somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের শিল্প-সাহিত্যের আলোয় গান্ধীবাদ

২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩৮ তম প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নজরুলের শিল্প-সাহিত্যের আলোয় গান্ধীবাদ
আবদুল্লাহ আল-আমিন

বাঙালির অফুরন্ত আবেগ, ‘বাঁধন হারা’ উচ্ছ্বাস আর প্রবল প্রাণশক্তিকে আপন আত্মায় ধারণ করে যিনি সারাজীবন দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল এই মহৎ কবির আরাধ্য ছিল সত্য শিব সুন্দর। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নজরুল সত্য-সুন্দর ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলেছেন ঃ ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’(প্রতিভাষণ ঃ নজরুল ১৯২৯)
সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবন চর্যায় তিনি দীর্ঘকাল স্থির থাকতে পারেননি; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাঙলা ও বাঙালির কবি। তাইতো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে এবং পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে যোগায় অনিঃশেষ প্রেরণা।

নজরুল ইসলামের জন্ম অবিভক্ত বাংলার রাঢ় অঞ্চলের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারে। প্রত্যেক মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক প্রতিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মসূত্রে বহন করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক উত্তরাধিকার। সময়ের প্রবহমানতায় এ উত্তরাধিকার মানুষ কখনও কখনও পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে। তবুও মানুষের ব্যক্তি চরিত্র ও ব্যক্তি চৈতন্য নির্মাণে কাল বা সময় শাসিত এ উত্তরাধিকার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নজরুল ইসলাম জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন দারিদ্র, অভাব-অনটন ও বিশ শতকীয় ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারের উত্তরাধিকার। মাত্র ন’ বছর বয়সে তিনি পিতা ফকির আহমেদ কে হারান। পিতার মৃত্যু তাঁর জীবনকে এলোমেলো ও দিশাহীন করে দেয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি কখনও নিকটবর্তী গ্রামে মোল্লাগিরি, মসজিদে এমামতি করছেন , আবার কখনও রুটির দোকানে কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন, বিশ শতকীয় মুসলিম পরিবারের বিলীয়মান উত্তরাধিকারকে মেনে নিয়ে তাঁকে বেড়ে উঠতে হয়েছে। সে কারণে জীবন ছিল তার শৃংখলাহীন আর এই শৃংখলাহীন ও বাঁধন হারা জীবন তাঁর কবি সত্তাকে প্রভাবিত করেছে। সেই সাথে রাঢ় বঙ্গ তথা বীরভূম-বাকুঁড়া-বর্ধমান এর ভূ-প্রকৃতি ও নিসর্গের রুঢ়তা করিব সংবেদনশীল সত্তাকে প্রভাবিত করেছে। বলা হয়ে থাকে ‘রাঢ় বঙ্গের নিসর্গই জয়দেব-চন্ডীদাসের মধুনিস্যন্দী কাব্যনির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ করেছে, তন্ত্রিক পীঠস্থানে বহু শক্তি উপাসকের কঠোর শক্তি সাধনার মদিরা যুগিয়েছে এবং লোকায়ত সংস্কৃতির উষ্ণ প্রস্রবণটিকে যুগ যুগ ধরে সজীব রেখেছে’। (বিনয় ঘোষ, তারাশাঙ্করের সাহিত্য ও সামাজিক প্রতিবেশ: শনিবারের চিঠি, পৃ: ২৪৯) এ জনপদের প্রকৃতির দ্বৈতরুপ অথ্যাৎ রুঢ়তা ও সবুজের স্নিগ্ধতা নজরুলকে দান করেছে একই সাথে শাক্তের রুঢ় বলিষ্ঠতা আর বৈষ্ণবের ভক্তি ও বিনয়। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত রুঢ় নিসর্গের ভেতরের ‘অফুরন্ত প্রাণ প্রবাহের নির্ঝর’ আর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্র উত্তরকালে তাকে রুপান্তরিত করেছে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা এক মহান বিপ্লবী পুরুষে, যিনি সারাজীবন একই সাথে গেয়েছেন দ্রোহ ও প্রেমের গান । নজরুল কবি হিসেবে যখন অভ্যূদয় তখন সারা ভারত জুড়ে চলছে আসহযোগ আন্দোলন, চরকা আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের উন্মাদনা।

আবার একদিকে প্রথম মহাযুদ্ধের মানব বিধাংসী ও সভ্যতা বিরোধী রাজনীতির অশুভ আত্মপ্রকাশ , অন্যদিকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যূদয়ের আলোক আভায় আলোকিত ও প্রাণিত চারিদিক। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কালের বৈনাশিকতা আর রুশ বিপ্লবের মহামন্ত্রের নহবত - কালের দ্বৈরথকে করেছেন ধারণ করে কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় বিশাল অঙিনায় নজরুলের আবির্ভাব। আবির্ভাববকালে তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শগত রোমানটিসিজম’ দ্বারা আকৃষ্ট হন। মানব জীবনের মৌলিক নীতিবাদের সাথে গৃান্ধীর অহিংস তত্ত্বের মিল থাকাব কারণেই তিনি এ তত্ত্ব দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কেবল নজরুলের নয় সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসু প্রমুখও গান্ধীর প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিলেন না । অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, উদার সমন্বয়বাদী ধর্মচেতনা, অহিংস দর্শন গান্ধীকে এক বিস্ময়কর প্রপঞ্চে পরিণত করে। মহাত্ম গান্ধীর সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাত হয় হুগলিতে পরে ফরিদপুরে । সাক্ষাতের পূর্বেই নজরুল গান্ধীর আহিংস অই অসহযোগ আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। ১৯২১ সালের সারা ভারত বর্ষের মানুষ যখন গান্ধীর ডাকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং দেশজুড়ে চলছে অসহযোগ আন্দোলন তখন নজরুল গান্ধীর রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে লিখেন :
এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়।/ ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায় / অধীন দেশের বাঁধন বেদন / কে এলো রে করতে ছেদন”?
(পাগল পথিক, বিষের বাঁশি, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, বাংলা একাডেমী ১৯৮০ পৃ: ৯৬)
গানে উল্লিখিত পাগল পথিক ছিল মাহত্ম গান্ধী। গান্ধীকে নিয়ে এটাই ছিল নজরুলের প্রথম গান। এ গানের মাধ্যমে তিনি গান্ধীবাদ , অসহযোগ আন্দোলন, স্বরজের প্রতি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় সমর্থন দিয়েছিলেন। তবে গান্ধীর জাতপাত রাজনীতির চর্চা নজরুল কে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে বেশি। নজরুলের জীবন ও শিল্পী সাধনা ছিল মূলত মনুষ্যত্ব ও সম্প্রীতির সাধনা । কেবল সম্প্রদায়িক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেন নি, তীর্বভাবে বিরেধিতা করেছেন ছঁৎমার্গ ও সম্প্রদায়ের নামে বাড়া বাড়িকে। তিনি বলেছেন ঃ কোন ধর্মই মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করতে শেখায় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায়। গান্ধীও ‘বেদ উপনিষদ, পুরান হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলতে যা কিছু আছে’ তাতে বিশ্বাস রেখেও ছুঁৎ মার্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি বলেছেন ঃ গীতার প্রতি নিষ্ঠাবান কোন লোক, হিন্দু ও মুসলমান ভেদ করবেনা । গীতাতে প্রতিপাদিত ভক্তি ও ধর্ম ও প্রেমের মার্গে মানুষকে ঘৃণার কোন জায়গা নেই । (ইয়ং ইন্ডিয়া ’ সেপ্টেম্বর ১৯২৭)

গান্ধী মনে করতেন মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা মনুষত্ব্যের অবমাননা। মানুষকে ঘৃণা করা ঈশ্বরকে ঘৃণা করার নামান্তর। গান্ধীর মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের বাণী নজরুলের সংবেদশীল সত্তাকে আবেগ মথিত করেছে। শিল্প সাধনার এ পর্বে কবি গান্ধীকে মহামানবের আসনে বসিয়ে লিখেছেন নানাসব কালজয়ী কবিতা, গান ও প্রবন্ধ। চিরবিদ্রোহী নজরুল গান্ধীর জাতপাত হীন রাজনীতির প্রতি অবিচল আস্থা রাখতে পারলেও, আস্থা রাখতে পারেননি অহিংস দর্শনের প্রতি। দেশে মুক্তির সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ও রুশ বিপ্লবের প্রেরণা জাত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তিনি গান্ধীকে পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে অহিংস শান্তিবাদী পন্থায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র যুদ্ধ। এ কারণে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির আপোষকামিতা, অরবিন্দের নিস্ক্রিয় বৈষ্ণব সাধনা, চিত্তরঞ্জন দাশের মধ্যপন্থা আর রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তির ললিত বাণী’ সমর্থন করতে পারেননি। ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের এহেন আচরণকে এক ধরনের বিচ্যুতি ও বলে মনে করেছেন তিনি।

ক্ষোভ ও ঘৃণা মিশ্রিত আবেগ ‘আনন্দময়ী আগমনে’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন; ‘মাদীগুলোর আদিদোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি নাকি/ খাঁড়ায় কেটে করমা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।/ হান তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্রশেখা,/ মাদী গুলোকে কর মা পুরুষ, রক্ত দেমা, রক্ত দেখা। (আনন্দময়ীর আগমনে, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পৃ:৩৩০)

নজরুল দৃঢ়তার সাথেই বিশ্বস করতেন অহিংস পন্থা কিংবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে ভারতবর্ষকে কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্ত করা যাবে না, ঔপনিবেশিক শক্তিকে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। দেশের জন্য কেবল সেবক নয়, প্রয়োজন সৈনিকের। তিনি এমন এক অগ্নি পুরুষের অভ্যূদয় কামনা করেছেন, যিনি ‘আঘাতও করবে, প্রতিঘাতও বুক পেতে নেবে, বিদ্রোহ করবে’। এ কারণে তিনি ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, ‘প্রার্থনা’ কবিতায় দেশের জন্য কামাল আতার্তুক, বিবেকানন্দ ও ঝাঁসীর রানীর অভ্যূদয় কামনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর মতো মহাপুরুষ কিংবা অরবিন্দ প্রফুল্ল রায়ের মতো সাধকের খোঁজ তিনি করেন নি, খুঁজেছেন বিবেকানন্দের মত সংগ্রামী পুরুষকে। রামকৃষ্ণ পরম হংসদেবের সমন্বয়বাদী দর্শন নজরুরকে আকৃষ্ট করেছিল কী না, জানা যায় না। তবে তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দের পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি এক প্রবন্ধে লিখেছেন ঃ
‘সৈনিক কোথায়? কোথায় আঘাতের দেবতা, প্রলয়ের মহারুদ্র? সে পুরুষ এসেছিল বিবেকানন্দ, সে পুরুষের পৌরুষ হুঙ্কার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কন্ঠে। (আমি সৈনিক, দুর্দিনের যাত্রী, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড,পৃ:৬৮৭)

নজরুল ছিলেন মূলতঃ সকল ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক অমর প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রিটিশ শাসনের শৃংখল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রবল বাসনা তিনি সব সময়ই অনুভব করেছেন। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শুনে তিনি তাঁর দু-যুগের কাব্য পরিক্রমায় মাঝে মাঝেই হয়তো, পথ, দর্শন এমনকি ধর্মাদর্শ বদলিয়েছেন। কিন্তু ভেদবুদ্ধিহীন, আসম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কখনও নিজেকে বদলান নি। ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সম্প্রদায় ঊর্ধ্ব মানুষ। বিবাহ করেছেন মুসলমান নার্গিস আক্তার খানম ও হিন্দু প্রমিলা দেবীর সাথে। তবে ‘আহলুল কিতাব’ এই মত অনুসারেই কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তার বিয়ে হয়েছিল কলকাতার ৬নম্বর হাজী লেনের বাড়ীতে ১৯২৪ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে। (মুজাফফর আহম্মদ: ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’, ১৯৭৫ কলকাতা, পৃ: ১৭৯-১৮০)
প্রমীলাকে ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়ে বিয়ে করার কথা নজরুল চিন্তাও করেননি। এমনকি তাঁর আরবি নামকরণেরও প্রয়োজন পড়েনি। মুসলিম মোঘল সম্রাটরাও বহু অমুসলিম নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই সব স্ত্রী অন্তঃপুরে নিজ নিজ ধর্ম পালন করেছেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরানের আলোকে। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ। অবশ্য শিশু কালেই কৃষ্ণ মুহাম্মদের মৃত্যু হয়। পরবর্তীদের নামকরণ করা হয়; অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ। নজুরুল বিশের বাঁশী (১৯২৪) ‘জগজ্জননী স্বরূপা মা মিসেস এম রহমানকে’, চিত্তনামা (১৯২৫) ‘মাতা বাসন্তী দেবীকে’ এবং সর্বহারা (১৯২৬) ‘মা বিরজা দেবীকে’ উৎসর্গ করেন। লক্ষণীয়, এরা সকলেই ছিলেন নজরুলের কাছে মার মত। তাঁর সখ্যতা ও বন্ধুত্ব ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেকের সাথেই। শৈলজানন্দ মজুমদার, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মুজাফফর আহমদ, কাজী মতোহার হোসেন, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ ছিলেন তার অকৃত্রিম বন্ধু এবং অনেক শুভকর্মের সহযাত্রী। নজরুল যা লিখেছেন তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বস করতেন আর বিশ্বাস করতেন বলে তা জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। তাঁর জীবন সাধনাকে কোন ভাবেই শিল্পসাধনা থেকে আলাদা করা যায় না। প্রেম ও দ্রোহের এই সাধক মানবতার সুউচ্চ মিনারে বসে সারাজীবন সাম্য-সম্প্রীতি ও মিলনের গান শুনিয়েছেন। ভারত বর্ষের সব সাধক, দার্শনিক ও কর্মীপুরুষের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে প্রচার করেছেন সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর বাণী। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মের ঐতিহ্য থেকে ভাষা গ্রহণ করে কবিতা ও গানে তা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু মননে-মগজে ছিলেন সম্পূর্ণ অসম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা কবীর নানক থেকে লালন সাঁই পর্যন্ত অনেকে বলেছেন Ñকিন্তু নজরুলের মত জীবনে মননে অমন গভীরভাবে কেউ কি আর বলতে পেরেছে? হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা বাঙালি কবি-সাহিত্যিক এবং সাধকদের কেউ কেউ বলেছেন Ñ কিন্তু নজরুলের মত সাম্প্রদায়িকতা ও ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেনি কেউ। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য স্পর্শ করে তিনি চলে গেছেন অসম্প্রদায়িকতা ও উদার মানবিকতার দিকে। ভারতীয় রাজনীতির তুঙ্গ মুহুর্তে নজরুল গান্ধীবাদ ত্যাগ করে নিজেকে যুক্ত করেন নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির অন্য পথে। তবে গান্ধীর সব স্বপ্ন ও দর্শন তিনি ত্যাগ করেন নি, যেমন ত্যাগ করেন নি গান্ধীর অসাম্প্রদায়িকতা, উদার মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও দর্শনকে।


আবদুল্লাহ আল আমিন,সহকারী অধ্যাপক,মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×