আমাদের সময়গুলোতে আমরা এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছ থেকে বই ধার করে পড়তাম। সে অনেক আগের কথা পুরোনো স্মৃতী, একটা আত্মজীবনী লিখছি সেখানে আরও বিস্তারিত লিখবো এ নিয়ে, এখন বর্তমান বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলি। আমাদের সময়ে এতো এতো পাঠ্যপুস্তক, ব্যাগ ভারী করা বইয়ের চাপ ছিলোনা এবং মোবাইল ফোনও ছিলোনা, অনেকের আমলেই ছিলোনা, কারণ ব্লগে অনেক সিনিয়র ভাই বোন আছেন যারা । কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক কিছুই আছে।
প্রসঙ্গ দুটো উঠানোর কারণ হলো, বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের স্কুল গুলোতে পড়াশোনার ব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তকের যা হাল তা বিস্ময়কর। যে পরিমান পাঠ্যপুস্তক দেয়া হয় তাতে করে একজন ছাত্র বা ছাত্রী সিলেবাসের পড়ার পরে আর কোনো অতিরিক্ত সময় থাকেনা। ব্যাগের ভারেই তো বাচ্চারা পিঠ সোজা করতে পারেনা! এরপর কোচিং ক্লাস বা হোম টিউটর তো আছেই। সে পর্যায় ক্রমে অনেক দিন যাবৎ কথা বার্তা, আলোচনা, সংবাদ পত্রেও অনেক লেখা লেখি হয়েছে যে বিষয়ে তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। বাড়তি হোমওয়ার্ক ও পড়ার চাপে ছেলে মেয়েরা অন্যকিছু করার কথা চিন্তাও করতে পারেনা। যেমন, খেলাধুলা অথবা কোনো বড় লেখকের গল্প বা উপন্যাসের বই পড়া। আমার এক বন্ধু ঝিনাইদহে বাড়ি, ঢাকায় মামার বাড়িতে থেকে চাকরী ও পড়াশোনা করে। তার মামাতো বোনকে দুটো গল্পের বই কিনে দিয়েছিলো! এক সপ্তাহ পর জানতো চাইলো যে সে কতোটুকু পড়েছে গল্পের বই? তার কাজিন জানায় সে ওই বই খুলেও দেখেনি। কারণ, অনেক হোমওয়ার্ক!! হোমওয়ার্ক তো নয় যেন দুঃস্বপ্ন। আমার ফুফাতো ভাই দশম শ্রেণীতে পরে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে হুমায়ুন আহমেদের কোনো বই পড়েছে কিনা! তার সোজা উত্তর না। ওই একই কারণ অতিরিক্ত পড়ার চাপ। চাপ থাকবেই কিন্তু আমাদের দেশের পড়ালেখা শুধু পাঠ্যপুস্তকের ভেতরে আটকে গিয়েছে ভয়ঙ্কর ভাবে। আর অভিভাবকগণও ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় উচ্চ নম্বরের পিছে ছুটছেন। এটা একটা নিত্য নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। একটু একটু করে সবাই রোবট বা যান্ত্রিক মানব হয়ে যাচ্ছে।
একটা প্রশ্ন:- শিক্ষা দরকার নাকি সুশিক্ষা?!
পাঠ্যপুস্তকের পড়া বাদ দিতে বলছিনা, শুধু বলছি পড়াটা একটু অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছেনা!? মানুষের মগজেরও একটা সহ্য ক্ষমতা আছে।
আমি সব সময় বলি শিক্ষা ক্ষেত্র যেন শুধু পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রীক না হয়, অনেকেই এই কথার সাথে একমত হবেন। সবাই যেন স্বনাম ধন্য, দেশ বরেণ্য লেখদেরও বই যেনো সবাই পড়ে, এই সুযোগ টা করে দেয়া উচিত। গল্প বা উপন্যাসের বই কিংবা সায়েন্স ফিকশনের বই পড়ার অভ্যাস সবার ভেতর গড়ে উঠুক।
কথার ফাঁকে আশ্চর্য জনক একটা ঘটনা বলি,আমার ছোট বোন ডিগ্রি পাস, সে একটা কিনটারগার্ডেন স্কুলে চাকরি পেয়েছে মাস খানেক হলো। ছোট বোন জানালো, সে স্কুলে বইয়ের চেয়ে শীট হ্যান্ড নোট এর সংখ্যা বেশি!! আমার বোন একদিন বোরকা পরে একদিন স্কুলে গিয়েছিলো, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বোরকা পরে আসতে নিষেধ করে দিয়েছে। বুঝতে পারছেন তো দেশ কোনদিকে যাচ্ছে! অন্ধকার.....!
আমি একদিন এক পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি গল্পের বই পড়না? সে বলল, এতো এতো H.W করার পর আর সময় পাইনা।
-হোম ওয়ার্ক শেষ করেই পড়ো বা ছুটির দিনে পড়ো।
সে জিজ্ঞেস করলো, হোম ওয়ার্ক কি?
আমি কিছুটা হলেও শঙ্কিত এ ঘটনায়!!!
এখন আরেকটা মূল সমস্যার কথা বলি, তা হচ্ছে স্মার্টফোন ও ওয়েব ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া। যা এখন ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে! স্মার্টফোন গুলোর গেমসের প্রতি ছেলে মেয়েরা প্রচুর পরিমানে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত! এই সমস্যা টা বেশি দেখা যাচ্ছে ১২ থেকে ২০ বছরে বয়সের ছেলে মেয়েদের মাঝে ( যদি বয়সের ব্যাপ্তি টা যদি ভুল হয় তাহলে জানাবেন)। ছেলে মেয়ে সবাইই আসক্ত স্মার্টফোনের গেমস ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভেতর। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা খুব গভীর ভাবে ডুবে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যার কারণে তারা বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু পাঠ্যপুস্তকের কথা নয় আউট বই বা পাঠ্যপুস্তকের বহিঃভুত বই এর কথা বলতে চাইছি। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমি নিজেও এক সময় আউট বই লুকিয়ে পড়তাম। পাঠ্যপুস্তকের বই হয়তো টিচারের ভয়ে পড়ছে, কিন্তু তাও কি ভালো ভাবে , মনোযোগ সহকারে পড়ছে?!
স্মার্টফোনের একটা নমুনা অন্ধকারের কথা বলি, আমার চাচাতো ভাই ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাকে দুইদিন একই কথা বলছে, ইশ ভাইয়া টিভিতে যে ফোনের এড দেখি মনে চায় মানুষ খুন করে হইলেও ফোন কেনার টাকা জোগাড় করি। আর কত বুঝবো এদের, "সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে নরক বাস"। যাই হোক চাচাতো ফুফাতো ভাইদের বই পড়ার কথা বলার দরুন এখন তারা আমাকে দেখলে দৌড়ে পালায়।
আমার ভেতর থেকে বই মেলার রেশ এখনো কাটেনি।
বইমেলা নিয়ে একটা পর্বে বলেছিলাম আমি বইমেলায় ঢুকেই হুমায়ুন আহমেদের বই খুজিই সর্বপ্রথম। এই বছরে বইমেলার একদিনের একটা ঘটনা বলি যা সত্যি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে! অন্যপ্রকাশের সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখছিলাম তো কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম পাঁচ জন স্কুল ছাত্র হুমায়ুন আহমেদের দুইটা বই কিনলো। মজার বিষয় টা হলো ওই পাঁচজন ছেলে ওরা খুব ঘনিষ্ট বন্ধু সবাই টাকা একত্র করে বই দুটো কিনলো। আমি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বিষয় টা লক্ষ্য করছিলাম। ওদের জিজ্ঞাসাও করলাম যে কে কোথায় থাকে, বই দুটো কে কিভাবে পড়বে? ছেলেরা জানালো ওরা একেক দিন ভাগ করে একটা বই একজন একজন করে পর্বে, ওদের হাতে আরও দুটো বই ছিলো অন্য কোনো লেখকের নাম জানা হয়নি! ওদের সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগলো, তবে খুব বেশিক্ষন কথা বলতে পারিনি ভিড় ছিল অনেক। ওদের সাথে কথা বলে আমার পুরনো দিনের কথা গুলো মনে পড়ে যায়। খুবই ভালো লাগলো দেখে যে এখনো সবাই রোবট হয়ে যায়নি!
মনে প্রানে চাই সবাই যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়।
আমি সবাইকেই ব্যক্তিগত ভাবে বই পড়ার পরামর্শ দেই প্রতিনিয়তই। মুভি বা নাটক দেখার বেপারে ডিমটিভেটেড করি। বই পড়লে জ্ঞান বারে তাও বুঝাই, জানি পুরোনো কথা তারপরও বলি। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের কেও বলি, তোমরা হুমায়ুন আহমেদ, জীবনানন্দ দাস, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই যেন তারা পড়ে।
.
পাদটিকা ১:- কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের মতো কথা বলে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, কিছু বই আছে মানুষের মতো কথা বলে।
- থিওডোর হেকার।
পাদটিকা ২:-একটি সুন্দর সৃজনশীল পদক্ষেপ মানব জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে।
- লেখকের কথা।
দয়া করে টাইপো থাকলে মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন। এই ধরণের সচেতনতা মূলক লেখা চেয়েছিলাম আর লিখবোনা!
ভালো থাকবেন সবাই।
.
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:২০