২০০৬ সালে যখন দেশ ছাড়ি তখন আমার আব্বা আমাকে দুটি জিনিস দিয়েছিলেন। প্রথমটি একটি পার্কার কলম আর দ্বিতীয়টি একটি উপদেশ। আব্বা বলেছিলেন, "বাবারে বিদেশে যাচ্ছ তাই মনে রেখো, যখনই তুমি বিদেশের মাটিতে পা দিবে তখন তুমি শুধু তুমি নও, বরং তুমি তোমার দেশের একজন এম্বাসেডর। এমন কিছু বলবেনা বা করবেনা যেন বিদেশিরা তোমার দেশ সম্বন্ধে কোনো নেগেটিভ বা ভুল ধারণা পায়।" গত দশটি বছর ধরে আব্বার এই দুই অমূল্য উপহার আমি যক্ষের ধনের মতন আঁকড়ে ধরে আছি।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবারে একটি মজার অভিজ্ঞতা হলো। সেদিন নিমন্ত্রণ ছিল আরেকটি বৈশাখী উৎসবে। বোদ্ধাজন মাত্রই সকলেই জানেন আমাদের বৈশাখী কিংবা বর্ষবরণ উৎসব একটি খাঁটি বাঙালি, মতান্তরে বাংলাদেশী উৎসব। এবং বরাবরের মতন তাই হয়ে এসে থাকলেও মাঝে মাঝে প্রবাসী কিছু গণ্ডমূর্খদের আড্ডায় হিন্দি অশ্লীল সংস্কৃতির আগ্রাসন দেখা যেত। যেমন বছর খানেক আগে ইস্টলন্ডনের বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনের পরপরই ভারতের বাপ্পি লাহিড়ী স্টেজে উঠেই অর্ধনগ্ন নর্তকীদের সাথে উলালা উলালা শুরু করে দিলে স্টেজের পাশের মূর্খ আত্মপরিচয়হীন তথাকথিত বাঙালিদের উদাম নৃত্য নাচতে দেখা যায়। অবশ্য বেচারা বাপ্পিকেও দোষ দিয়েই বা কি হবে??? পশ্চিমবঙ্গ তো আর আমাদের মতন স্বাধীন নয়, তারা যে পরাধীন !!!!
যাকগে সেসব আজেবাজে কথা, গত দশ বছর ধরে বিভিন্ন বাংলাদেশী অনুষ্ঠানে হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসন চোখে পড়লেও আমাদের প্রাণের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিলো এসব নোংরামিমুক্ত। আজকের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি আমার জানামতে উন্নত রুচির এবং প্রবাসে বাংলা সাহিত্যের অগ্রুদূতদের আয়োজিত বিধায় যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু হায়!!!! কে জানতো আমার জন্যে বড় একটি ধাক্কা অপেক্ষা করছে। অনুষ্ঠানে সংগীতের আয়োজনে একজন ডিজে এবং তিনি উচ্চস্বরে বাজাচ্ছেন অশ্লীল চটুল ভারতীয় সংগীত। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে আমার অতি পরিচিত রূচিবান স্বজনদের তাতে কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না!!!!
একজন শ্বেতাঙ্গিনী ডিজে হয়তোবা নাই জানতে পারেন বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী সংস্কৃতি কি, কিন্তু তাকে জানানোর দ্বায়িত্ব কি ওই অনুষ্ঠানের কারোই ছিলো না??? যদি নাই থাকে, আমার পরিচিত স্বজনরা তো জানেন যে আমার এই ব্যাপারে "বিশেষ চুলকানি" আছে। জেনেশুনেও তারা কেন আমাকে এমন একটি কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করলেন???? আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে বিদেশ বিভূঁইয়ে বেড়ে উঠা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমরা কি শিক্ষা দিচ্ছি??? সবচেয়ে মজার প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয়রা কি এতটাই দুর্বল যে আমাদের সংস্কৃতির প্রধান একটি উৎসবে নিজেদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অশ্লীল উত্তরভারতীয় সংস্কৃতিকেই প্রমোট করতে হবে??? অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাদের তো এতটুকু জানার কথা ছিলো যে আমি এহেন নির্লজ্জ্ব ও বেহায়াপনা দেখে অবশ্যই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবো!!!!
হয়েছেও তাই, কিন্তু এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর আগে আমি যতবারই রিয়েক্ট করেছি, ততবারই আমি ছিলাম একা। কিন্তু এবার আমার সাথে ছিলো আমার মেয়ে আরীশা। যখন শুধুমাত্র বাংলাকেই পাশ কাটিয়ে ওই অনুষ্ঠানে অশ্লীল চটুলগানের মচ্ছব শুরু হলো, আমার মেয়েটি তখন আমার কাছে এসে বললো যে সে এটার কোনো অংশ হতে চায় না। আমার কলিজাটা ফুলে এত্তবড় হয়ে উঠলো যখন দেখলাম আর তিন বছরের ছোট্ট ছেলে আরশানও গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে আমার কোলে উঠে বসলো। দুটি ছোট বাচ্চার কাছে তথাকথিত বাংলা সাহিত্যের ধজ্বাধারীদের নির্লজ্জ পরাজয় দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠলো। এতদিন আমি ছিলাম একা কিন্তু আজ আমরা তিনজন। খুব শীঘ্রই আমরা হবো নয়জন, তারপর একাশিজন এবং জ্যামিতিকহারে আরো অগণিত!!!! আফসোস আমরা হতে পারতাম চার থেকে ষোলো কিংবা ২৫৬ কিংবা ততোধিক। কিন্তু এইবা খারাপ কি??? আমরাই যথেষ্ট এইসব ভন্ডদের মুখোশ খুলে দিতে!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:১৯