মাদারীপুর চরকামারকান্দি, আমার গ্রাম। শৈশবের অনেকটা সময় গ্রামে কাটিয়েছি যা কোনো দিনই ভুলার মত না, খুব ভালো সময় গুলো! আমার এতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা বলে শেষ করা যাবে না।
এই গ্রামের প্রধান নদী আসলে নদী নয়, নদ। নাম আড়িয়াল খা নদ। এই নদ নিয়ে আমার অনেক স্মৃতী বিজড়িত আছে! এখানে বলে রাখি, গ্রাম অঞ্চলে কেউ নদ ও নদীর মধ্যে যে প্রার্থক্য আছে সেটা তারা কম জ্ঞান রাখেন। নদকে নদীই বলে, মানে একটা স্ত্রী নদী আরেকটা পুরুষ নদী। নদীকে গ্রাম্য ভাষায় বলে 'গাঙ'।
দীর্ঘ ১৫ বছর পর আমি গ্রামের বাড়িতে আসলাম! এছাড়া বাবা মা ভাই বোন সবাই আসতো কিন্তু আমি আসতাম না। কেন আসতাম না এর দুটো বড় কারণ ছিলো। প্রথম কারণ, গ্রামের পানি আমি পান করতে পারি না, টিউবওয়েলের পানিতে প্রচুর আয়রন থাকে। ছোটবেলায় সরাসরি নদীর পানি পান করতে পারতাম। সে ভিন্ন কথা।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, এই গ্রাম নদী ভাঙ্গনের গ্রাম। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গনের জন্য মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। এ গ্রামের মানুষ এক প্রকার যুদ্ধ করে এই নদী ভাঙ্গনের সাথে। এই দুঃখী মানুষগুলোর দিকে তাকালে তাদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র দেখলে আমার একটুও সহ্য হয় না, আমার খুব কষ্ট লাগে। আমি একজন বেকার মানুষ, আমার বাবার এতো অর্থ বা পতিপত্তি নেই যে তা দিয়ে এই মানুষ গুলোর বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াতে পারবো! এই জন্যই আমি গ্রামের বাড়িতে আসি না।
কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবৎ আমার মন ভীষণ ভারী হয়ে আছে, বর্তমানে আমার তেমন কোনো ঘনিষ্ট বন্ধু নেই, আমি খুব একঘরে একটা লোক হয়ে গেছি, কোথাও একলা ঘুরতেও যেতে পারি না। তাই বাবাকে বললাম, বাবা গ্রামের বাড়ি যাবেন এর মধ্যে?
বাবা জানালো হ্যা যাচ্ছি ২৫তারিখ। তুই কি যাবি?!
সবাই আমার যাওয়ার ব্যাপারে শুনে খুবই খুবই অবাক হয়ে গেলো। কারণ বিগত বছর গুলোতে আমি গ্রামে আসার জন্য রাজি ছিলাম না। বিভিন্ন রকম কাজ ছিলো, পড়াশোনার ব্যস্ততা ছিলো, তাই।
গ্রামের আসার বেশ কয়েকদিন আগে থেকে শুধুই সেই নদের কথাই আর নদের সেই সুলভ স্মৃতী বহুল দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিলো মনে। আহ্ সেই নদ কি সুন্দর কি গভীর কি তীব্র তার স্রোত। পাড়ে বসে নদের পানির সেই কলকল ধ্বনি এখনও কানে সুর করে। ছোটবেলায় নদীর ঢেউয়ের শব্দ কানে ভেসে আসতো, কি মিষ্টি মধুর সেই ঢেউয়ের সুর। আর বেশি রাতে লঞ্চ, ট্রলারের শব্দে ঘুমাতে একটু কষ্ট হতো তারপরেও মজাই আলাদা। সেই স্মৃতীগুলো কল্পনা করে করে আসছি গ্রামে। কিন্তু গ্রামে এসে আমি পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলাম, মনে হলো আমার মাথার উপর বাজ পড়লো! গ্রাম সেই আগের মত নেই। আমি বারবার বাবাকে জিজ্ঞেস করছি, বাবা নদী কই? বাবা বললো, আছে। এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন!? গ্রামে আমাদের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। এক চাচার বাড়িতে গিয়ে উঠি আমরা, সেখানেই বেড়াই। বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন আশ্চর্য হয়ে গেলাম, উঠোনে দাঁড়িয়ে নদী দেখতে পেলাম না।
বাবাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, নদী কই? একদম বাচ্চা মানুষের মত।
বাবা জানালো, নদীর এপার ভেঙে ওপার গড়ে উঠেছে তাই নদীতে এখন চর পরে গেছে। আমার মাথা পুরো চক্কর মেরে উঠলো, মনে মনে ভাবতে লাগলাম, হায়হায় সুন্দর নদটা যদি দেখতে না পাই তাহলে গ্রামে আসলাম কেন!!!!
চাচার বাড়ির পাশে একটা প্রান্তে একটা খাল ছিলো সেটাও শুকিয়ে নেই বললেই চলে। এখন নদই হয়ে গেছে খাল আর খাল শুকিয়ে মৃত। এক সময় নদেরও এই অবস্থাই হবে।
এই নদের এই আড়িয়াল খা নদের এতোই তীব্র স্রোত ছিলো যে নৌকো দূরে থাক লঞ্চ স্টীমারও এর স্রোতের সাথে কখনোই মধ্যস্থতা করে উঠতে পারে নাই।
এক সময় নদ মানুষের উপর আধিপত্য করতো আর এখন মানুষ এর উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে।
চর ধরে দক্ষিণ দিকে হেটে গেলে পাওয়া যায় তিন গাঙের মুখ। একটা মুখ আড়িয়াল খা যেটা উত্তর দিকে পরিবাহিত হয়েছে, আরেকটা কুমারী নদী যেটা পশ্চিম উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে, তৃতীয় যে নদীর নাম তা কেউই সঠিক বলতে পারে নাই। কেউ বলছেন টর্কি নদী কেউ বলেছেন পদ্মা! আসলে নদী ভাঙ্গনের ফলে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, নদীর গতিপথ বদলে গেছে তাই লোকেশন টা সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারলাম না। আর নদীর নামও ঠিক ভাবে খুঁজে পেলাম না। হয়তো একদিন গিয়ে দেখবো নদীর উপর মানুষ বাড়ি করে বসতি করে ফেলেছে। এটা সম্ভব, পদ্মার চরে তাই ঘটেছে। বাংলাদেশে এমন অনেক অনেক নদী আছে যার নাম আমরা আজ পর্যন্ত শুনিনি বা নাম শুনেছি কিন্তু দেখেনি; যেমন- ফটকি নদী, বগী নদী, বুড়িশ্বর-পায়রা নদী, আঠারবাঁকি নদী।
এই যে নদটিকে দেখছেন এটি প্রায় শুকিয়েই গেছে। এই নদে এক সময় এতটাই দীর্ঘ আর গভীর ছিলো যে এর স্রোতের কারণে নৌকা তো দূর একটা ট্রলার বা লঞ্চ বা স্টিমারও নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যেতো না। আমার নিজের চোখে দেখা এক সময় এই নদে দুই বার হয়তো, আমি জাহাজও দেখেছি। যা এখন কল্পনা...!
.
নদের ক্যান্সার হয়েছে; একটা সময় মৃত্যু হয়ে যাবে। ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসা নেই। ধীরে ধীরে মৃত্যুই এর শেষ চিকিৎসা!
এখন শীত কাল তাই নদের পানি কমে গেছে! আসলে ঘটনা তা নয়। এই নদেও শীতকালে প্রচুর পানি থাকতো, আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই। গ্রামের লোকে একে সর্বনাশা নদী বলে। অবশ্য আমি তা বলি না।
এক সময় নদ-নদীর নাভ্যতা ছিলো অনেক গভীর। গভীর হওয়ার কারণে বর্ষাকালে অতি বৃষ্টি হলেও বন্যা হতনা। সে সময় গ্রামের জীবন ছিলো মানুষের জন্য স্বর্ণ যুগের জীবন। সমগ্র নদী ভরা ছিলো মাছে। আমি নিজে বেশ কয়েকবার জ্যান্ত ইলিশ মাছ দেখেছি, নিজের ধরেও দেখেছি। এই আড়িয়াল খা নদেই আমরা ইলিশ মাছ পেতাম। গ্রামের মানুষের মাছের জন্য কখনোই হাহাকার করতে হতো না!
যতদিন নদ নদীর নাভ্যতা বেশি ছিলো ততদিন সব ভালোই ছিলো। নদীর নাভ্যতা কমছে, নদীর ভরাট হয়ে চর পড়ছে, সেই চর দখল হয়ে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। বর্ষাকালে গ্রাম অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি সব সময় অবনতি হয়, আর তখনই মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায়! খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে, বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির পানি ও বন্ধু রাষ্ট্রের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে নদীতে পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। এতে করে বন্যার সৃষ্টি হয়। (বন্ধু রাষ্ট্রও যদি বাঁধ না দিতো, সব সময় আমাদের দেশে পানির প্রবাহটা যদি বজায় থাকতো, তাহলে এই সমস্যার ৮০ভাগ হলেও সমাধান হতো।) অথচ এ দেশের বেশিরভাগ জনগণ এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, আসলে বুঝতে চায় না। কারণ, ক্ষমতাশালী লোকদের চিন্তা কখন চর দখল করবে! [হায়রে মানুষ] তোরা নদীর মর্ম, মায়া, ভালোবাসা, একটা বন্ধুত্ব বুঝতে পারলি না!
আমি হয়তো দীর্ঘ দিন পরে গ্রামের বাড়ি গেলাম কিন্তু নদীর প্রতি আমার যে ভালোবাসা তা আদৌ অটুট। আমার গ্রামের নদ আমার কাছে বন্ধুর মত ভাইয়ের মত। ছোট বেলায় এই নদীর ভাঙন আর প্রচন্ড স্রোত এর কারণে নদীর কথা মনে পড়লে আমার ভয় লাগতো, তবুও আমি চাইতাম এই নদে, নদীতে আমি সাঁতার কাটি, নৌকা চালাই। এই আড়িয়াল খা নদে নৌকা চালানো নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। শৈশবের এই নদ'কে কল্পনা করে আমি কত কবিতা লিখেছি তা কে জানে। কবিতা গুলোও নদীর মত হারিয়ে গেছে!
নাহ্ নদের এমন করুন পরিণতি আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না!!আজ এই নদী দেখে আমার মন একদম ভেঙে গেছে। বুকের বা পাশে একটা ব্যাথা অনুভব করছি। যেকোনো সময় হার্ট এট্যাক হতে পারে এমন ধরনের ব্যাথা।
নদ এখনও মরে নাই, ক্যান্সার হয়েছে। যেকোনো এক শীতে না গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে মারা যেতে পারে! ক্যান্সার যেমন সারানো যায় না ঠিক তেমনি আগের সেই নদ/নদীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না!
নদের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি খুব মর্মাহত। আমার বুকে ব্যাথা অনুভব করছি এখনও। আমার মনে হয় প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর এতো কষ্ট আমি পাইনি! আমি এতটা কষ্ট পাইনি যতটা কষ্ট পেয়েছি নদের এই করুন অবস্থা দেখে। এভাবে একটা নদ মৃত্যুর পথে ঢলে যেতে পারে আমি কখনোই ভাবিনি, ভাবতেও পারি না।
আমার মনের একটা গভীর ইচ্ছে আমি এখনো কল্পনা করি যে, আমি মরে গেলে আমার লাশ ভাসিয়ে দিবে এই নদের স্রোতে! আমি অনন্ত কাল ভাসবো এই এই নদ নদীর বুকে! মনে হয় এই স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না আমার। কারন একটা সময় নদ নদীই থাকবে না!!
আমি সারাটা জীবন যদি এই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম তাহলে খুব শান্তি পেতাম! নদীর ধারে সূর্য অস্ত নদীর অবিরাম বয়ে যাওয়া আবার কবে দেখতে পাবো কে জানে!?
এই একটা জীবন খুব ছোট! অনেক অপরিপূর্ণ।
এই নদের সাথে আমি বন্ধুর মত কথা বলতাম। কিরে আর কত ভাঙবি ঘর বাড়ি, তোর এতো স্রোত আসে কোত্থেকে( হয়তো অনেক বিশ্বাস করবে না বা পাগলও ভাবতে পারে। কিন্তু কথা গুলো সত্য)। অনেক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি, নদী দেখেছি। কিন্তু এই নদের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি। এমনকি কল্পনা থেকেও মুছে যায়নি নদের স্মৃতী। আমার সমগ্র কল্পনা জুড়েই শুধু এই নদ। আজ অবধি এই নদকে আমি কল্পনা করি, মনে হয় এই আমি বসে আছি নদের পাড়ে আর আমার সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদের স্রোত....!
বানান বা লেখার শুদ্ধতা নিয়ে কোনো কিছু বলবেন না আপাতত প্লিজ। আমি খুবই মর্মাহত। বলতে গেলে ভেঙে পরেছি। এই নদ আমার আপনের মত। খুব ঘনিষ্ট কেউ, এমন!
ভিডিও করে রাখলাম নদের বর্তমান অবস্থা!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৯