বিশাল এক দালান, আট দশ তলাতো হবেই। যাই হোক গুনে দেখিনি, ভাবছি স্যার এই বিল্ডিংএ উঠা নামা করেন কিভাবে। অবশ্য উপরে ওঠার জন্য লিফ্ট আছে, কিন্তু আজকে লিফ্ট নষ্ট! লিফ্ট সারানোর কাজ চলছে দেখলাম। ভাবলাম ভালোই হয়েছে, যদি চলতি অবস্থায় নষ্ট হতো তাহলে...!! হেটেই চারতলা পর্যন্ত উঠলাম। মনে হলো এভারেস্ট পারি দিলাম। খুব ক্লান্ত বোধ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে কুংফু পান্ডার মুভির কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে পান্ডা হলো মূল চরিত্র সে এতোই মোটা যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দম বের হয়ে যায় তার! আমি মোটা মানুষ না তবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার খুব প্রয়োজন পড়ে না বলেই অভ্যাস নেই। তাই ক্লান্ত হয়ে গেছি চারতলায় উঠতে।
ডোরবেল বাজালাম, টিং টিং... স্যার খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ, এতো স্বনামধন্য মানুষ, উনার ডোরবেলে যদি গান বাজনা বাজে তাহলে ব্যাপার টা মানায় না! যাই হোক, কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না দ্বিতীয় বার আবার বাজালাম, এবার কেউ দরজা খুললো। আমি চমকে গেলাম! তার হাতে এটা কি? আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কি চাই, কাকে চাই?!
আমি একটু তোতলামি করে বললাম, সা..সা..স্যার কি বাসায় আছেন? আমি উনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। আসলে উনিই আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। এক বুক ভরা ভয় নিয়ে কথাগুলো বললাম, সামনে একটা মানুষ, তার হাতে একটা গান আমার কি ভয় পাওয়া স্বাভাবিক নয়!?
কি সব আবোল তাবোল বকছেন! স্যার এখন কারও সাথে দেখা করবেন না, উনি এখন গভীর ঘুমে আছেন!
কি বলেন এসব! স্যার এই সাড়ে চারটার সময় ঘুমুবেন! এমন এক হেমন্তের বিকেলে, অসম্ভব! আপনি পাগল হয়ে গেছেন নয়তো বানিয়ে কথা বলেছেন!?
একদম ভয়হীন বলে দিলাম। কিসের ভয় সেতো আর গুলি করবে না!
আহ্ ভাই এতো লেকচার দিয়েন না তো। স্যার এখন কারও সাথে দেখা করবেন না। উনার মন খুব খারাপ হয়ে আছে।
কেন? কি কারণে স্যারের মন খারাপ!?
নাহ্ ভাই আপনে নাছোড় বান্দা, ভেতরে আসেন বসেন, আপনাকে খুলে বলতেছি।
স্যারের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়, মনে হলো প্রাসাদে ঢুকলাম। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে?
আমি স্যারের বন্দুক মানব।
বন্দুক মানব! মানে গানম্যান। তাই না?!
না গানম্যান না, আমি স্যারের বন্দুক মানব।
আমি তার কথা শুনে বেশ বিস্মিত হলাম!! নিজেকে সে বন্দুক মানব বলছে। এ তো স্যারের গল্পে যে অদ্ভুত চরিত্র থাকে ঠিক সেরকম।
মিঃ বন্দুক মানব আমাকে কেন জানি খুব খাতির করে ড্রইং রুমে বসালো! তারপর ঘটনা বলতে লাগলো, আসলে ভাই হইছে কি, সকালে উনি উনার মেয়ের কাছে ফোন করেছিলেন। উনার বড় মেয়ে ছোট মেয়ের খোঁজ নেয়ার জন্য কিন্তু উনারা নাকি কেউই বাসায় নাই! কই জানি বেড়াতে গেছেন।
ও এই কারণ!!
না শুধু এই কারণে না!
তাহলে...?
সকাল থেকে ফোন দিছিলো কয়েকবার কেউই ফোন ধরে নাই। যখন ফোনটা ধরলো তখন এই কথা জানালো। আর কয়েক মাস যাবৎ বাড়ি পুরাই খালি। শুধু স্যার আর আমি। একজন বাবুর্চি আছে উনি দুপুরে আর রাতে রান্না করে দিয়ে যান, মাঝে মাঝে না আসলে আমিই রান্না করি! দেখি স্যার কি যেন চিন্তা করেন আর টুকটুকে কইরা কয়টা খায় তারপর আবার তার ঘরে ঢুকে লেখালেখি করেন, আবার অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়েন!
তাই নাকি, এতো দেখি খুব কঠিন অবস্থা! স্যার সারাদিন উনার এই ধানমন্ডির ফ্ল্যাটেই থাকেন? বের হন না কোথাও বা নুহাশ পল্লীতে যান না!?
কেমনে যাবে বলেন, মনেরও একটা জোর লাগে তাই না। প্রথমে তো আমাকেই সাথে রাখতে চায়নি। শাহবাগ থানার পুলিশ কমিশনার বললো উনার জীবনের নাকি হুমকি আসছে তাই আমাকে পাঠালো স্যারের গানম্যান হিসেবে। অবশ্য এখনও কোনো সমস্যা হয় নাই। সমস্যা হবেও না। তবে সাবধানের মার নেই।
তাহলে মন মেজাজ খারাপ হওয়ারই কথা! আমি হলে তো এতক্ষনে ভাঙ্গাচুড়া শুরু করতাম! একটা মানুষ এভাবে একা কয়দিন থাকতে পারে!? তার উপর আজকে এমন একটা বিশেষ দিন...!
বিশেষ দিন মানে? বুঝলাম না!
বলছি, আগে স্যারকে আমার কথা বলুন।
কিন্তু স্যার কি দেখা করবেন?!
আপনি স্যারকে গিয়ে বলুন, একটা যুবক ছেলে এসেছে জোছনা রাতের জোনাকি নিয়ে!!
এই বললেই হবে! আচ্ছা দেখি স্যার কি বলেন?
এরপর মিঃ গানম্যান গেলো স্যারের রুমে। কিছুক্ষন পর এলো। একটু বোকাসোকা মুখ করে বললো, বসেন স্যার আসতেছেন!
এরপর মিঃ গানম্যান বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, স্যার একজন আজব মানুষ স্যারের সাথে দেখা করতে আসছেন আরেক আজব মানুষ...
আমি চুপচাপ বসে রইলাম, কিছুক্ষন পরই স্যার আসলেন। আমি দেখা মাত্রই দাঁড়িয়ে গেলাম। স্যারকে সালাম দিলাম, আসসালামুআলাইকুম স্যার।
স্যার সালামের উত্তর দিলেন, ওয়ালাইকুমআসসালাম। তুমি..! আমি ভুল না করলে তুমিই কি সেই ছেলে যে আমাকে চিঠি লিখতে প্রায় সময়, একটা ছদ্ম নামে। তোমার লেখা গুলো পড়ে খুব ভালো লাগতো আমার।
জি স্যার আমি লিখতাম সেই চিঠি গুলো। স্যার প্লিজ বসুন। লেখা গুলো ভালো লাগতো আপনার আমি জেনে খুবই প্রীত হলাম।
তুমিও বসো। তা ভালো আছো তো?!
হ্যা স্যার আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন স্যার?
আমি ভালোই আছি, এই বেশ আছি এক রকম। একা একা এই বিশাল ফ্ল্যাটে থাকি সারাদিন। ভালোই আছি।
স্যার নুহাশ পল্লীতে যান না?
যাই, হঠাৎ হঠাৎ। অনেক দিন যাবৎ যাই না। আসলে মন ভালো নেই, বাসায় শাওন নেই, বাচ্চারাও নেই। নোভা, শিলার খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন দিলাম ওরা নাকি বাসায় নেই। নুহাশ নাকি কোথায় টুরে গিয়েছে। আচ্ছা তোমার হাত কাঁপছে কেন, আর তুমি এতো ঘামছো কেন?! এখন তো আর গরম নেই, শীত আসছে।
না স্যার, এমনেই স্যার। আসলে আপনার সাথে বাসায় বসে সামনাসামনি সাক্ষাৎ হবে আমার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।
হা হা হা, হাসালে আমায়। যাক কেউ একজন আজকের দিনে আমাকে মনে করেছে, সঙ্গ দিচ্ছে, আবার মজার কথা বলে হাসাচ্ছেও, এ যেন এক আচমকা উপহার। আমি কি আর ভয়ানক কেউ বা দেশের একজন স্বনামধন্য কেউ তো নই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমাকে দেখে এতো এক্সাইটেড হওয়ার তো কিছু নেই, বলেই স্যার আবার হাসলো।
এক পাশে বসে মিঃ গানম্যান হা করে স্যার আর আমার কথা শুনছে, কিন্তু কিছু বলছে না!
স্যার আপনার হাসিটা কিন্তু খুব সুন্দর। একদম ইউনিক।
আবার হাসালে আমাকে। হা হা হা.... অনেকেই আমার সামনে এসে কথা বলতেও ভয় পায়। আর তুমি বলছো আমার হাসি সুন্দর। আজকালের ভেতরই আমি আমার মেয়েদেরকে তোমার এই কথা গুলো বলবো।
ঢাকা শহর অনেক খুঁজে একটা ফাউন্টেনপেন খুঁজে পেলাম। স্যার গিফট করবো বলে কিনে নিলাম। সুন্দর করে ৱ্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়ে নিয়ে এসেছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্যারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গিফটটা দিয়ে বললাম "শুভ জন্মদিন স্যার"
স্যার কিছুটা চমকে গেলেন! একটু মৃদু হাসি দিয়ে গিফটটা হাতে নিলেন। তুমি মনে রেখেছো আজ আমার জন্মদিন! আমার খুব খুশি লাগছে আজ। আজ আমার মনে হচ্ছে এই বাংলার মাটিতে আমার জন্ম হয়ে ধন্য। এই হুমায়ুন আহমেদকে কেউ মনে রাখবে ভাবতেই আমার খুশিতে বুক ভরে যাচ্ছে।
একটু পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি মিঃ গানম্যান চোখের জল মোছার চেষ্টা করছেন!
স্যার, এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না। আপনি হচ্ছেন কলম'র জাদুকর! এই বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ আছে যাদের হৃদয়ে আপনি চির অমর হয়ে গেঁথে আছেন এবং থাকবেনও।
অনেকেই হয়তো আমাকে আজ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে বা আজকে যদি কোনো অনুষ্ঠান হতো জন্মদিন উপলক্ষে তাহলে অনেকেই আজ ভিড় করতেন। কিন্তু তোমার এই উপস্থিতি আমার জন্য একটা বিশাল উপহার। অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি এই বাড়ির ঠিকানা পেলে কোথা থেকে।
স্যার, মনের টান থাকলে মনের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবেই।
বাহ্, বেশ সুন্দর বলেছো তো। দোয়া করি তুমি অনেক বড় মাপের কেউ একজন হও।
জি স্যার অনেক ধন্যবাদ। সব সময় দোয়ায় স্মরণ করবেন আমাকে।
তুমি আজকে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এলে। আর আমার ছেলে, মেয়ে, সহধর্মিনী কেউই কোনো খোঁজ নিলো না!
স্যার আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। দেখবেন সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে।
এখন স্যার আমাকে উঠতে হবে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হ্যা, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঠিক আছে তাহলে। তুমি যদি সময় পাও তাহলে অবশ্যই আমাকে জানিয়ে আসবে। আমার ভালো লাগবে।
অবশ্যই স্যার, আবার আপনার সাথে দেখা হবে এতো আমার পরম সৌভাগ্য। আর স্যার কোনো টেনশন করবেন না, আপন মানুষ কখনো ভুলে থাকতে পারে না। হয়তো আপনাকে চমকে দেয়ার জন্যে তারা কোনো প্ল্যান করছে। আপনি দেখে নিয়েন তাই হবে।
হুমম... স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, জানালার দিকে তাকালো। এরপর গানম্যানকে বললো, ওকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসো।
তাহলে স্যার এবার আমি আসি। আপনি মন খারাপ করবেন না। স্যারকে সালাম দিয়ে বের হবার প্রস্তুতি নিলাম, মিঃ গানম্যান পেছনে।
আমি বের হবো, দরজার বাইরে পা রাখা মাত্রই ফোনটা বেজে উঠল!! হয়তো স্যারের মেয়ে ফোন দিয়েছে, দূর থেকে বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে তাই।
আমি তাকিয়ে রইলাম, স্যার উঠে গেলেন ফোনের কাছে!
ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে হয়তো বলে উঠবে- হ্যালো বাবা! "শুভ জন্মদিন..."
লেখা:- সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪২