরার পথে সাথে দিয়ে দেয়া বিরিয়ানীর বাক্স খুলে দেখা গেলো যে শুধু একজনের খাওয়ার পরিমাণই আছে, তখন শরীফ ঠোট উল্টে বললো, “আমি ওই জঘন্য জিনিষ মুখেও তুইলাও দেখুম না”। স্নিগ্ধা প্রচন্ড রাগ করলেও শরীফ কিন্তু তাকে বুঝতে দিলো না যে সে আসলে স্নিগ্ধাকে রেখে খেতে পারবে না, আর তাই বেকুবটা বিশাল ঝগড়া বাধিয়ে বসলো।
তেমন কিছু একটাও আজকে তাদের মধ্যে চলছিলো। কিন্তু তারপরেও শরীফ ঠিক করে রেখেছিলো আজকে সে তার বিখ্যাত খিচুড়ী আর মুরগীর কোরমা রান্না করবে স্নিগ্ধার জন্য। কে যেনো একবার তাকে বলেছিলো, পুরুষ মানুষের ভালোবাসা থাকে তাদের পেটে, তাই বেকুবটা তার ভালোবাসা জানানোর পন্থা ঠিক করে ফেললো খাওয়া দাওয়ার মতন একটা স্থূল ব্যাপার এর মধ্যে। আজকেও একটি উইকেন্ডের দিন। সকাল থেকেই মনে মনে অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করে রেখেছে। স্নিগ্ধাকে কিছুই বুঝতে দেয় নি। এরমধ্যে গায়ে পড়ে একটু ঝগড়াও করে নিয়েছে, ঘটনাকে একটু স্পাইস আপ করার জন্যে। দুপুরে যখন হটাৎ স্নিগ্ধা এসে বললো যে ওর এক বান্ধবী, চৈতি ফোন করেছে বিকেলে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য তখন শরীফও ভাবলো এই সুযোগ, স্নিগ্ধাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। ভং ধরে বললো, “তুমি যাও বাচ্চাদের নিয়ে, আমার কিছু কাজ আছে”।
স্নিগ্ধা তার গাড়ী নিয়ে চলে যেতেই শরীফ বেরিয়ে পড়লো। বুচার শপ থেকে টাটকা মুরগী আর কলিজা কিনে নিয়ে এসে শুরূ করলো রান্না-বান্না। ম্যানু হচ্ছে, ছাত্র অবস্থায় পরিস্থিতিরে শিকার হয়ে শেখা তার সেই কিংবদন্তিতে রূপ নেয়া কোরমা আর ভুনা খিচুড়ি। খুব যত্ন নিয়ে এক এক করে তেল গরম করা, মাঝখানে ফেড়ে টেসকোর রকেট চিলি গরম তেলে ছেড়ে দিয়ে ভাজা ভাজা করে যেনো ঝাল চলে যায় কিন্তু ফ্লেবারটা থাকে, পরম যত্নে বেরেস্তা ভাজা এমন আরো কত কি!! ঠিক পচাত্তর মিনিত লাগে তার রান্না শেষ হতে। তারপর কিচেন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে যেই সবকিছু শেষ করেছে তখনই স্নিগ্ধার ফোন। বললো,
“এই শুনো, চৈতি তো আজকে রাতে না খেয়ে আসতে দিচ্ছে না, কি আর করবো বলো? তুমি একটা কিছু খেয়ে নিও”।
মিনমিন করে “ঠিক আছে, আচ্ছা রাখি বলে” শরীফ ভ্যাবদা মেরে কিছুক্ষন বসে রইলো। কখন যে তার চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো তা সে টেরই পেলো না। মিনিট দশেক পরে রান্না করা পুরোটা কোরমা আর ভুনা খিচুড়ী ফুড বিনে ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠলো,
“আল্লাহ, আমগো লাহান ফহিন্নির পুতেগো গিলা কইলজায় এতো মহাব্বত দিতে গেছিলা ক্যারে????”